উডলন হাই স্কুল, বাল্টিমোর। আমেরিকার সব অঙ্গরাজ্যের মতো মেরিল্যান্ডের এই স্কুলেও ছোট থেকে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বড় হওয়া শিক্ষার্থীরা একসাথে পড়াশোনা করত। দেখা গিয়েছে- এখানকার কোনো শিক্ষার্থী হয়তো তার শৈশব অতিবাহিত করেছে পাকিস্তানে, কেউ হয়তো বড় হয়েছে কোরিয়ায়, কারও শেকড় আবার আফ্রিকার কোনো দেশে। কেউ হয়তো ছোট থেকেই আমেরিকার আলো-বাতাসে বেড়ে উঠেছে, অভিবাসনের কোনো ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়নি তাকে। আমেরিকা যে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মিলনমেলা, সেটি সেই দেশের কোনো স্কুলের ক্লাসরুমে গেলেই খুব ভালোভাবে টের পাওয়া যাবে।
এই স্কুলেরই এক শিক্ষার্থী হে মিন লি। কোরিয়ায় বেড়ে উঠলেও একবুক স্বপ্ন নিয়ে তার পরিবারও এসেছিল আমেরিকায়, থিতু হয় মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোরে। উডলন হাই স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছিল তাকে। শুধু গতানুগতিক পড়াশোনার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেনি সে। স্কুলের হকি দলের নিয়মিত মুখ ছিল সে, পাশাপাশি স্কুলের রেসলিং দলের ম্যানেজারের ভূমিকাও পালন করত দক্ষ হাতে। তার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ হওয়ার। স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ হিসেবে একটি নামকরা চশমার দোকানে খণ্ডকালীন চাকরিও নিয়েছিল। তার আচার-আচরণ, মানুষের প্রতি তার ব্যবহার তাকে সবার কাছে প্রিয় করে তুলেছিল– এ কথা বলেছিলেন স্বয়ং তার স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
কিন্তু তার স্বপ্নগুলো পূর্ণতা পাওয়ার আগেই ঘটে গেল বেদনাবিধুর এক ঘটনা। ১৯৯৯ সালের ১৩ জানুয়ারি যে নিশান গাড়িতে করে হে মিন লি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, সেটাই ছিল তার জীবিতাবস্থায় শেষবারের মতো বের হওয়া। প্রায় এক মাস নিখোঁজ থাকার পর লিকিন পার্ক নামের এক জায়গার মাটির নিচ থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। শুরুতে তার মৃত্যুর যথাযথ কারণ পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে তাকে যে হত্যা করা হয়েছে- এই ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত ছিলেন। পরবর্তীতে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
হে মিন লি হত্যাকান্ডের পর স্থানীয় পুলিশের সামনে প্রধান যে চ্যালেঞ্জ আসে, সেটি হচ্ছে প্রকৃত খুনীকে শনাক্ত করে তাকে আইনের অধীনে নিয়ে আসা। হে মিন লি-র ব্যক্তিগত ডায়েরি এবং তার বন্ধুদের মুখ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী প্রথমেই তার প্রাক্তন প্রেমিক আদনান সাইদের দিকে নজর যায়। পুলিশ কল রেকর্ড ও সেলফোন লোকেশন ট্র্যাকিংয়ের পরিপ্রেক্ষিতে মৃতদেহ উদ্ধারের কয়েকদিন পরই তাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগে তার উপর নজরদারি চালানো হচ্ছিল। বলে রাখা ভালো, সাইদ ছিল লির স্কুলেরই একজন শিক্ষার্থী ও তার প্রেমিক। পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারে, এই হত্যাকান্ডের কিছুদিন আগেই সাইদের সাথে হে মিন লির সম্পর্কের অবনতি হচ্ছিল। এর কারণ ছিল দুজনের ভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও পারিবারিক অসম্মতি। তারা এটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে- ভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির কারণে তারা কখনই কোনো স্থায়ী সম্পর্কে জড়াতে পারবে না, এবং জড়াতে গেলেও প্রধান বাধা আসবে পরিবার থেকে, যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে। কিছুদিন পর হে মিন লি নতুন করে ডন ক্লাইনডিনস্ট নামের আরেকজন ব্যক্তির সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, যেটি তাদের সম্পর্কের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়।
বিচার শুরুর পর স্বাক্ষ্য হিসেবে হাজির করা হয় হে মিন লির ব্যক্তিগত ডায়েরি এবং আদনান সাইদের দুই বন্ধুর জবানবন্দি। এছাড়া লির নিখোঁজের পর থেকে আদনান সাইদ ও বাকি দুই বন্ধুর কল রেকর্ড ও সেলফোন লোকেশন ট্র্যাকিং প্রযুক্তিও স্বাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বিচারে বার বার এদিকে প্রতি জোর দেয়া হয় যে, প্রেমিক আদনান সাইদ তাদের বিচ্ছেদ ও বিচ্ছেদ-পরবর্তী সময়ে হে মিন লির নতুন সম্পর্কে জড়ানোর বিষয়গুলোকে কখনোই সমর্থন করতে পারেননি। বিশেষ করে নতুন সম্পর্কে জড়ানোর বিষয়টি সাইদকে মানসিকভাবে এত বেশি আহত করে যে, তিনি এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই লিকে হত্যা করেন। সাইদের পরিবার নামকরা আইনজীবী মারিয়া ক্রিস্টিনা গুতিয়েরেজকে মামলার লড়াইয়ের জন্য নিয়োগ করে। কিন্তু আদালতে যুক্তিতর্কের সময় মারিয়ার সাথে বিচারকদের তুমুল বাকবিতন্ডা শুরু হয়, এমনকি একপর্যায়ে বিচারক তাকে ‘মিথ্যাবাদী’ হিসেবেও আখ্যায়িত করে।
প্রায় এক বছর বিচার চলার পর ২০০০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আদনান সাইদকে হত্যা, অপহরণ, ডাকাতি ও বেআইনিভাবে আটকে রাখার অভিযোগে দায়ে অতিরিক্ত ত্রিশ বছর কারাদন্ডের পাশাপাশি যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করে। পুরো সময় আদনান সাইদ আদালতের সামনে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন। তার আইনজীবী চার্লস ডোর্সে (যিনি মারিয়া ক্রিস্টিনা গুতিয়েরেজকে প্রতিস্থাপন করেছিলেন) আদালতের সামনে শাস্তি কমানোর দাবি জানান, কিন্তু আদালত তার সেই দাবি নাকচ করে দেন।
আদনান সাইদের পরিবার বুঝতে পেরেছিল, এই বিচারে ঠিকমতো সবকিছু বিবেচনা করা হয়নি। কিন্তু আদালতের রায় চ্যালেঞ্জ করার জন্য তাদের সামনে আইনগত কোনো রাস্তা খোলা ছিল না। সাইদের বান্ধবী ও আইনজীবী রাবিয়া চৌধুরি এই মামলা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য বাল্টিমোরের সাংবাদিক সারাহ কোনিগকে ই-মেইল করেন, যাতে সেই সাংবাদিক এই কেস পুনরায় তদন্ত করে মামলার অসঙ্গতি বের করে আনতে পারেন। ২০১৪ সালে বিখ্যাত সিরিয়াল পডকাস্টে সাইদের কেস উপস্থাপন করেন সাংবাদিক কোনিগ। উপস্থাপনের পূর্বে তিনি এই কেসের আইনগত বিষয়গুলো ব্যক্তিগতভাবে যাচাই করেন। যাচাইয়ের সময় বেরিয়ে আসে, বিচারকেরা এই কেসের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই রায় ঘোষণা করে ফেলেছেন। সাইদের কেস নিয়ে করা এই পডকাস্ট বিপুল আলোড়ন তৈরি করে।
