দ্য কোয়াড (পর্ব-২): চীনের আধিপত্য রুখে দিতে পারবে এই জোট?

এশিয়ায় আমেরিকার সবচেয়ে বড় মিত্র জাপানের সাথেও চীনের সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। জাপান ও চীনের বিতর্কিত জলসীমায় প্রায়ই চীন সামরিক মহড়ার আয়োজন ও সশস্ত্র টহল দিয়ে থাকে, যেটি জাপানকে আমেরিকার প্রতি আরও বেশি নির্ভরশীল করে তুলেছে। শিনজো আবে জাপানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সামরিক বাহিনীর উন্নয়নের জন্য একচেটিয়াভাবে আমেরিকার কাছ থেকে সাহায্য লাভ করেছিলেন যেটি চীনকে আরও বেশি ক্ষুব্ধ করেছে। এছাড়া বিতর্কিত সেনকাকু দ্বীপের মালিকানা নিয়েও জাপানের সাথে চীনের কম জলঘোলা হয়নি। তবে বাণিজ্যিকভাবে এখনও জাপানের সবচেয়ে বড় অংশীদারগুলোর একটি হচ্ছে চীন। জাপানের রপ্তানিপণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে চীন এবং একইসাথে শিল্পের কাঁচামালের জন্য চীনের অপর অনেকাংশে নির্ভর করতে হয় জাপানিদের। জাপানের আশঙ্কা, চীনের উপর অর্থনৈতিকভাবে অধিক নির্ভরশীলতা থেকে ভবিষ্যতে বিপদের আশঙ্কা আছে। যেমন বলা যায়, জাপানের কোনো রপ্তানিপণ্যের উপর মাত্রাতিরিক্ত ট্যাক্স কিংবা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জাপানি ব্যবসায়ীদের বিপদে ফেলতে পারে চীন।

Zvzvsbbssbns
জাপান ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক যে খুব ভালো, সে কথাও বলা যাবে না; Image source:chinadaily.com.cn

এবার ভারতের প্রসঙ্গে আসা যাক। সম্প্রতি চীনের সাথে ভারতের সম্পর্ক মোটেই ভালো যাচ্ছে না। গত বছরই ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’ বা ইন্দো-চীন সীমান্তে চীনের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে সরকারি হিসেবে বিশজন জওয়ানের মৃত্যুর সংবাদ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিল। সেই ঘটনার সূত্রপাত ধরে পরবর্তীতে ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার চীনের অনেকগুলো পণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এর আগে ২০১৭ সালে দোকলাম মালভূমির বিতর্কিত জায়গায় নির্মাণকাজ পরিচালনার জন্য ভারতের সাথে চীনের সামরিক সংঘাত বেঁধে যাওয়ার উপক্রম হয়। বাণিজ্যিক দিক থেকে ভারত এখনও অনেক পিছিয়ে চীনের চেয়ে। ভারতও আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের দেখতে চায়, কিন্তু চীনের সাথে পাল্লা দিয়ে সেটা করতে গেলে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। নরেন্দ্র মোদি ‘আত্মনির্ভর ভারত’ গড়ার যে স্বপ্ন দেখছেন, তাতে হয়তো দীর্ঘমেয়াদে সফলতা আসতে পারে, কিন্তু স্বল্পমেয়াদে ভারতকে ভুগতে হবে।

পতকতপতপ
ভারতের সাথে গতবছরই লাদাখে ছোটখাট সংঘর্ষ হয়ে গিয়েছে চীনের; Image source: wgi.world

