২০২১ সালের ১০-২১ মে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে নতুন এক সংঘর্ষ হয়, এবং এটি ফিলিস্তিনের উপর ইসরায়েলি আগ্রাসনের ও ফলশ্রুতিতে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের সবচেয়ে সাম্প্রতিক ঘটনা। এই সময়ে ইসরায়েলি নিরাপত্তারক্ষীরা জেরুজালেমে ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বলপ্রয়োগ করেছে, অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলের ওপর হামাসের রকেট নিক্ষেপের প্রত্যুত্তরে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী গাজা ভূখণ্ডের ওপর তীব্র বিমান হামলা চালিয়েছে এবং ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে আরব ও ইহুদি অধিবাসীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। ইসরায়েলি বিমান হামলার ফলে গাজায় কয়েক শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, অন্যদিকে হামাসের রকেট হামলায় ইসরায়েলে সেই তুলনায় খুবই অল্প কিছু মানুষ নিহত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক নানা প্রচারমাধ্যমে ফিলিস্তিনের উপর ইসরায়েলি নির্যাতন ও ফিলিস্তিনবাসীর প্রতিরোধের ঘটনাগুলো ব্যাপক প্রচারণা লাভ করেছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সংঘর্ষ চলাকালে কার্যত কোনো আঞ্চলিক রাষ্ট্র বা কোনো বৃহৎ শক্তি ফিলিস্তিনিদের কোনো কার্যকর সহায়তা করেনি। সাম্প্রতিক সংঘাত শুরু হওয়ার পর এই বিষয়ে রাশিয়ার মস্কোয় অবস্থিত রুশ গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রভাষক কামরান হাসানভ একটি সম্পাদকীয় লিখেছেন, যেটি রুশ অনলাইন পত্রিকা ‘ভেজগ্লিয়াদ’–এ (Vzglyad) প্রকাশিত হয়েছে। ১৪ মে প্রকাশিত নিবন্ধটির শিরোনাম ছিল, ‘ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানোর কেউ নেই’ (За Палестину некому вступиться, ‘জা পালিয়েস্তিনু নিয়েকোমু ভস্তুপিৎসিয়া’)।
সাম্প্রতিক ইসরায়েলি–ফিলিস্তিনি সংঘাতে আঞ্চলিক ও বৃহৎ শক্তিগুলো ভূমিকা এই সম্পাদকীয়টির মূল উপজীব্য। সংক্ষেপে এবং সহজ ভাষায় হাসানভ এই বিষয়ে তার মতামত তুলে ধরেছেন। এই নিবন্ধে উক্ত সম্পাদকীয়টি অনুবাদ করা হয়েছে এবং এরপর সম্পাদকীয়টি সম্পর্কে কিছু সংক্ষিপ্ত মন্তব্য সংযুক্ত করা হয়েছে।
ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানোর কেউ নেই
রমজান মাস ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে, এবং ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের মধ্যে দুই সপ্তাহ আগে যে নতুন লড়াই শুরু হয়েছ, সেটি অন্তহীন। প্রতি বছর শেষ রোজার দিনে মুসলিমরা আল-কুদস উদযাপন করে, যেটি ফিলিস্তিনিদের মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের দিন। দিবসটি এই বছর জেরুজালেম দিবসের সঙ্গে একই দিনে পড়েছে। [এই দিনে] ইহুদিরা অর্ধ শতাব্দী আগের ঘটনাবলি স্মরণ করে, যখন ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধের পর ইসরায়েল শহরটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল। শহরটি তিনটি বিশ্বধর্মের – ইহুদিধর্ম, খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম – প্রতিনিধিদের জন্য একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
এই লেখার সময়ে ফিলিস্তিনি ইসলামি আন্দোলন (হামাস) গাজা ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলের ওপর গোলাবর্ষণ [রকেট হামলা] অব্যাহত রেখেছে। ইসরায়েল হামাসের ঘাঁটিগুলোর ওপর বিমান হামলা চালিয়ে দৃঢ়ভাবে ও বলিষ্ঠভাবে এর জবাব দিচ্ছে। বোমাবর্ষণের ফলে কেবল মিলিট্যান্টরা নয়, বেসামরিক মানুষজনও নিহত হচ্ছে। সংঘাত চলাকালে ইতোমধ্যে ৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ২০০ জনের বেশি আহত হয়েছে।
