প্রথম পর্বে আমরা দেখেছি কীভাবে ডাচ ডিজিজের কবলে পড়ে ভেনেজুয়েলা অর্থনৈতিকভাবে ব্যর্থ রাষ্ট্রের কাতারে নাম লিখিয়েছে। শুধু প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অতিনির্ভরশীলতা কীভাবে একটি দেশের পতন ডেকে আনতে পারে, তার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ ভেনেজুয়েলা। এজন্য অর্থনীতিবিদরা পরামর্শ দেন, প্রাকৃতিক সম্পদের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ যদি দেশের অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করা হয় এবং অন্যান্য শিল্পের প্রসার ঘটানো হয়, তাহলে ডাচ ডিজিজ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। অর্থনীতি ও রাজনীতি যেহেতু পরস্পরকে প্রভাবিত করে, তাই একটি দেশে যখন অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হয় তখন সেটা প্রভাবিত করে রাজনীতিকেও। ভেনেজুয়েলাও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। বর্তমানে তাদের দেশের যে অর্থনৈতিক দুরবস্থা চলছে, তার প্রভাবে রাজনীতিতেও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে।
ভেনেজুয়েলায় কী ধরনের রাজনৈতিক সংকট চলছে, তা কিছুটা বোঝা যাবে তাদের রাষ্ট্রপ্রধানের বিষয়ের দিকে নজর দিলে। ভেনেজুয়েলায় এখন রাষ্ট্রপ্রধান দুজন। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। আমরা সবসময়ই দেখে এসেছি প্রতিটি রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধান থাকেন একজন। ভেনেজুয়েলায় কীভাবে ভেনেজুয়েলায় দুজন রাষ্ট্রপতি হলো- সেই বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক।
জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে বর্তমানে ক্ষমতায় আছেন নিকোলাস মাদুরো। ২০১৩ সালে ভেনেজুয়েলার কিংবদন্তি নেতা হুগো শ্যাভেজ যখন মারা যান, তখন সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পদে পুনরায় নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হয়। নির্বাচনে হুগো শ্যাভেজের সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা নিকোলাস মাদুরো জয়লাভ করেন এবং তার প্রথম মেয়াদে ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দখল করেন। সেই নির্বাচনে তিনি খুব কম ব্যবধানে (১.৬ শতাংশ) তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হেনরিক ক্যাপ্রিলেস রাদোনস্কিকে পরাজিত করেন। হুগো শ্যাভেজের সময় থেকেই ভেনেজুয়েলার অর্থনীতির অবনমন ঘটতে শুরু করে। শ্যাভেজ ভেনেজুয়েলার সামাজিক অসমতা কমিয়ে আনতে সমাজতান্ত্রিক নীতির উপর ভিত্তি করে যেসব পদক্ষেপ নেন, সেগুলোর বেশিরভাগই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। মাদুরো রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর অর্থনৈতিক অবস্থার আরও অবনতি হয়।
২০১৮ সালে ভেনেজুয়েলায় আবার রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন হয়। নিকোলাস মাদুরোর প্রতি জনসমর্থন অনেক কমে এসেছিল, অপরদিকে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা হুয়ান গুইদোর জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছিল। সমাজতান্ত্রিক দলের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী মাদুরো বুঝতে পেরেছিলেন সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা সম্ভব না। নির্বাচনের আগে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের উপর ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। অনেক সম্ভাব্য প্রার্থী জেলে বন্দী হওয়ার ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। নির্বাচনে মাদুরো আবার জয়লাভ করলেও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বয়কট করেছিল। তবে সমস্ত সমালোচনা, প্রতিবাদকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মাদুরো দ্বিতীয় মেয়াদে আবার ক্ষমতা দখল করেন। এবার শুরু হয় আসল সংকট।
নিকোলাস মাদুরো সমাজতান্ত্রিক দল থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও ভেনেজুয়েলার আইনসভায় আধিপত্য ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী হুয়ান গুয়াইদোর রাজনৈতিক দলের জনপ্রতিনিধিদের। আইনসভা দ্বিতীয় মেয়াদে নিকোলাস মাদুরোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দেয় এবং রাষ্ট্রপতি পদকে শূন্য ঘোষণা করে। ভেনেজুয়েলার সংবিধান অনুযায়ী, এরকম পরিস্থিতিতে আইনসভার নেতা রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। ভেনেজুয়েলার আইনসভার এরকম ঘোষণার পরই আইনসভার নেতা হুয়ান গুয়াইদো নিজেকে ভেনেজুয়েলার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট দাবি করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই প্রায় পঞ্চাশটি দেশ ভেনেজুয়েলার বৈধ প্রেসিডেন্ট হিসেবে হুয়ান গুইদোকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। আমেরিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ এই স্বীকৃতি প্রদানকারী দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে। অপরদিকে রাশিয়া ও চীনের মতো দেশগুলো ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত নিকোলাস মাদুরোর পক্ষেই নিজেদের সমর্থন অব্যহত রেখেছে।
