মাঝে মাঝেই পত্রপত্রিকা ও অনলাইনে ফটোগ্রাফারদের বিভিন্ন ধরনের ছবি দেখে আমরা বিস্মিত হই, মুখ থেকে আপনাআপনিই বের হয়ে যায়, “এত চমৎকার ছবিও তোলা সম্ভব!” একটি ছবি যে হাজার শব্দের চেয়েও বেশি শক্তিশালী- সেই বিষয়টি আবারও আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই ছবিগুলো।
আজকের লেখায় আমরা এমন কিছু ছবিই দেখবো, যেগুলো তুলতে গিয়ে আর একটু হলেই প্রাণ যাচ্ছিলো এগুলোর ফটোগ্রাফারদের!
১
বাঘ-সিংহের মতো হিংস্র প্রাণী ডাঙায় খুব কমই আছে। তাই এদের সামনে পড়তে চাইবে না সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষই। কিন্তু ছবি তুলতে গিয়ে আর একটু হলেই সিংহের হাতে সাধের প্রাণটা খোয়াতে যাচ্ছিলেন পাকিস্তানের ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার আতিফ সাঈদ।
ঘটনাটি ঘটেছিলো পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোরে, যা একইসাথে করাচির পর দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল শহরও বটে। সেখানেই বন্যপ্রাণীদের জন্য সংরক্ষিত একটি পার্কে ভয়াবহ এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হন সাঈদ। গাড়িতে চড়ে পার্কটি ঘুরে দেখছিলেন তিনি। হঠাৎ করে এই সিংহটি দেখে তার মনে ধরে যায়। তাই আস্তে করে এর পাশে গিয়ে গাড়িটি থামিয়ে চুপচাপ নেমে পড়েন। এরপরই ভয়ঙ্কর এই প্রাণীটির ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি।
সাঈদ ও সিংহটির মাঝে দূরত্ব ছিলো মাত্র ফুট দশেকের মতো। অন্যের ছবির মডেল হতে বোধহয় একবারেই ভালো লাগেনি সিংহটির। আর তাই সে টের পাওয়ামাত্রই সাঈদের দিকে তেড়ে যায়।
বিষয়টি বুঝতে পেরে সাঈদও আর দেরি করেননি, ছুট লাগান তার গাড়ির দিকে। ভাগ্য সহায় ছিলো তার। কারণ তিনিও আগে থেকেই হয়তো আশঙ্কায় করেছিলেন সিংহটির আক্রমণের ব্যাপারে। তাই গাড়ির দরজা খোলা রেখেই এসেছিলেন। লাফ দিয়ে গাড়িতে ঢোকার ঠিক আগমুহূর্তে ‘ভয়ংকর সুন্দর’ এই ছবিটি তুলে নেন তিনি। শিকারের উপর সিংহের ঝাঁপিয়ে পড়বার এমন রাগত মুখের ছবি সেই সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বেশ ছড়িয়ে পড়েছিলো।
একবার জীবন নিয়ে ফিরে এসে অবশ্য খুব শিক্ষা হয়ে গেছে আতিফ সাঈদের। দ্বিতীয় আর কখনোই এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার ইচ্ছা নেই তার।
২
এখন যে ছবিটির কথা বলা হবে, সেটি মধ্যপ্রাচ্যের, সিরিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধ সম্পর্কিত, যা তুলেছিলেন ট্রেসি শেলটন নামক এক ফটোগ্রাফার।
২০১২ সালের কথা। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহের জন্য শেলটন তখন কাজ করছিলেন দেশটিতে। ছবিটি তোলার সময় তার জায়গায় হামলা চালিয়েছিলো সিরিয়ান আরব আর্মির (এসএএ) একটি ট্যাঙ্ক। সিরিয়ান সরকারের অফিসিয়াল আর্মিই হলো এসএএ। তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (এফএসএ), যারা সংগ্রাম করে যাচ্ছে সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের পদ থেকে বাশার আল আসাদকে অপসারণের জন্য।
এই ছবিতে যে বিদ্রোহীদের দেখা যাচ্ছে তারা নূর দীন আল-জেঙ্কি ব্যাটালিয়নের। ট্যাঙ্ক হামলার আগে শেলটন তাদের সাথেই ছিলেন। বিদ্রোহীরা তখন তাদের জায়গা পরিষ্কারে ব্যস্ত ছিলো। তখন তোলা কিছু ছবিতে তাদেরকে একে অপরের সাথে হাসি-ঠাট্টায় লিপ্ত থাকতেও দেখা গেছে।
