প্রযুক্তির ছোঁয়া বাদ যাচ্ছে না কোনো ক্ষেত্রেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতি এখন চোখে পড়ার মতো এবং পিছিয়ে নেই কৃত্রিমতার অন্যান্য খাতগুলোও। আমেরিকান ফাস্টফুড কোম্পানি কেএফসি লেগে পড়েছে কৃত্রিম মাংস তৈরি করতে। গত ১৬ জুলাই তারা ঘোষণা করে থ্রিডি বায়োপ্রিন্টিং প্রযুক্তির মাধ্যমে এ বছরের শেষ নাগাদ তারা কৃত্রিম মাংসের তৈরি তাদের বিখ্যাত চিকেন নাগেট পরীক্ষামূলকভাবে রেস্টুরেন্টগুলোতে আনবে। এ নিয়ে যেমন তৈরি হয়েছে নানা বিতর্ক, তেমন একে সাধুবাদ জানিয়েছেন অনেকেই। চলুন জেনে আসি নতুন প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি এই খাবারের ইতিবাচক, নেতিবাচক ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাগুলো নিয়ে।
থ্রিডি বায়োপ্রিন্টিং কী ও কীভাবে কাজ করে?
প্রচলিত থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মতো করেই বায়োপ্রিন্টিং কাজ করে। বায়োপ্রিন্টিং নিয়ে বলার আগে থ্রিডি প্রিন্টিং নিয়ে কিছু বলা যাক। সব প্রিন্টিং প্রযুক্তির ধারণাই মোটামুটি কাছাকাছি। সাধারণ প্রিন্টিংয়ের ক্ষেত্রে আমরা কোনো লেখা বা ছবি প্রিন্ট করার আগে সেটির একটি ডিজিটাল কপি তৈরি করে নেই, থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের ক্ষেত্রেও একই। প্রথমে একটি ডিজিটাল ফাইল বা মডেল তৈরি করা হয়, এরপর সেটি প্রিন্টারে পাঠানো হয় সাধারণ নিয়মেই।
আসল কারসাজি করে প্রিন্টার এবং প্রিন্টিং ম্যাটেরিয়াল। কালি, টোনার এগুলো সাধারণ প্রিন্টারের প্রিন্টিং ম্যাটেরিয়াল। থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর মাঝে রয়েছে ABS Plastic, PLA, Nylon, Epoxy resin, Silver, Steel, Wax, polycarbonate ইত্যাদি। সাধারণত কোনো কিছু উৎপাদনের ক্ষেত্রে থ্রিডি প্রিন্টিংয়ে খরচ তুলনামূলক কম হয়, যার ফলে এটি দিন দিন জনপ্রিয়তা লাভ করছে। এই প্রযুক্তির রয়েছে অসংখ্য সম্ভাবনা। এর মাঝে আসবাবপত্র থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক ও দাতব্য পণ্যের মক-আপসহ রয়েছে নানা কিছু।
বায়োপ্রিন্টিংয়ের ক্ষেত্রে প্রিন্টিং ম্যাটেরিয়াল হিসেবে বিভিন্ন প্রকারের জৈবিক অংশ, যেমন- কোষ, গ্রোথ ফ্যাক্টর (হরমোন, প্রোটিন) ইত্যাদি ব্যবহার করে টিস্যু তৈরি করা হয়। থ্রিডি প্রিন্টিং করার জন্য কোনো ফাইলকে স্লাইসার নামক সফটওয়্যার দিয়ে হাজার হাজার লেয়ারে ভাগ করা হয় এবং এরপর সেটি প্রিন্টারে পাঠানো হয়। কিছু থ্রিডি প্রিন্টারে স্লাইসার বিল্ট-ইন থাকে। বায়োপ্রিন্টিংয়ে যে ম্যাটেরিয়াল দিয়ে এই স্লাইসিং করা হয়, তাকে বায়োইঙ্ক (Bioinks) বলে। এটিই বাস্তব টিস্যুকে অনুকরণ করে কৃত্রিম টিস্যু তৈরি করে। এছাড়া বাস্তব জীবিত কোষের মিশ্রণ দিয়েও প্রিন্টিং করা হয়ে থাকে। যেহেতু বায়োপ্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে জীবিত কোষ তৈরি করা সম্ভব, সেজন্য প্রিন্টিংয়ে কিছু দিকে খেয়াল রাখতে হয়, যেমন- প্রতিটি কোষ থেকে একে অপরের দূরত্ব, সঠিক কোষ কাঠামো এবং বাহ্যিক যেকোনো কিছুর সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা। এই প্রক্রিয়াকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়:
১) প্রি-বায়োপ্রিন্টিং: এ পর্যায়ে পদার্থটির একটি ডিজিটাল মডেল তৈরি করা হয়। সিটি স্ক্যান ও এমআরআই-এর মাধ্যমে ডিজিটাল মডেল তৈরির তথ্যাদি নেয়া হয়।
২) বায়োপ্রিন্টিং: এটি মূল প্রিন্টিং প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে বায়োইঙ্ক এবং অন্যান্য যাবতীয় ম্যাটেরিয়াল প্রিন্টারে দেয়া হয় এবং ডিজিটাল মডেলের ভিত্তিতে প্রিন্টিং প্রসেস শুরু হয়।
৩) পোস্ট-বায়োপ্রিন্টিং: তৈরিকৃত পদার্থের স্থিতিশীলতা, রাসায়নিক ও জৈবিক কাজকর্ম সফলভাবে হচ্ছে কি না এটা পর্যালোচনা করা হয়।