প্রতিটি সংঘাতের সবসময় মৌলিক কারণ এবং উত্তেজনা শুরুর কারণ থাকে। জেরুজালেমের ক্ষেত্রে এই [উত্তেজনা শুরুর] কারণটি ছিল ইসরায়েলি আদালত কর্তৃক পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জাররাহ অঞ্চল থেকে বেশ কয়েকটি পরিবারকে উৎখাত করা এবং তাদের ঘরবাড়ি ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের কাছে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত। ফিলিস্তিনিরা অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এই অংশে বসবাস করছে।
পরবর্তী সপ্তাহ ছিল এলোমেলো। জেরুজালেম দিবস এবং আল-কুদস একই দিনে পড়ে, কারণ রমজানের শেষ দিন ১১ মে তারিখে পড়েছিল। ইহুদিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ইসরায়েলি পুলিশ মুসলিমদের টেম্পল মাউন্টে, তাদের পবিত্রস্থল আল-আকসা মসজিদে, চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে মোড় নেয়, যখন ফিলিস্তিনিরা ছত্রভঙ্গ হওয়ার পর ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করে, সেখানে গুলি চালায়, বুট পরিহিত অবস্থায় মিম্বারে আরোহণ করে এবং নামাজরত মুসল্লিদের জোরপূর্বক বহিষ্কার করে।
গাজা ভূখণ্ড এবং জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে প্রতিনিয়ত অস্থিতিশীলতার মৌলিক কারণ হচ্ছে ফিলিস্তিনি–ইসরায়েলি সংঘাতের অমীমাংসিত অবস্থা। একসময় ইসরায়েল ভূমধ্যসাগরের উপকূল বরাবর সংকীর্ণ সীমান্ত মেনে নিতে রাজি হয়েছিল, কিন্তু আরবরা ইসরায়েলের অস্তিত্বের ধারণাই প্রত্যাখ্যান করে। তিনটি আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধের (১৯৪৭-১৯৪৯, ১৯৬৭, ১৯৭৩) ফলে ইহুদি রাষ্ট্রটি কেবল স্বাধীনতাই অর্জন করেনি, বরং তারা ফিলিস্তিনের সিংহভাগ এবং মিসর ও সিরিয়ার কিছু ভূখণ্ড (সিনাই উপদ্বীপ ও গোলান মালভূমি) অধিকার করে নেয়। ফিলিস্তিন যে কখনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি, এই বাস্তবতার জন্য আরব দেশগুলো নিজেরাই দায়ী। উদাহরণস্বরূপ, জর্দান ফিলিস্তিনকে নিজস্ব ভূখণ্ডের একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করত।
এই দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতকে কেবল ইহুদি ও আরবদের মধ্যেকার সংঘাত হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। ইসলামি বিশ্বের নেতা সৌদি আরব ইসরায়েলকে নয়, বরং শিয়া ইরানকে হুমকি হিসেবে দেখে। এজন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান ব্যতীতই সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে এক অঘোষিত মৈত্রীতে আবদ্ধ।
অন্য আরব রাষ্ট্রগুলো খুবই নিষ্ক্রিয় আচরণ করছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত সৌদি আরবের সঙ্গে মিলে ‘ইরানি হুমকি’ নিয়ে ব্যস্ত। বাহরাইন, মরক্কো এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ইতোমধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে। কয়েক দশক আগে জর্দান ও মিসর তেল আবিবের সঙ্গে অনুরূপ শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। মিসর এটা করেছে সিনাই ফিরে পাওয়ার বিনিময়ে। সিরিয়াও এখন দুর্বল, আর তার গোলান মালভূমি ইসরায়েলের দখলে। কাতার খুবই ছোট এবং নিজেই কিছুদিন আগপর্যন্ত তার আরব ‘বন্ধু’দের চাপে ছিল।