অস্ট্রেলিয়ার সাথে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিশাল। অস্ট্রেলিয়ায় উৎপাদিত শস্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হচ্ছে চীন, অপরদিকে চীনের তথ্যপ্রযুক্তি ও অন্যান্য পণ্যের বড় বাজার হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল বের করার একটি গবেষণা প্রকল্প অনুমোদনের পর থেকে অস্ট্রেলিয়ার সাথে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে তলানিতে নেমে এসেছে। অস্ট্রেলিয়ার রপ্তানিপণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছে চীন। ফলে অস্ট্রেলিয়াকেও এখন বিকল্প খুঁজতে হচ্ছে। করোনাভাইরাসের কারণে ইতোমধ্যে বৈশ্বিক পরিমন্ডলে চীনের ভাবমূর্তি যেভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে, তাতে করে তারা আর নতুন কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না।

জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা– ২০১০ সালের পর থেকে প্রতিটি দেশের সাথে চীনের সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে খারাপ হয়েছে। আমেরিকার বৈশ্বিক আধিপত্য হুমকির মুখে ফেলে দেয়া, ভারতের আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়ার প্রধান বাধা হওয়া, অস্ট্রেলিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে বেকায়দায় ফেলে দেয়া কিংবা জাপানকে অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতার সুযোগ নিয়ে কোণঠাসা করার জন্য চীনের উপর বর্তমানে ‘দ্য কোয়াড’ জোটের চারটি সদস্যরাষ্ট্রই ক্ষিপ্ত হয়ে আছে। এছাড়া বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীন যেভাবে দিন দিন অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে, তাতে ভবিষ্যতে চারটি দেশকেই স্বকীয়তা বজায় রাখতে বেগ পেতে হবে।

ভবিষ্যতে পৃথিবী হবে পুরোপুরি তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর, এবং এই খাতে যারা বিশাল অংকের বিনিয়োগ করতে পারবে, তারাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে। ভবিষ্যতের কথা বাদ দিলেও বর্তমানেই চীনা প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বজুড়ে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির এই বিশ্বে তূলনামূলক কম মূল্যে ভালো মানের পণ্য সরবরাহের কারণে ভবিষ্যতে যে চীনা পণ্যের চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে, তা না বললেও চলে।

জতপতপগেগলব
বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের মতো কাজগুলো চীনকে বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে বিশাল ভূমিকা পালন করবে;
image source: scmp.com

অস্ট্রেলিয়ার কথা বাদ দিলেও জাপান, ভারত ও আমেরিকা– তিনটি দেশেরই বর্তমানে মূল লক্ষ্য চীনের অগ্রগতি যেকোনো মূল্যে আটকে দেয়া। বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভের মতো প্রকল্পগুলো ভবিষ্যতে পুরো বিশ্বকে চীনের হাতের মুঠোয় এনে দেবে। অর্থনৈতিকভাবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার সাথে বৈশ্বিক পরাশক্তি হওয়ার বিশাল সম্পর্ক রয়েছে। যখন একটি রাষ্ট্রের হাতে খুব বেশি পরিমাণ উদ্বৃত্ত অর্থ এসে জমা হয়, তখন চাইলেই সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন করা যায়, নিজ দেশের গন্ডি পেরিয়ে বাইরের দেশেও বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা যায়, যেকোনো কূটনৈতিক দর কষাকষির ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করা যায়।

