বিলাল বিন সাকিব: তরুণ প্রজন্মের আইকন হয়ে ওঠা এক উদ্যোক্তা

ভারতের জাগ্গি ভাসুদেব, ‘সাধগুরু’ নামে ভারতে তুমুল জনপ্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব। গত বছর লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের একটি অনুষ্ঠানে একজন পাকিস্তানী শিক্ষার্থীকে ‘তালেবান’ বলে আখ্যায়িত করেন। এরপর শুরু হয় তুমুল সমালোচনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সাধগুরুকে রীতিমতো ধুয়ে দেয়া হয়। লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্সের ছাত্র সংসদ তার মন্তব্যকে ‘গড়পড়তা ইসলামোফোবিক’ বলে মন্তব্য করে। চারদিক থেকে ধেয়ে আসা সমালোচনার তীরে কুপোকাত সাধগুরু বেশ বিপাকে পড়ে যান। পরে এক ক্ষমাসূচক বার্তায় কোনোমতে এ যাত্রায় নিষ্কৃতি পান।

গসগসগসহ
ভারতের সাধগুরু, যিনি বিলাল বিন সাকিবকে ‘তালিবান’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন; image source: thewire.in

বিলাল বিন সাকিব, যে পাকিস্তানি শিক্ষার্থী গত বছর আলোচনায় আসেন, তিনি এ বছরও আলোচনার তুঙ্গে। ফোর্বস সাময়িকীর ২০২০ সালের ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’ তালিকায় স্থান করে নিলে তুমুল আলোচনা হবে, এটিই স্বাভাবিক। কারণ এই তালিকায় তারাই শুধু অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকেন, যারা উদ্যোক্তা হয়ে কিংবা শিল্প-সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। বিলাল বিন সাদিক ‘সামাজিক উদ্যোক্তা’ ক্যাটাগরিতে এবার ফোর্বস সাময়িকীর শীর্ষ ত্রিশজন ব্যক্তির একজন, যাদের বয়স ত্রিশের নিচে।

ফোর্বস সাময়িকীর এই তালিকায় স্থান করে নেয়া কিন্তু মোটেই সহজ কোনো কাজ নয়। মানদন্ড অনুযায়ী অসংখ্য যোগ্য ব্যক্তির মধ্য থেকে যোগ্যতম ব্যক্তিটিকে তারা বেছে নেয়। তাই যে ব্যক্তিটি তালিকায় স্থান করে নেন, তিনি যে নিঃসন্দেহে অসাধারণ কেউ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রায় ৩,৫০০ জন মনোনীত যুবার মাঝ থেকে বিলাল বিন সাকিবকে সেরা ত্রিশে স্থান দিয়েছে এই মর্যাদাবান সাময়িকী।

ীননহহসহড
বিলাল বিন সাকিব; image source: medium.com

ফোর্বস সাময়িকীর মতে,

বিলাল বিন সাকিব ‘তায়েবা’র নামের একটি সামাজিক উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা, যার লক্ষ্য পাকিস্তানের পানি-সংকটের সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া। এর অন্যতম পদক্ষেপ হলো ‘এইচটুও হুইল’। এই হুইলের সাথে সংযুক্ত থাকে পানি রাখার কন্টেইনার, যেটি লোহার তৈরি হাতলের সাহায্যে টেনে নেয়া যায়। পাকিস্তানে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে প্রতিদিন অসংখ্য নারী ও শিশুকে কষ্ট করে পানি বয়ে নিয়ে আসতে হয় মাইলখানেক দূর থেকে। এটি তাদের উপর থেকে সেই চাপ কমাবে। গতানুগতিক মাটির পাত্রগুলো যে পরিমাণ পানি ধারণ করতে পারে, তার চেয়ে আট-দশগুণ বেশি পানি ধারণ করতে পারবে এই জিনিসটি।

বিলাল বিন সাকিব প্রায় চার বছর আগে প্রতিষ্ঠা করেন ‘তায়েবা ফাউন্ডেশন’। লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের পানির দুষ্প্রাপ্যতা সমস্যার সমাধান করা। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেই এইচটুও (হেল্প টু আদার্স) হুইল দেয়া হয় গ্রামীণ পরিবারগুলোকে।

পাকিস্তানে পানির সমস্যা নতুন কোনো বিষয় নয়। পৃথিবীর চরম পানি সংকটে ভুগতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান অবস্থান তৃতীয়তে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে, ২০২৫ সালের মধ্যে পানি ‘সোনার হরিণ’ হয়ে উঠবে দেশটিতে। দক্ষিণ পাকিস্তানে যেখানে বরফাচ্ছাদিত অঞ্চল, সেখানে উত্তর পাকিস্তানে মরুভূমিময় এলাকা। তাই বছরের পর বছর ধরে উত্তর পাকিস্তানের মানুষদের প্রচন্ড ভুগতে হচ্ছে পানির কারণে।