অন্যান্য প্রভাবশালী খেলোয়াড়রা হয় নিষ্ক্রিয় ও নিরপেক্ষ, নয়তো ইসরায়েলকে সমর্থন করে। হোয়াইট হাউজের পূর্ববর্তী কর্তার [ডোনাল্ড ট্রাম্প] অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি অবস্থান নিয়েছিল যেটি শান্তি আলোচনার মূলভাবকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র জেরুজালেমে তাদের দূতাবাস স্থানান্তর করেছে ও আরব পূর্ব জেরুজালেমসহ শহরটিকে পুরোপুরি ইসরায়েলের বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। ডেমোক্র্যাট জোসেফ বাইডেন বেশি সতর্ক, কিন্তু তার পক্ষে এই পথ ছেড়ে আসা যদি অসম্ভব না-ও হয়, কঠিন হবে। রাশিয়ার মতো ইউরোপীয় ইউনিয়ন জেরুজালেমকে পূর্ব ও পশ্চিম ভাগে বিভক্ত করার নীতি সমর্থন করে এবং ‘দুই রাষ্ট্র’ নীতির পক্ষেও বলে, কিন্তু ইসরায়েলের ওপর সত্যিকার চাপ প্রয়োগের মতো ক্ষমতা ইউরোপীয়দের নেই। ইইউ-এর নেতা হিসেবে জার্মানির ইসরায়েলের প্রতি ঐতিহাসিক দায়িত্ব রয়েছে এবং তারা এমনকি শান্তি ও ন্যায়বিচারের নামেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যেতে লজ্জাবোধ করে। ব্রিটেন এবং ফ্রান্স বহুলাংশে ইসরায়েলপন্থী।
এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে ইরান ও তুরস্ক সত্যিকারভাবে ফিলিস্তিনের জন্য রুখে দাঁড়াতে পারে। আল-কুদস দিবসের প্রচলনই করেছিলেন আয়াতুল্লাহ খোমেইনি ১৯৭৯ সালে। বর্তমান আধ্যাত্মিক নেতা আলী খামেনেইও সুযোগ পেলেই [ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলি] ‘দখলদারিত্ব শেষ করা’র প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেন। কিন্তু ইরান বিচ্ছিন্ন এবং ইসরায়েলের আচরণ পরিবর্তন করানোর ক্ষমতা তাদের নেই। তেহরান নিজেই সম্প্রতি ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার আক্রমণের ভুক্তভোগী হয়েছে, যে ঘটনায় নাতাঞ্জ পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটে।
তুরস্ক সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অধিকতর শক্তিশালী। রেজেপ এরদোয়ানের শাসনকালের শুরু থেকেই তিনি ফিলিস্তিনিদের সহায়তা করছেন। ২০০৯ সালে ডাভোস ফোরামে তিনি প্রাক্তন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী শিমন পেরেজের সঙ্গে জনসম্মুখে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং মন্তব্য করেছিলেন, সে যে সুরে কথা বলে সেটি দোষী ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের লক্ষণ। এরদোয়ান সেসময় প্রতিবাদ করেছিলেন যে, ‘তোমাদের এমন প্রধানমন্ত্রী ছিল যারা ঘোষণা করেছিল, ঘোড়ার পিঠে চড়ে ফিলিস্তিনে প্রবেশের সময় তারা কতটা সুখী অনুভব করে।’ পরবর্তী বছর তুরস্ক গাজার তীরে ফ্রিডম ফ্লোটিলা প্রেরণ করে, যেটিতে বেশ কয়েকজন তুর্কি নাগরিক নিহত হয়। ২০১৮ সালে ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর এরদোয়ান প্রথম ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর একটি সামিট ডাকেন এবং এখন তিনিই প্রথম ফিলিস্তিনিদের সহায়তা করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে ইসরায়েলের নিন্দা করেছেন।
কিন্তু তুরস্ক একা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবে বলে মনে হয় না। ফ্রিডম ফ্লোটিলা প্রমাণ করেছে যে, বক্তব্য প্রদানই আঙ্কারার চাপ প্রয়োগের একমাত্র হাতিয়ার। এজন্য এটি কোনো কাকতালীয় বিষয় নয় যে সম্প্রতি রেজেপ এরদোয়ান ফিলিস্তিনে যৌথ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের জন্য রাশিয়ার কাছে প্রস্তাব করেছেন। মস্কো কি রাজি হবে? না বললেই চলে। কেবল ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের বিশেষ সম্পর্কের জন্যই নয়, এজন্যও যে রাশিয়া ইতোমধ্যেই ট্রান্সনিস্ত্রিয়া ও দক্ষিণ ওসেতিয়া থেকে সিরিয়া ও নাগর্নো-কারাবাখ পর্যন্ত বিদেশে বহুসংখ্যক শান্তিরক্ষা ও সামরিক অভিযানে লিপ্ত রয়েছে।