হঠাৎ করেই বিদ্রোহীদের কাছে খবর আসে যে, তাদের এলাকায় একটি এসএএ ট্যাঙ্ক প্রবেশ করেছে। খবর পাওয়ামাত্র তারা নিজেদের অস্ত্রশস্ত্রের দিকে ছুটে যায়। যখন ট্যাঙ্কটি হামলা চালায়, তখন বিদ্রোহীরাও এর মোকাবেলার চেষ্টা করছিলো। ট্যাঙ্কের গোলা বিদ্রোহীদের আঘাত হানার মুহূর্তেই ক্যামেরায় ক্লিক পড়ে যায় শেলটনের। সেখানে তখন সামনের সারিতে তিনজন এবং পেছনে আরো এক বিদ্রোহী যুদ্ধরত অবস্থায় ছিলেন। সর্বশেষজনের পেছনেই ছিল শেলটনের অবস্থান।
অকস্মাৎ এই হামলায় অবশ্য শেষপর্যন্ত কুলিয়ে উঠতে পারেনি বিদ্রোহীরা। সামনের তিনজন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। পেছনেরজন আহত হয়ে সেবারের মতো প্রাণে বেঁচে যায়। শেলটনের জীবনও রক্ষা পায়, তবে ধূলোবালিতে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিছুক্ষণের মাঝেই নতুন যোদ্ধারা এসে তাদের সঙ্গীদের লাশগুলো সরিয়ে নিয়ে যায়, আবারও শুরু হয় গোলাগুলি।
৩
বিশ্বজুড়ে ব্ল্যাক মাম্বা পরিচিত এদের দীর্ঘ আকার, ক্ষীপ্রতা এবং ভয়াবহ বিষের জন্য। সাব-সাহারান আফ্রিকায় দেখতে পাওয়া এ সাপটি মহাদেশটির অন্যতম ভয়াবহ এক সাপ। এদের দৈর্ঘ্য সাড়ে ৬ ফুট থেকে ৮ ফুট, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ১৪ ফুট পর্যন্তও হতে পারে।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, অত্যন্ত বিষধর এ সাপটি স্বভাবে লাজুক ধরনের। বিপদে পড়লে সে দ্রুতগতিতে পালিয়ে যেতে চাইবে। কিন্তু যদি সে একেবারেই কোনঠাসা হয়ে যায়, তখনই কেবল বিষের সদ্ব্যবহার করে থাকে, ছোবলের পর ছোবল দিতে থাকে তার উপর আক্রমণকারীকে। সাপটির মাত্র দু’ফোটা বিষই একজন মানুষকে শেষ করে দিতে যথেষ্ট। বিষ একইসাথে স্নায়ুতন্ত্র ও হৃদযন্ত্রে আক্রমণ করে।
এখন যে ফটোগ্রাফারের ঘটনা উল্লেখ করা হবে, তা মূলত এই ব্ল্যাক মাম্বাকে ঘিরে বলেই শুরুতে সাপটি নিয়ে কিছু জানিয়ে রাখা হলো। খুব কম সংখ্যক মানুষই ব্ল্যাক মাম্বার ছোবল খেয়ে আবার পৃথিবীর আলো-বাতাসে ফেরার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। ফটোগ্রাফার মার্ক লেইটা তাদের একজন। ২০১২ সালে তিনি এ ঘটনার সম্মুখীন হন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সাপটি যখন তাকে ছোবল দেয়, ঠিক সেই মুহুর্তটিই তিনি ক্যামেরায় ধারণ করে রাখতে সক্ষম হন।
সেসময় লেইটা সাপদের নিয়ে একটি বই লিখছিলেন। এ কাজেই মধ্য আমেরিকার একজন সাপ সংগ্রাহকের সংগ্রহশালা দেখতে গিয়েছিলেন তিনি, তুলছিলেন বিভিন্ন ছবি। সেই ভদ্রলোক অন্যান্য সাপের বিষথলি অপসারণ করলেও ব্ল্যাক মাম্বারটা করেননি।
এই ছবি তোলা চলাকালেই সম্ভবত লেইটার কোনো কাজে ভয় পেয়ে সাপটি তাকে আক্রমণ করে বসে, ছোবল দেয় পায়ে। ভালোই রক্তক্ষরণ হয় তার, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কোনো চিকিৎসা ছাড়াই বেঁচে যান তিনি। লেইটার ধারণামতে, সাপটি সম্ভবত কোনো বিষ ত্যাগ করেনি। কিংবা করলেও রক্তক্ষরণের সাথে সেটা বেরিয়ে গিয়েছিল। লেইটা অবশ্য নিজেও জানতেন না যে, সেই মুহুর্তের ছবি তুলে ফেলেছেন তিনি। রাতের বেলা ক্যামেরা ঘাটাতে গিয়েই বিষয়টি নজরে আসে তার।
৪
আবারও আতিফ সাঈদের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। তবে এবার সিংহের জায়গায় এসেছিলো এক টনের একটি বাইসন।