যদিও সংবিধান অনুযায়ী হুয়ান গুয়াইদো বর্তমানে ভেনেজুয়েলার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন, তারপরও তার হাতে খুব বেশি নির্বাহী ক্ষমতা নেই। ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো এখনও রাষ্ট্রপতির জন্য বরাদ্দ বাসভবন দখল করে আছেন। সবচেয়ে বড় বিষয়, দেশটির সেনাবাহিনী এখনও তার প্রতি অনুগত রয়েছে। এর পেছনে অবশ্য কারণও রয়েছে। ভেনেজুয়েলার অর্থনীতির ক্রমশ অবনতি ঘটলেও প্রেসিডেন্ট মাদুরো নিয়মিত সেনাবাহিনীর নিয়মিত বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করেছেন। এছাড়া সেনাবাহিনীর অনেক উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক কর্মকর্তাকে তিনি রাষ্ট্রের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদেও নিয়োগ দিয়েছেন। সংকট নিরসনের জন্য ২০১৯ সালে হুয়ান গুয়াইদো ও নিকোলাস মাদুরোর মাঝে কথা চললেও শেষ পর্যন্ত কোনো সমঝোতা পৌঁছায়নি কোনো পক্ষই।
ভেনেজুয়েলার রাজনীতি ও অর্থনীতির জন্য আরেকটি খারাপ বিষয় হচ্ছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। ১৯৯৯ সাল থেকে ভেনেজুয়েলার ক্ষমতা আকড়ে থাকা হুগো শ্যাভেজ যখন মারা যান, তখন আমেরিকা ভেবেছিল হয়তো এবার নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক দলের কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবে। কিন্তু শ্যাভেজের উত্তরসূরী মাদুরো আমেরিকার সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে দেন। এরপর থেকেই বছরের পর বছর আমেরিকা একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গেছে ভেনেজুয়েলার উপর। বর্তমানে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে ভেনেজুয়েলার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের মাধ্যমে লেনদেনের উপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলারের তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে অন্যান্য নিষেধাজ্ঞার জন্য বিদেশি কোনো কোম্পানি ভেনেজুয়েলায় বিনিয়োগ করতে পারছে না। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার জন্য ভেনেজুয়েলা বর্তমানে আমদানি ও রপ্তানিতে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে।
ভেনেজুয়েলার এই ধরনের রাজনৈতিক সংকটের জনগণের প্রতিক্রিয়া কী– এটা একটি চমৎকার প্রশ্ন হতে পারে। নিকোলাস মাদুরো রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকেই ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি ও রাজনীতি ক্রমান্বয়ে অবনমিত হয়েছে। এর প্রতিবাদে জনগণ অসংখ্যবার রাজপথে নেমে এসেছে, কিন্তু কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। প্রেসিডেন্ট মাদুরো এসব আন্দোলন-প্রতিবাদকে ‘আমেরিকার ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দাবি করেছেন প্রতিবার। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে আরও বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠেছেন তিনি- এই ধরনের অভিযোগ করছে পশ্চিমা দেশগুলো। আমেরিকা যে নিষেধাজ্ঞাগুলো দিয়েছিল সেসবের প্রধান লক্ষ্য ছিল মাদুরো সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাদুরো সরকার স্বেচ্ছায় ক্ষমতা থেকে সরে যাবে– এই ধরনের আভাস পাওয়া যায়নি। ভেনেজুয়েলার নাগরিকেরা আরও ভালো জীবনের আশায় সুযোগ পেলেই দেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে পালিয়ে যাচ্ছেন। মুদ্রাস্ফীতির চাপে ভেনেজুয়েলার জনগণের দিনাতিপাত অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠেছে। সেই সাথে যোগ হয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অত্যধিক সংকট। এতকিছুর পরও যারা টিকে আছেন, তাদের অবস্থা মোটেও ভালো নয়।
ভেনেজুয়েলা এখন স্রেফ হতাশার নাম। আধুনিকতার এই যুগে যেখানে প্রতিটি রাষ্ট্র একটি আরেকটির চেয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা করছে, ঠিক তখন ভেনেজুয়েলা যাচ্ছে উল্টো পথে। প্রাকৃতিক সম্পদের পরিকল্পনাহীন ব্যবহারে একটি সম্ভাবনাময় দেশ কীভাবে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে পারে, তা ভেনেজুয়েলাকে দেখলে উপলব্ধি করা যায়। দীর্ঘসময় ধরে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অতিনির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে না পারা, অন্যান্য শিল্পের প্রসার ঘটাতে না পারা কিংবা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হওয়া– ভেনেজুয়েলার অধঃপতনের পেছনের কারণ মূলত এগুলোই। আজকে ভেনেজুয়েলায় প্রতিটি শিশু জন্মগ্রহণ করে হাজার হাজার মার্কিন ডলারের ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে। বর্তমানে দেশটির মোট ঋণের পরিমাণ ১৫০ বিলিয়ন ডলার, যা তাদের মোট অর্থনীতির দ্বিগুণ। প্রাকৃতিক সম্পদশালী দেশগুলোর একটি চমৎকার কেস স্টাডি হতে পারে ভেনেজুয়েলা।