ফিলিস্তিন কার্যত একা। হামাস যদি ইসরায়েলের ওপর গোলাবর্ষণ বন্ধ না করে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী সম্ভবত গাজায় আরেকটি স্থল অভিযান চালাবে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র জোনাথান কনরিকাস ১৩ মে বলেছেন, ইসরায়েল ইতোমধ্যেই একটি স্থল অভিযানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করেছে। এখন বড়জোর এটা আশা করা সম্ভব যে, উভয় পক্ষ পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে একটি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করবে। সংঘাতটির সমাধান বহু, বহু দূরে, এবং প্রতি বছরই এটিকে আরো কম বাস্তব বলে মনে হচ্ছে।
অনুবাদকের মন্তব্য
প্রথমত, ‘ভেজগ্লিয়াদ’ একটি রুশ অনলাইন পত্রিকা এবং এর মুখ্য সম্পাদক কনস্তান্তিন কন্দ্রাশিন। এটি মূলত স্বাধীন, কিন্তু এর বেশ কিছু লেখাকে রুশ সরকারপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পত্রিকার সম্পাদকীয়গুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এগুলোতে সাধারণত রুশ রাষ্ট্রের স্বার্থের ওপর জোর দেয়া হয়। সেদিক থেকে হাসানভের সম্পাদকীয়টি ব্যতিক্রমধর্মী, কারণ এই সম্পাদকীয়তে রুশ স্বার্থ রক্ষার ওপর জোর দেয়া হয়নি। এর মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে সাম্প্রতিক ফিলিস্তিনের উপর ইসরায়েলি আগ্রাসনে আঞ্চলিক ও বৃহৎ শক্তিসমূহের প্রতিক্রিয়া।
দ্বিতীয়ত, হাসানভ তার সম্পাদকীয়তে সাধারণভাবে ফিলিস্তিনপন্থী অবস্থান গ্রহণ করেছেন এবং সাম্প্রতিক সংঘাত শুরুর পেছনে ইসরায়েল কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহকে দায়ী করেছেন। একইসঙ্গে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব না থাকার জন্য তিনি আরব রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকাকেই প্রধানত দায়ী করেছেন। তার মতে, আরব রাষ্ট্রগুলো ভূমধ্যসাগরের তীরে একটি ক্ষুদ্র ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বও মেনে নিতে রাজি ছিল না, যার ফলে ইসরায়েল এখন অপেক্ষাকৃত বৃহৎ একটি ভূমি নিয়ন্ত্রণ করছে। অর্থাৎ, হাসানভ মনে করেন, ১৯৪৮ সালে আরবরা যদি ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে মেনে নিত, তাহলে হয়তো একই সময়ে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠিত হতো এবং বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।
কিন্তু হাসানভ এক্ষেত্রে একটি বিষয় উপেক্ষা করেছেন। ১৯৪৭ সালের জাতিসংঘ ফিলিস্তিনের বিভাজনের যে প্রস্তাব করেছিল, তাতে ৫৬% ভূমি ইহুদিদের প্রদান করা হয়েছিল, যদিও সেসময় ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার মাত্র এক–তৃতীয়াংশ ছিল ইহুদি। এই বিভাজন প্রস্তাব ছিল স্পষ্টতই ইহুদিদের পক্ষে এবং এজন্য স্বাভাবিকভাবেই অন্তত ফিলিস্তিনি আরবদের এই প্রস্তাব গ্রহণ করার কথা ছিল না। তদুপরি, ইহুদি উগ্রপন্থীদের দৃষ্টিতে (যাদের মধ্যে ছিলেন ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন–গুরিয়ন) ফিলিস্তিনের বিভাজন ও একটি ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ছিল সমগ্র ফিলিস্তিনের ওপর ইহুদি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক ধাপ।