বিচারের অসঙ্গতি নিয়ে একটু কথা বলা যাক। কোনিগের তদন্তে বেরিয়ে আসে, এই মামলার অন্যতম প্রধান সাক্ষী জে উইল্ডস প্রথমে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে যেসব বিষয় বর্ণনা করেন, সেগুলো পরবর্তীতে পরিবর্তন করা হয়। যেমন- একবার জে উইল্ডস বলে, সে সেদিন ম্যাকডোনাল্ডসে খেতে গিয়েছিল, আরেকবার সে বলে যে সে আসলে বন্ধুর বাসায় গিয়েছিল। এমনকি কোনিগ পরিষ্কারভাবে দেখান, জে উইল্ডসের স্বীকারোক্তির সময় অনেক অস্পষ্ট আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, এবং তিনি কথা বলার সময় আটকে যাচ্ছেন। এখান থেকে একটা বিষয় অনুমিত হয়, পুলিশ হয়তো চাপপ্রয়োগ করেই তার কাছে থেকে সেরকম বক্তব্য আদায় করে। এই পডকাস্টে অংশগ্রহণের জন্য হে মিন লি’র পরিবারের সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তবে তারা বলেছিলেন আদালতের রায়ে তারা ন্যায়বিচার পেয়েছেন, তাই এই পডকাস্টে মামলার অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলার প্রশ্নই আসে না।
২০১৯ সালে রাবিয়া চৌধুরী এইচবিওতে ‘দ্য কেইস অ্যাগেইন্সট আদনান সাইদ’ শিরোনামে ডকুমেন্টারি সিরিজ প্রকাশ করেন। সেখানে দেখানো হয়, মামলায় যে প্রমাণগুলো ছিল, সেগুলোতে প্রাপ্ত ডিএনএ-র সাথে আদনান সাইদের ডিএনএ-র কোন মিল নেই। এছাড়াও এই সিরিজে দাবি করা হয়, মার্কিন সমাজে প্রোথিত মুসলিমদের প্রতি জাতিগত বিদ্বেষের কারণে সাইদ পুনরায় বিচারে অংশগ্রহণের অধিকার পাচ্ছেন না।
সম্প্রতি মেরিল্যান্ডে একটি নতুন একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, যে আইনের বলে বিশ বছর বা তার বেশি সময় ধরে কারাবরণ করা ব্যক্তিরা তাদের শাস্তির রায় আদালতের মাধ্যমে পুনর্বিবেচনা করাতে পারবেন। মূলত এই আইনের মাধ্যমেই সাইদের আইনজীবীরা তার শাস্তির আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাল্টিমোর শহরের স্টেট অ্যাটর্নির অফিস এই মামলার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে শুরু করে। সেখানে তারা প্রমাণের ভিত্তিতে আরও দুজন সন্দেহভাজন ব্যক্তির উপস্থিতি শনাক্ত করে এবং সাইদকে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ ব্যতিরেকেই যে আদালতে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সেই বিষয়ে জানতে পারে। এরপরই বাল্টিমোর সার্কিট জাজ মেলিসা ফিন তাকে শাস্তিভোগের আদেশ থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন। তাকে পরিবারের সাথে থাকার অনুমতি দেয়া হয়, তবে সার্বক্ষণিক জিপিএস মনিটরিংয়ের আওতায় থাকতে হবে তাকে। এখন আমেরিকার আইনানুযায়ী, ত্রিশ দিনের মধ্যে নতুন বিচার শুরু করতে হবে, নয়তো তাকে এই মামলা থেকে নিঃশর্ত অব্যাহতি দেয়া হবে। নতুন বিচার শুরু হলেও সাইদের মুক্তি পাওয়ারই সম্ভাবনা বেশি, যেহেতু সাম্প্রতিক সাক্ষ্যপ্রমাণে তার নির্দোষিতা প্রমাণিত হয়েছে বেশ কয়েকবার।
আদনান সাইদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে সিরিয়াল পডকাস্ট। মূলত এই পডকাস্টের মাধ্যমেই এই মামলা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারে সবাই। শুধু তা-ই নয়, এই মামলার অসঙ্গতিগুলো সম্পর্কেও মানুষ ধারণা লাভ করে। রাবিয়া চৌধুরীর কথাও বলতে হয়, যিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গিয়েছেন এই কেসে সাইদকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য।