ঘটনাটি ঘটেছিল ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার উইলিস চাংয়ের সাথে। ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কে বন্যপ্রাণীদের ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিলেন চাং। হঠাৎ কী হলো কে জানে, বিশালাকৃতির বাইসনটি চাংয়ের দিকে তেড়ে আসতে শুরু করে। শুরুতে বিষয়টিকে তেমন পাত্তা না দিয়ে তেড়ে আসা বাইসনেরই ছবি তুলতে থাকেন চাং। কিন্তু একসময় প্রাণীটি অতিরিক্ত নিকটবর্তী হয়ে গেলে ট্রাইপডে ক্যামেরা রেখেই জীবন নিয়ে দৌড়ে পালান চাং। ক্যামেরার কাছে এসেই অবশ্য থেমে যায় প্রাণীটি। সামনে-পেছনে ঘুরে ঘুরে অদ্ভুতদর্শন এ যন্ত্রটি দেখতে থাকে।
অবশ্য চাংও থেমে থাকেননি। নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে কৌতূহলী বাইসনটির আরো চমৎকার সব ছবি তুলতে থাকেন তিনি।
৫
এবারের ঘটনাস্থল রুয়ান্ডা। ভলকানোস ন্যাশনাল পার্কে একদল গরিলার ছবি তুলছিলেন ফটোগ্রাফার ক্রিস্টোফ করট্যু। এমন সময়ই আর একটু হলেই একটি গরিলার ঘুষি খেতে যাচ্ছিলেন তিনি। সেদিন অবশ করট্যু একা ছিলেন না। আরো কয়েকজন নিয়েই একদল গরিলার ছবি তুলছিলেন তারা। হঠাৎ করেই করট্যুর দিকে তেড়ে আসে গরিলাদের দলনেতা। আকারেভ্যুরো নামক সেই গরিলাটির ওজন ছিলো প্রায় ২৫০ কেজি।
গরিলাটি তেড়ে আসলেও থেমে যাননি করট্যু। এমনকি প্রাণীটি তার সামনে এসে থামার আগপর্যন্তই তিনি ছবি তুলে গেছেন। ছবি দেখে মনে হবে, আকারেভ্যুরো বুঝি করট্যুকে মুষ্টিবদ্ধ হাতে সজোরে ঘুষি মারতে যাচ্ছে। বাস্তবে অবশ্য তেমনটা হয়নি। বরং করট্যুকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে সে ফটোগ্রাফারদের পেছনে দাঁড়ানো দলের অন্য পুরুষ সদস্যের দিকে ছুটে যায়, যেটা সম্ভবত কোনো নারী গরিলাকে আকর্ষণের চেষ্টা করছিল।
করট্যু তেমন একটা আঘাত পাননি। কেবল মাথার ওখানে একটু কেটে গিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে গরিলাগুলো তাদের আশেপাশে মানুষের উপস্থিতির সাথে ঠিক মানিয়ে নিতে পারছিলো না। তাই তারা তাদের পেছন পেছন ফটোগ্রাফারদের অনুসরণ করাটাও পছন্দ করছিলো না। বিশেষ করে দলের সুরক্ষার্থে দলপতি একটু পরপরই ফটোগ্রাফারদের দিকে ছুটে যাচ্ছিলো। তবে খুব কাছে গিয়েই আবার ফিরে আসছিলো সে, কারো ক্ষতি করছিলো না।
৬
এবার চলুন নেলসন ম্যান্ডেলা, হার্শেল গিবস, এলন মাস্কদের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ঘুরে আসা যাক। ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কে সেদিন বন্যপ্রাণীদের ছবি তুলছিলেন জোনাথন প্লেজার। হুট করেই তার দিকে ছুটে আসতে থাকে এই গন্ডারটি।
তবে আজকের তালিকায় উল্লেখ করা অন্য ব্যক্তিদের মতো প্লেজার আগে থেকে তার আশেপাশে গন্ডারটির উপস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। পাশের ঝোপে নড়াচড়ার শব্দ শুনেই তিনি বিষয়টি টের পান। ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে গন্ডারটি তার দিকে তেড়ে আসতে থাকে। প্লেজারও হাল ছাড়ার পাত্র নন। পালিয়ে না গিয়ে তিনিও প্রাণীটির ছবি তুলে যেতে লাগলেন। হুট করে গন্ডারটিরই আবার কী হলো কে জানে। সে দিক পরিবর্তন করে বামদিকে ঝোপের আড়ালে হারিয়ে গেলো, আর প্লেজারও প্রাণে রক্ষা পেলেন।