সুতরাং, ফিলিস্তিনি আরবরা যদি ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের বিভাজন মেনে নিয়ে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করত, তাহলে জায়নবাদীরা যে তাদের ওপর আক্রমণ চালাত না এবং তাদের ভূমি দখল করতে শুরু করত না, এর কোনো নিশ্চয়তা ছিল না।
কিন্তু হাসানভের এই বক্তব্যটি সম্পূর্ণ সঠিক যে, একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করার পেছনে আরবদের দায় রয়েছে। ১৯৪৮–৪৯ সালের আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধের পর ইসরায়েল ফিলিস্তিনের অধিকাংশ ভূখণ্ড দখল করে নেয় বটে, কিন্তু কিছু ভূখণ্ড আরব রাষ্ট্রগুলোর অন্তর্ভুক্ত হয়। জর্দান নদীর পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম ট্রান্সজর্দানের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং গাজা ভূখণ্ড মিসরের সামরিক শাসনাধীনে আসে। জর্দানীয় ও মিসরীয়রা চাইলে পশ্চিম তীর ও গাজা ভূখণ্ডে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারত।
কিন্তু স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেয়ে নিজস্ব ভূখণ্ডের সম্প্রসারণ তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এজন্য তারা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ফিলিস্তিনি ভূমিতে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এর ফলে ১৯৬৭ সালের আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধের সময় ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর ও গাজা ভূখণ্ড দখল করে নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে উক্ত ভূমিতে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়।
তৃতীয়ত, হাসানভের মতে, আরব রাষ্ট্রগুলো সাম্প্রতিক ইসরায়েলি–ফিলিস্তিনি সংঘাতের ক্ষেত্রে খুবই নিষ্ক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করেছে। এই বক্তব্যটি বহুলাংশে সঠিক। আরব বিশ্বে ফিলিস্তিন বাদে ২১টি রাষ্ট্র রয়েছে, এবং এদের মধ্যে কেউই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে সক্ষম বা আগ্রহী নয়। আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া ও লিবিয়া নিজেরাই যুদ্ধবিধ্বস্ত। কাতার ও কুয়েত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র এবং তাদের সামরিক সামর্থ্য অত্যন্ত সীমিত। আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়া সাধারণভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষে, কিন্তু ভৌগোলিক দূরত্ব ও অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণ ফিলিস্তিনি ইস্যু তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। লেবানন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। সবশেষে, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, জর্দান, বাহরাইন, মরক্কো, সুদান, ইরিত্রিয়া ও মৌরিতানিয়া সরাসরি ইসরায়েলের সঙ্গে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ এবং সৌদি আরব ও ওমান কার্যত ইসরায়েলের ‘অঘোষিত মিত্র’।
অর্থাৎ, আরব রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনিদের অধিকারের তুলনায় নিজস্ব স্বার্থকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে এবং এজন্য ফিলিস্তিনের পক্ষ নিয়ে শক্তিশালী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে তারা ইচ্ছুক নয় এবং তাদের অনেকের সেই সামর্থ্যও নেই। অবশ্য সাম্প্রতিক সঙ্কটে আরব রাষ্ট্রগুলো যে একেবারে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে, এমনটা নয়। কাতার হামাসের অর্থায়ন করে থাকে এবং সাম্প্রতিক সংঘর্ষ বন্ধ করে যুদ্ধবিরতি স্থাপনের ক্ষেত্রে মিসর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তদুপরি, মিসর যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার পুনর্গঠনে বিনিয়োগ করারও ঘোষণা দিয়েছে।