থ্রিডি বায়োপ্রিন্টিংয়ের ক্ষেত্র প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কেএফসির এই উদ্যোগ এরই এক উদাহরণ। এছাড়া বাড়ছে কৃত্রিম অঙ্গের ব্যবহার, যা চিকিৎসাবিজ্ঞানে বড় এক পাওয়া। বিভিন্ন ওষুধ কিংবা ভ্যাক্সিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য কৃত্রিম টিস্যু ব্যবহার করা হয় যা তুলনামূলক সাশ্রয়ী এবং অধিকতর নৈতিক। প্লাস্টিক সার্জারি, দাতব্য চিকিৎসায়ও বায়োপ্রিন্টিং ব্যবহার করা হচ্ছে।
কেএফসির ‘Meat of the Future’
১৬ জুলাই কেএফসি এক প্রেস রিলিজে ঘোষণা করে, তারা থ্রিডি বায়োপ্রিন্টিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের বিখ্যাত চিকেন নাগেট তৈরি করবে। এজন্য রাশিয়ার মস্কোতে অবস্থিত ‘3D Bioprinting Solutions’ নামে এক রিসার্চ ল্যাবের সাথে চুক্তি করেছে তারা।
প্রতিবছর বিভিন্ন প্রকারের খাদ্যের জন্য প্রায় ৫০ বিলিয়ন মুরগি জবাই করা হয়। এছাড়া গবাদি পশু পালনের সর্বমোট যে প্রভাব প্রকৃতিতে পড়ে খানিকটা ভীতিকরই। এর মাঝে রয়েছে গ্রিন হাউজ ইফেক্ট, বৃক্ষনিধন ইত্যাদি। ব্রাজিলে গত ৫০ বছরে গবাদি পশুর সংখ্যা চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে অ্যামাজন রেইনফরেস্টের নানা অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কিন্তু মাংসের চাহিদা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে এবং পরিবেশ ও খরচের কথা চিন্তা করে বৃহৎ রেস্টুরেন্ট মালিকরা বিকল্প পথ খুঁজছেন।
কেএফসি রাশিয়ার জেনারেল ম্যানেজার রাইসা পলিয়াকোভা বলেন,
খাবার তৈরিতে আমাদের থ্রিডি বায়োপ্রিন্টিং প্রযুক্তির ব্যবহার আসন্ন পৃথিবীর বেশ কয়েকটি সমস্যার সমাধান করতে সাহায্য করবে। আমরা এই প্রযুক্তির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পেরে খুশি এবং এ বছরের শেষের মাঝেই রাশিয়া ও সারাবিশ্বের মানুষের কাছে নতুন তৈরি এই পণ্যগুলো আমরা নিয়ে আসবো।
এছাড়া থ্রিডি বায়োপ্রিন্টিং সল্যুশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইউসুফ খেসুয়ানি বলেন,
থ্রিডি বায়োপ্রিন্টিং প্রযুক্তি ইতোমধ্যেই চিকিৎসা, ওষুধখাতে ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং খাবার তৈরিতে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তির প্রসার ঘটলে আমরা আরও থ্রিডি প্রিন্টেড খাবার দেখতে পারবো এবং কেএফসির এই উদ্যোগ খাতটিকে আরও অগ্রগতি লাভ করাতে সাহায্য করবে।
আমেরিকান এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি জার্নালে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, কোষ থেকে তৈরিকৃত মাংস প্রকৃতির উপর কম নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে ৪৫ শতাংশ কম শক্তি খরচ হবে, গ্রিন হাউজ গ্যাসের প্রভাব কমবে এবং জমির ব্যবহার কমবে প্রায় ১০০ গুন।
কৃত্রিম মাংসের তৈরি নাগেটের স্বাদ কেমন হবে? স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে কি?
ল্যাবরেটরিটি জানিয়েছে, বিশ্বে প্রথম তাদের তৈরি এই চিকেন নাগেটের স্বাদ এবং চেহারা বাস্তবের মতোই হবে। যেহেতু মুরগির কোষের মিশ্রণেই এটি তৈরি করা হচ্ছে, তাই আশা রাখা হচ্ছে বাস্তবের থেকে এর খুব একটা ভিন্নতা হবে না। সাথে কেএফসির রেসিপি তো থাকছেই।
কৃত্রিম মাংসের কথা শুনে অনেকের মনেই স্বাস্থ্যঝুঁকির ব্যাপারটি এসেছে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে মানুষের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। কিন্তু এটি কি আসলেই ঝুঁকিপূর্ণ? না। থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের ফলে খাবারের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। অতিরিক্ত তেল বা চর্বি আলাদা করে একদম সতেজ মাংস তৈরি করা সম্ভব। এছাড়া খাদ্যের সাথে আরও উপাদেয় বস্তু যোগ করে এর গ্রহণযোগ্যতা আরও বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
সর্বোপরি, পরিবেশ এবং আমাদের মাংস-নির্ভরতার বিষয়টি বিবেচনা করে এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানানো যায়। ভবিষ্যতে এর পরিসর বৃদ্ধি পেলে শুধু কৃত্রিম মাংসই নয়, আরও বিচিত্র সব খাবারই পেতে পারি আমরা!