১৬ই মার্চ, ২০১৯। ফিলিপাইনের ডাভাও উপসাগরের পারে অস্বাভাবিক ভাবে কাতরাচ্ছে একটি তিমি। ক্রমাগত রক্তবমি করতে থাকা মাছটা সাঁতার কাটা তো দূরে থাকা, এই অবস্থায় বেশিক্ষণ আর বাঁচবে কি না সন্দেহ। তাই স্থানীয় এক মেরিন এজেন্সির কাছ থেকে খবর পেয়ে ছুটে গেলেন সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী বিশেষজ্ঞ ড্যারেল ব্ল্যাচলি ও ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়ামের একজন কিউরেটর। মাছটিকে ডাভাও সিটির ল্যাবে এনে নেক্রোস্কপি করে ভয়ঙ্কর এক বাস্তবতার মুখোমুখি হলেন তারা!
ইতিমধ্যেই প্রাণ হারানো বিশাল তিমি মাছটার পেটের ভেতর পাওয়া গেল প্রায় ৮৮ পাউন্ড প্লাস্টিক বর্জ্য, যার অধিকাংশই ছিল অবিশ্বাস্য ধরনের। ড্যারেলের ব্ল্যাচলির মতে,
প্লাস্টিকের কারণে মাছটার পেট ফেটে যাবার মতো অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। আমরা যখন প্রথম ব্যাগটা টেনে বের করলাম, তখনও বুঝিনি ভেতরে আর কী কী অপেক্ষা করছে। একে একে ১৬টা চালের বস্তা বের হলো। তাছাড়া, বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক ব্যাগ, ছোটখাট প্যাকেট, বড় এক গোছা নাইলনের দড়িও ছিল। মানে, এই অবস্থায় একটা প্রাণীর পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব? আর মাছটার পেটের ভেতর এসব প্লাস্টিক এমনভাবে দলা পাকিয়ে ছিল যেন মনে হচ্ছিল বিশাল কোনো বাস্কেটবল। বের করতেও বেশ কষ্ট হয়েছে।
কয়েক বছর পিছিয়ে যাওয়া যাক। ২০১৫ সালে কোস্টারিকার গুয়েনাক্যাস্টে কাজ করার সময় একদল মেরিন বায়োলজিস্টের নজর পড়ে এক সামুদ্রিক কচ্ছপের ওপর। সমুদ্রের তীরে ব্যথায় কাতরাতে থাকা কচ্ছপটিকে ভালোভাবে খেয়াল করতেই দেখা গেল এর নাকের ফুটোয় কিছু একটা আটকে রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে, শ্বাসকষ্ট থেকেই প্রাণীটা কষ্ট পাচ্ছে বলে ভাবল সবাই।
সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল মেরিন বায়োলজিস্ট দলটি। ছোটখাট কিছু ভেবে চিমটা দিয়ে টেনে টেনে বের করতে শুরু করল। কিন্তু তাদেরকে অবাক করে দিয়ে কয়েক মিনিটের যুদ্ধ শেষে বেরিয়ে এলো বিশাল বড় এক প্লাস্টিকের টুকরো। ওদিকে দরদর করে অসহায় কচ্ছপটার নাক গড়িয়ে রক্ত পড়ছে।
প্লাস্টিকের ভয়াবহ থাবায় বন্দী হতে থাকা সামুদ্রিক জগতের এই সামান্য উদাহরণ দুটি দেখে যদি আপনি আতঙ্কে শিউরে উঠে থাকেন, তাহলে আপনার জন্য রয়েছে আরও বড় দুঃসংবাদ।
বিবিসি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৮.৭ মিলিয়ন প্রজাতি রয়েছে, যার মধ্যে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের খুঁজে পাওয়া প্রজাতির সংখ্যা মাত্র ১.২ মিলিয়ন। গবেষকদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, মানবজাতির নিষ্ঠুর স্বেচ্ছাচারিতায় এসব প্রজাতির অধিকাংশের রয়েছে নথিভুক্ত হবার আগেই বিলুপ্ত হয়ে যাবার ঝুঁকি। আমরা জানি, পৃথিবীর মাত্র ৩০ ভাগ স্থল ও বাকি ৭০ ভাগই জল।
এখন পর্যন্ত পাওয়া সমুদ্রের সবচেয়ে গভীর অংশটি রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরে। মারিয়ানা ট্রেঞ্চের চ্যালেঞ্জার ডিপ নামক জায়গাটির গভীরতা প্রায় ১১ কিলোমিটার বা ৩৬ হাজার ফুট। ২০১৫ সালে সমুদ্রের সবচেয়ে গভীরে গিয়ে স্কুবা ডাইভ রেকর্ড গড়েন মিশরের আহমেদ জেবর। ৪১ বছর বয়সী আহমেদ গিয়েছিলেন প্রায় ১,০৯০ ফুট গভীরে। উচ্চতার বিচারে যা কি না আইফেল টাওয়ারের উচ্চতার (৯৮৪ ফুট) সমতুল্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ন্যাশনাল ওশেন সার্ভিস এর দেয়া তথ্যানুসারে, অত্যাধুনিক সোনার টেকনোলজি ব্যবহার করে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর মাত্র দশ ভাগেরও কম সমুদ্র অঞ্চলকে বিস্তারিতভাবে মানচিত্রের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
বৈচিত্র্যময় মেরিন লাইফ নিয়ে প্রতিনিয়ত হতে থাকা অসংখ্য গবেষণার অধিকাংশই এখনও সমুদ্রের উপরিভাগ জুড়ে সীমাবদ্ধ। সমুদ্র অঞ্চলের খুব বেশি গভীরে যাবার সৌভাগ্য না হওয়ায় প্রকৃতির বুকে বেঁচে থাকা প্রাণের স্পন্দনের প্রায় সিংহভাগই রয়ে গেছে আমাদের দৃষ্টির আড়ালে। কিন্তু, দৃষ্টির আড়ালে থাকলেও এই সিংহভাগ প্রাণকে হুমকির মুখে ফেলতে আমাদের প্রচেষ্টার কোনো কমতি নেই।
২০২০ সালে পৃথিবী নামক গ্রহটির ওপর আসা সবচেয়ে বড় আঘাতটির নাম কোভিড-১৯।
