বিশ শতকে মার্কিন কূটনৈতিক পরিমন্ডলে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব নিঃসন্দেহে হেনরি কিসিঞ্জার। ইতিহাসে হেনরি কিসিঞ্জারকে মূল্যায়ন করা হয়েছে নানাভাবে। অনেকে মনে করেন, জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করা এই আমেরিকান কূটনীতিক যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত ছিলেন, যদিও তার যুদ্ধাপরাধের জন্য তাকে কখনও বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। আবার অনেকে মনে করেন, মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সফল ‘সেক্রেটারি অব স্টেট’ হলেন হেনরি কিসিঞ্জার।
২০১৫ সালে ‘কলেজ অব উইলিয়াম এন্ড মেরি’ আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একটি জরিপ পরিচালনা করে। এই জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, হেনরি কিসিঞ্জার হচ্ছেন গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে কার্যকর ‘সেক্রেটারি অব স্টেট’। আবার অনেকে তাকে চিলির সামরিক অভ্যুত্থান, আর্জেন্টাইন সামরিক জান্তার ‘নোংরা যুদ্ধ’ কিংবা গণহত্যা চালানোর পরও পাকিস্তানিদের পক্ষে মার্কিন সমর্থন অব্যাহত রাখার জন্য তাকে ইতিহাসের খলনায়ক হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।
হেনরি কিসিঞ্জারকে মূল্যায়ন করা একটি জটিল ব্যাপার। একেকজনের দৃষ্টিতে তিনি একেকরকম। তিনি ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসন বন্ধের কারণে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন, আরব-ইসরায়েলি সংঘাত নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তেমনই অগণিত মানুষের মৃত্যুর জন্যও তাকে দায়ী করা হয়। তাকে একটি নির্দিষ্ট মানদন্ডের উপর ভিত্তি করে বিচার করা সম্ভব নয় আদতে। তবে তিনি এমন একজন ব্যক্তি, যিনি তার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ও ভাবনাকে তার পেশাদার জীবনে সফলভাবে প্রয়োগ করেছিলেন– এই বক্তব্যের সাথে যে কেউই একমত হবেন। দুর্দান্ত মেধার পরিচয় দিয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশ কয়েকটি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন তিনি। অর্থাৎ তিনি যে একজন ঝানু কূটনীতিক, এটি তার কট্টর সমালোচকরাও স্বীকার করতে বাধ্য হবে। আরব-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব কৌশলগতভাবে নিরসনের জন্য তিনি যে নতুন কূটনৈতিক তত্ত্বের প্রয়োগ করেছিলেন, সেটি আজ ‘শাটল ডিপ্লোমেসি’ হিসেবে আন্তর্জাতিক রাজনীতি অধ্যয়নে স্থান পেয়েছে।
‘শাটল রাজনীতি’ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার আগে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। ধরুন, দুটি রাষ্ট্র একে অপরের বিপক্ষে সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে। এই সংঘাত এতটাই গুরুতর যে, দুটি দেশ যে নিজেদের মধ্যে সংলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তি স্থাপনের ন্যূনতম সম্ভাবনাও নেই। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। এরকম পরিস্থিতিতে যদি তৃতীয় পক্ষ হিসেবে শক্তিশালী কোনো দেশের প্রতিনিধি দুই পক্ষের মধ্যে বার্তাবাহক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যদি সংঘাত নিরসনের উদ্যোগ নেয়, তাহলে সংঘাত নিরসন হলেও হতে পারে। এটিই মূলত সহজ ভাষায় ‘শাটল ডিপ্লোমেসি’ হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ, দুটি বিবদমান পক্ষের মধ্যে তৃতীয় পক্ষ যখন স্বেচ্ছায় দু’পক্ষেরই প্রতিনিধি হিসেবে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা চালায়, তখন সেটাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিভাষা অনুযায়ী ‘শাটল ডিপ্লোমেসি’ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। ব্যাডমিন্টন খেলায় শাটল যেভাবে দু’পক্ষের মধ্যে বার বার স্থানবদল করতে থাকে, শাটল ডিপ্লোমেসিতেও মধ্যস্থতাকারী তৃতীয় পক্ষকে বার বার দু’পক্ষের কাছে যেতে হয়।