চতুর্থত, হাসানভের বক্তব্য অনুযায়ী, ফিলিস্তিনিদের যদি কোনো আঞ্চলিক রাষ্ট্র কার্যকরভাবে সহায়তা করতে পারে, তারা হচ্ছে ইরান ও তুরস্ক। এক্ষেত্রে হাসানভ একটি রাষ্ট্রের অবস্থানকে উপেক্ষা করে গেছেন। মিসর আরব বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং তারা চাইলে গাজায় অবস্থানরত হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি দলকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রলম্বিত গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাপক সহায়তা করতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিসরে ব্যাপক সামরিকায়ন হয়েছে এবং এজন্য ১৯৬৭ সালের মতো অতি সহজে মিসরকে পরাজিত করা এখন আর ইসরায়েলের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং, অন্তত তাত্ত্বিকভাবে, ইরান ও তুরস্কের বাইরে আরেকটি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনিদের কার্যকরভাবে সহায়তা করতে সক্ষম।
কিন্তু মিসরের বর্তমান সরকার এই ব্যাপারে মোটেই উৎসাহী নয় এবং তারা উল্টো গাজার ওপর অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। তদুপরি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিসর তুরস্কের সঙ্গে একধরনের ‘প্রক্সি যুদ্ধে’ লিপ্ত হয়েছে এবং নীলনদের ওপর বাঁধ নির্মাণ নিয়ে ইথিওপিয়ার সঙ্গেও দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। এমতাবস্থায় মিসরের সামর্থ্য থাকলেও তারা ফিলিস্তিনিদের কার্যকরভাবে সহায়তা করতে আগ্রহী হবে না।
পঞ্চমত, হাসানভের বক্তব্য অনুসারে, ইরানি নেতারা ফিলিস্তিনের পক্ষে বক্তব্য প্রদান করে থাকেন, কিন্তু কার্যত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের বিশেষ কিছু করার সক্ষমতা নেই। এই বক্তব্যটি বহুলাংশে সত্যি, কারণ ইরানিরা এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সক্রিয় কোনো সামরিক হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু সাম্প্রতিক লড়াইয়ে হামাস ইসরায়েলের ওপর বিপুল সংখ্যক রকেট নিক্ষেপ করেছে এবং ইসরায়েলি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হামাসের রকেট ঠেকাতে গিয়ে রীতিমতো গলদঘর্ম হয়েছে। হামাসের এই রকেট ভাণ্ডার গড়ে তোলার পেছনে ইরানের যথেষ্ট অবদান রয়েছে, কারণ হামাসের রকেটগুলোর বড় একটি অংশ ইরান তাদেরকে সরবরাহ করে থাকে।
ষষ্ঠত, ইসরায়েলি–ফিলিস্তিনি সংঘাতে তুরস্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকা সম্পর্কে হাসানভ যে বক্তব্য রেখেছেন, তা প্রায় সর্বাংশে সঠিক। কিন্তু রাশিয়ার ভূমিকা সম্পর্কে তিনি যেটা উল্লেখ করেছেন, সেটি নিয়ে আলোচনার অবকাশ রয়েছে। হাসানভের মতে, রাশিয়া যে ফিলিস্তিনের পক্ষে সক্রিয় হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী নয়, তার দুটি কারণ রয়েছে – ইসরায়েলের সঙ্গে রাশিয়ার বিশেষ সম্পর্ক এবং বিভিন্ন অঞ্চলে রাশিয়ার চলমান সামরিক অভিযান।