চীন ইতোমধ্যেই আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে, সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন ও গবেষণায় তারা প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে। যেভাবে তারা এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে শীঘ্রই আমেরিকার নের্তৃত্বে যে একমাত্রিক বিশ্বব্যবস্থা, তা ভেঙে পড়বে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ‘দ্য কোয়াড’ জোটকে আবার পুনর্জন্ম দেয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছিলেন, তখনই বোঝা গিয়েছিল মার্কিনিরা চীনকে নিয়ে কতটুকু চিন্তিত।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে চীনকে ঠেকানোর জন্য এই জোট গঠন করা হলো, সেই চীন এর পরিপ্রেক্ষিতে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে? চীনের কাছে এই জোট হচ্ছে ‘এশিয়ান ন্যাটো’। স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো সামরিক জোট গঠন করা হয়েছিল ইউরোপের দেশগুলোকে সোভিয়েত ইউনিয়নের হাত থেকে বাঁচাতে। চীন মনে করছে, এটা সেরকমই একটি জোট। তবে যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে খুব বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারায় এখনও পর্যন্ত চীন একে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে না বলেই প্রতীয়মান হয়। চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব এক হয়েই বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে, কোনো জোট গঠনের দরকার পড়েনি। তবে বাণিজ্যিক দিক থেকে এই জোট যদি চীনের বিরুদ্ধে তৎপরতা শুরু করে, তাহলে চীনের প্রতিক্রিয়া যে এখনকার মতো থাকবে না সেটি বোঝাই যায়। দ্য কোয়াডের সদস্য দেশগুলোর সাথে চীনের মতাদর্শিক পার্থক্য থাকলেও অর্থনৈতিকভাবে এখনও চীনের বিকল্প খুঁজে পায়নি সেই দেশগুলো, নিকট ভবিষ্যতে যে পাবে সেই সম্ভাবনাও নেই।

হডজতওততপতপত
করোনাভাইরাসের জন্য ইতোমধ্যে পশ্চিমা বিশ্ব ও চীনের সম্পর্ক তলানিতে পৌছেছে; image source: euromoney.com

২০০৭ সালে যাত্রা শুরু করলেও এতদিন পর্যন্ত জোটটিতে কেবল পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়েই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, কখনও প্রধানমন্ত্রী তথা দেশের সর্বোচ্চ নেতাদের পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয় ন। এই বছরই সর্বপ্রথম ভার্চুয়াল মিটিং অনুষ্ঠিত হয়েছে চারটি দেশের সরকার প্রধানদের মধ্যে। যখন গঠিত হয় তখন চীন সেরকম আগ্রাসী হয়ে ওঠেনি, কিন্তু এখনকার বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন। চারটি দেশই এখন যেকোনো মূল্যে চীনের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে চায়, বিকল্প খুঁজে বের করতে চায়। করোনার এ সময়ে চীনের ভ্যাক্সিন ডিপ্লোম্যাসির বিপরীতে জাপান ও আমেরিকার অর্থায়নে ভারতে বিপুল পরিমাণ করোনা ভ্যাক্সিন তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। চীনের আধিপত্য রুখে দেয়ার লক্ষ্য সামনে রেখে এই জোট গঠন করা হলেও বাস্তবে বারবার গণমাধ্যমে জানানো হয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাণিজ্য নির্ঝঞ্ঝাট রাখতেই এই জোট গঠন করা হয়েছে।

চীনের বিরুদ্ধে পশ্চিমা কূটকৌশল নতুন কিছু নয়। অপরদিকে চীনও অর্থনৈতিকভাবে অনেক সময় বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রগুলোকে কোণঠাসা করে আসায় সেই রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে বিকল্প খোঁজার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। চীনের উত্থান ঠেকানোর জন্য আমেরিকার দরকার ভারত ও জাপানের মতো এশিয়ার উদীয়মান দেশগুলো হাতে রাখা। এই জোটের মাধ্যমে আমেরিকার সাথে এশিয়ার দেশ ভারত জাপানের সম্পর্ক নতুন মাত্রা লাভ করবে। তবে চীন ও এই চারটি দেশের দ্বন্দ্বে ঝামেলায় পড়বে এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো। বিনিয়োগের জন্য এশিয়ার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর হাতে চীন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই, আবার পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আমেরিকার কর্তৃত্ব মেনে না নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনাও সম্ভব নয়। চীনের উত্থান ঠেকাতে এই জোট কতটুকু সক্ষম হবে কিংবা এই জোটের বিপরীতে চীন নতুন কোন কৌশল নিয়ে বিশ্বমঞ্চে হাজির হবে তা সময়ই বলে দেবে। কোভিড-পরবর্তী সময়ে এই জোট যে এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ নিয়ে হাজির হবে তা বলাই বাহুল্য।

Related Articles

Exit mobile version