সাধারণ মানুষদের জন্য অনেক দূরে অবস্থিত পানির উৎস থেকে পানি বয়ে আনাটা বেশ শ্রমসাধ্য কাজ। আর বয়ে আনতে গেলে একবারে কতখানি পানিই বা আনা যায়! তাই ছোট চাকার সাহায্যে ঠেলে পানি আনার যে প্রযুক্তির প্রচলন ঘটিয়েছে তায়েবা ফাউন্ডেশন, তা নিঃসন্দেহে সে এলাকার মানুষের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।

গচগশএশএশ
এইচটুও হুইল, গ্রামীণ পাকিস্তানিদের পানির সমস্যা সমাধানে নতুন আশীর্বাদ; image source: greebox.world

বিলাল বিন সাকিব পশ্চিম আফ্রিকায় ভ্রমণ করতে গিয়ে দেখেছিলেন সেখানে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষেরা কীভাবে দূর থেকে ছোট চাকার সাহায্যে পানির কন্টেইনার ঠেলে আনছে। বয়ে আনার চাইতে এভাবে ঠেলে আনতে পারলে কষ্টও কম হয়, একইসাথে অধিক পরিমাণেও আনা যায়। আফ্রিকায় পানি বহন করার মডেলটিই পাকিস্তানে প্রয়োগ করেছেন সফলভাবে।

বিলাল বিন সাকিবের বর্তমান বয়স ২৯ বছর। লাহোর গ্রামার স্কুলে মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করে আন্ডারগ্রাজুয়েট সম্পন্ন করেছেন লন্ডনের কুইন্স মেরী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর ‘সোশ্যাল ইনোভেশন এন্ড অন্ট্রাপ্রেনারশীপ’ বিষয়ের উপর মাস্টার্স করেছেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে।

পৃথিবী বর্তমানে দুঃসময় অতিবাহিত করছে। করোনাভাইরাস একরকম পর্যুদস্ত করে দিয়েছে জনজীবন। স্বাস্থ্যসেবা ও জনগণের নিরাপত্তার সাথে জড়িত সকল মানুষদের কঠোর পরীক্ষা নিচ্ছে এই ভাইরাস। ডাক্তার, নার্স থেকে শুরু করে পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যক্তিদের সবসময় ব্যতিব্যস্ত থাকতে দেখছি আমরা। মোটামুটি পৃথিবীর সবখানেই এরকম পরিস্থিতি চলছে।

পৃথিবীর এই কঠিন সময়েও বসে নেই বিলাল বিন সাকিব। পুরো ইংল্যান্ডে করোনার ভাইরাসের সাথে লড়াইরত যোদ্ধাদের পুষ্টিকর খাবার যোগাতে কাজ করে যাচ্ছে তার ‘ওয়ান মিলিয়ন মিলস্’ ক্যাম্পেইন। ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করছেন। সেই অর্থ পুরোটাই ব্যয় হচ্ছে খাবারের পেছনে। এক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করছে রেস্টুরেন্ট ও খাবার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

সননসবন
‘ওয়ান মিলিয়ন মিলস্’ ক্যাম্পেইনের খাবার পেয়ে খুশি স্বাস্থ্যকর্মীরা; image source: keepthefaith.co.uk

বিলাল বিন সাকিবের এই ক্যাম্পেইন তুমুল প্রশংসিত হচ্ছে দেশে-বিদেশে। ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি ফুটবলার ডেভিড বেকহ্যামের সমর্থন পেয়েছে এই ক্যাম্পেইন। এক শুভেচ্ছাবার্তায় তিনি জানিয়েছেন, “ওয়ান মিলিয়ন মিলস্ স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ও মূল কর্মীদের পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার সরবরাহে দারুণ কাজ করছে।

উদ্যোক্তাদের জন্য পৃথিবী এখনও পুরোপুরি বন্ধুবৎসল হয়ে উঠতে পারেনি। সমাজে নতুন কিছুর প্রবর্তনে বেশ ঝুঁকি থাকে। এসব ঝুঁকি মাথায় রেখেই উদ্যোক্তাদের এগিয়ে যেতে হয়, সব সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে। সফলতার মুখ দেখতে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়। অনেক উত্থান-পতন প্রত্যক্ষ করতে হয়। উদ্যোক্তা হিসেবে বিলাল বিন সাকিবের সফলতা নিঃসন্দেহে আলোর পথ দেখাচ্ছে পাকিস্তানের উঠতি উদ্যোক্তাদের। ধীরে ধীরে তরুণ প্রজন্মের আইকন হয়ে উঠছেন এই যুবক।

Related Articles

Exit mobile version