১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধ ও তেল রপ্তানির উপর আরব নিষেধাজ্ঞা জারির পর আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এই সংঘাতের অবসান ঘটানো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে দাঁড়ায়। স্নায়ুযুদ্ধের সেই সময়ে পৃথিবী তখন বলতে গেলে দুটো শিবিরে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। এক শিবিরে রয়েছে কমিউনিস্ট মতাদর্শভিত্তিক সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র রাষ্ট্রগুলো। অপরদিকে রয়েছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো। আমেরিকার প্রশাসন তখন ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে ব্যস্ত থাকায় এই সংঘাত নিরসনের ক্ষেত্রে সোভিয়েতদের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। আমেরিকার আশঙ্কা ছিল- যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন এই দুটি বিবদমান পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সফল হয়, তবে এই অঞ্চলে তাদের প্রভাব বেড়ে যেতে পারে। এতে মার্কিন স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এজন্য আমেরিকার তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার দ্রুত আরব-ইসরায়েলি সংঘাত নিরসনের জন্য তৎপর হতে শুরু করেন। হেনরি কিসিঞ্জারের এই ক্ষেত্রে মূল কাজ ছিল আরব ও ইসরায়েলিদের মাঝে যে দ্বন্দ্বগুলো আছে, তা একপাশে সরিয়ে রেখে বর্তমান সংঘাতের যৌক্তিক সমাধান নিশ্চিত করা।
আরব বিশ্বের সাথে ইসরায়েলের দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জারকে অনেকবার তেল আবিব ও কায়রোসহ বেশ কিছু আরব দেশের রাজধানীতে বিভিন্ন প্রস্তাব ও বিপরীত পক্ষের বক্তব্য তুলে ধরার জন্য গমন করতে হয়। হেনরি কিসিঞ্জারের কূটনৈতিক দক্ষতা সম্পর্কে কোনো পক্ষেরই সন্দেহ ছিল না, তাই দু’পক্ষই হেনরি কিসিঞ্জারের মধ্যস্থতায় একমত হচ্ছিল। একদিকে তিনি তার দেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের প্রতি আরব রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন আদায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তেমনই যুদ্ধের সময় ইসরায়েলের দখলকৃত ভূমিগুলো ফিরিয়ে দেয়ার জন্যও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে পুরোপুরি সফল না হলেও তার গেথে দেয়া ভিত্তির উপরেই মিশর ও ইসরায়েলের মাঝে পরবর্তীতে ‘ক্যাম্প ডেভিড অ্যাকর্ড’ স্বাক্ষরিত হয়। তবে এই চুক্তির ফলে আরব বিশ্বে মিশরের যে অবস্থান ছিল, তার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এতদিন মিশরকে আধুনিক সেনাবাহিনী ও আরব বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়ার ইতিহাস থাকার কারণে আরব বিশ্বের অলিখিত নেতা ধরে নেয়া হতো। কিন্তু এই চুক্তির ফলে মিশরের বিরুদ্ধে আরব বিশ্বের বিরূপ ধারণা গড়ে ওঠে।
শাটল ডিপ্লোমেসির যেমন রয়েছে কিছু সুবিধা, তেমনই বেশ কিছু প্রতিকূলতাও রয়েছে। যেমন- যিনি শাটল ডিপ্লোমেসির নীতি অনুযায়ী দুটি বিবদমান পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করবেন, তাকে অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে। তিনি যদি একপক্ষকে প্রতি অল্প সহযোগিতা করারও মানসিকতা পোষণ করেন, তবে মধ্যস্থতা ভেস্তে যেতে পারে। এছাড়াও একই সময়ে বিভিন্ন পক্ষের বক্তব্য গ্রহণ করা ও তা অন্য পক্ষের কাছে ঠিকমতো পৌঁছে দেয়ার মতো দক্ষতাও থাকতে হয়। দুই পক্ষের চাহিদার উপর সঠিক বোঝাপড়া না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই মধ্যস্থতা ব্যাহত হবে। আরেকটি কথা আগে বলা হয়েছে। মধ্যস্থতাকারী পক্ষকে অবশ্যই শক্তিশালী কোন দেশের প্রতিনিধি হতে হয়। এতে তার উপর দুই পক্ষেরই বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। দুর্বল দেশগুলোর প্রতিনিধিদের কূটনৈতিক দক্ষতা স্বাভাবিকভাবেই কম হয়ে থাকে, যেটি শাটল ডিপ্লোমেসির মূল শর্তকেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে। তবে গতানুগতিক কূটনৈতিক পদ্ধতির চেয়ে দ্বন্দ্ব নিরসনের চেয়ে এই পদ্ধতি একদিকে যেমন বেশি কার্যকর, তেমনই সময়সাশ্রয়ী।
হেনরি কিসিঞ্জারের পূর্বেও অনেকবার শাটল ডিপ্লোমেসির কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। যেমন- কোরীয় উপদ্বীপের যুদ্ধে এই কৌশল ব্যবহার করা হয়েছিল। যদিও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তারপরও দুই বা ততধিক বিবদমান পক্ষের মাঝে সংঘাত নিরসনের ক্ষেত্রে শাটল ডিপ্লোমেসি বেশ কার্যকরী ও যৌক্তিক একটি পদ্ধতি। এটি সামরিক কিংবা পেশিশক্তি প্রয়োগের বদলে আলোচনা ও কূটনৈতিক উপায়ে দ্বন্দ্ব নিরসনে বেশি জোর দেয়। ইতোমধ্যে যে সংঘাতের ফলে রক্তপাত হয়েছে, সেই সংঘাতকে আরও বেশি ছড়াতে না দিয়ে সমাধানের পথ বাতলে দিতে শাটল ডিপ্লোমেসি একটি কার্যকর পন্থা। বর্তমানে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যে সংঘাত চলমান রয়েছে, সেখানে শাটল ডিপ্লোমেসির প্রয়োগ দেখা গিয়েছে। অতি সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং রাশিয়ায় গমন করেছিলেন। অনেকের মতে, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং চলমান সংঘাত নিরসনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সরাসরি মধ্যস্থতার বিষয়টি উল্লেখ করেননি কোথাও।