এটি ঠিক যে, ইসরায়েলের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক বর্তমানে বিশেষ ও বহুমুখী। কিন্তু একই সঙ্গে এটি ভুলে গেলে চলবে না যে, ইসরায়েল বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে রুশ ভূরাজনৈতিক স্বার্থ অর্জনের পথে অন্তরায়। এবং এটিও সত্যি যে, রাশিয়া বর্তমানে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে সীমিত সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখছে এবং এজন্য নতুন কোনো অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি স্থাপন করা রাশিয়ার জন্য একটি অর্থনৈতিক বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু গাজা ভূখণ্ড ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এবং এতদঞ্চলে ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা রুশদের বহুদিনের পুরনো। গাজা ভূখণ্ডে সামরিক (বিশেষত নৌ) উপস্থিতি গড়ে তোলা রুশদের জন্য কৌশলগতভাবে লাভজনক হতে পারে।
তাহলে রাশিয়া কেন গাজায় যৌথ শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণের তুর্কি প্রস্তাব গ্রহণ করল না? এর উত্তর হচ্ছে, রুশরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এটি কেবল ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের ‘বিশেষ সম্পর্ক’কেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, এর ফলে সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সংঘাত বেধে যেতে পারে। এরকম কোনো ঝুঁকি নিতে মস্কো মোটেই ইচ্ছুক নয়। তদুপরি, রুশরা এরদোয়ানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে ঠিকই, কিন্তু তাকে মোটেই বিশ্বাস করে না। এজন্য অবশ্য এরদোয়ান নিজেই দায়ী, কারণ তিনিও নিজস্ব স্বার্থ ছাড়া কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না।
এটি ঠিক যে, সিরিয়ার ইদলিবে রুশ সামরিক পুলিশ ও তুর্কি সৈন্যরা যৌথ টহল দেয় এবং আজারবাইজানের আগদামে রুশ ও তুর্কি সৈন্যরা যৌথভাবে একটি যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে কৌশলগত প্রকৃতির একটি সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তুর্কিরা রুশদের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং পশ্চিম লিবিয়া থেকে কাজাখস্তানের সীমান্ত পর্যন্ত তাদের এই প্রতিযোগিতা বিস্তৃত। সুতরাং রুশরা যে তুর্কিদের সঙ্গে গাজার মতো স্পর্শকাতর অঞ্চলে যৌথ শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণ করবে না, এটি সহজেই অনুমেয়।
আরো অনুমেয় যে, রুশরা যে তুর্কি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে, সেটি এরদোয়ানও ভালো করেই জানতেন। কিন্তু এরপরও তিনি রুশদের কাছে এই প্রস্তাব করেছেন এবং সেটির কথা প্রচার করেছেন, যার ফলে তিনি যে ফিলিস্তিনি সমস্যা সমাধানের জন্য খুবই সক্রিয়, এরকম একটি ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। কার্যত ইস্তাম্বুলে তুর্কি, সিরীয় ও ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীরা যতই বিক্ষোভ করুক আর গাজায় তুর্কি সামরিক হস্তক্ষেপ দাবি করুক, বাস্তবতা হচ্ছে, ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কেরও একটি ‘বিশেষ সম্পর্ক’ রয়েছে এবং তুরস্ক সেই সম্পর্ক ছিন্ন করতে ইচ্ছুক নয়।
সর্বোপরি, সম্পাদকীয়তে হাসানভ যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন সেটি হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানোর কেউই নেই। অবস্থাদৃষ্টে একেই সঠিক বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু একইসঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘাত থেকে এটাও প্রতীয়মান হচ্ছে যে, ইসরায়েলি–ফিলিস্তিনি সংঘাত সহসা সমাধান হওয়ার কিংবা নিকট ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকার আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, বরং তা একটি সুদীর্ঘ সময়ের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিরাজ করতে যাচ্ছে।