শহর-দেশ-মহাদেশে মাসের পর মাস লকডাউনে বন্ধ থেকেছে কলকারখানা থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। সর্বস্তরের মানুষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে সাধ্যমতো চেষ্টা করে চলেছে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার। হাসপাতালগুলোয় রোগীদের উপচে পড়া ভিড়ের মুখে জীবন বাজি রেখে সেবা দিয়ে চলেছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। গবেষকরা দিন-রাত ভয়ঙ্কর এই রোগের প্রতিকার খুঁজে পেতে কাজ করে চলেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মীরাও কাজ করে যাচ্ছেন এই কঠিন সময়ে।
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস কবলিত দেশগুলোর সামনে এর মোকাবিলা করার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনাটাও অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। ওদিকে গৃহবন্দী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে চলা জনপদগুলোয় ভাঙতে বসা অর্থনীতির চাপে বেসামাল হয়ে পড়েছে জাতীয় জীবন। মাসের পর মাস লকডাউনে থেকে আর্থিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে বাধ্য হয়েই জীবিকার টানে বেরোচ্ছে মানুষ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়ানোর চেষ্টায় নানা ধরনের সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবহার শুরু হয়েছে।
সচেতন নাগরিকদের মধ্যে মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, ফেস শিল্ড, বডি ব্যাগ, স্যুটসহ বিভিন্ন ধরনের পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) এর ব্যবহারের হার উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্লোবাল প্যানডেমিকের আঘাতে মানবজাতি যখন হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে, তখন রোগ প্রতিরোধে এ ধরনের সচেতনতা অবশ্যই ভালো দিক। কিন্তু, দিনশেষে আমাদের সামান্য অবহেলাই যদি এ গ্রহের অন্যান্য প্রাণীদের জন্য আরেকটা প্যানডেমিকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়?
২০১৯ সালে প্রকাশিত এক সমীক্ষা বলছে, সর্বশেষ চার দশকে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ। গবেষণাটিতে আরও দেখা গেছে, প্রবৃদ্ধির এ ধারা বজায় থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ শুধুমাত্র প্লাস্টিক উৎপাদনই হয়ে দাঁড়াবে গ্রিনহাউজ গ্যাস উৎপাদনের অন্যতম উৎস। সংখ্যার হিসাবে যা কি না বর্তমানে বিশ্বজুড়ে পরিবহন খাত থেকে উৎপন্ন হওয়া গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ (১৫ শতাংশ) এর সমান। কিন্তু, গ্রিন হাউজ গ্যাসের সমীকরণটা নাহয় একটু পাশে সরিয়ে রেখে আরও নিকট ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করা যাক। প্রতিনিয়ত ক্রমবর্ধমান উৎপাদনে আমাদের জীবনে প্রবেশ করা এ প্লাস্টিকগুলোর শেষ ঠিকানা হচ্ছে কোথায়?
প্রতি বছর প্রায় ১৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্যের ঠাঁই হয় সমুদ্রে, যার মধ্যে ২৩৬ হাজার টন রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক তথা (মানুষের নখের চেয়ে ক্ষুদ্র আকারের) ছোট ছোট প্লাস্টিকের টুকরা। বছর বছর সংখ্যাগুলো যেন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধিও পাচ্ছে। সমুদ্রের তলদেশে এসব প্লাস্টিকের টুকরো বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে চাদরের মতো ঢেকে দেয়াকে বলা হয় প্লাস্টিক প্যাচ। ক্যালিফোর্নিয়া ও হাওয়াই এর মধ্যবর্তী প্লাস্টিক প্যাচটির আকার প্রায় টেক্সাস স্টেটের সমান। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বিশ্বজুড়ে প্রতি এক মিনিটে এক ট্রাক প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ফেলা হয়। শুধু উপকূলীয় অঞ্চলেই না, সমুদ্রের ১১ কিলোমিটার গভীরেও পাওয়া গেছে প্লাস্টিক বর্জ্য।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, ২০২০-এ এসে সমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১০ গুণ। আর এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রে (ওজনের বিচারে) মাছের চেয়ে প্লাস্টিকের পরিমাণ হবে বেশি।
একবার ভেবে দেখুন তো, কেমন হবে যদি সামনে খাবার থাকা সত্ত্বেও ক্ষুধায় আপনার মৃত্যু হয়? কিংবা আস্ত একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে আটকা পড়ে যদি দম বন্ধ হয়ে মারা যান?
সাধারণত, সমুদ্রের তলদেশে এসব ছোট ছোট প্লাস্টিকের টুকরোগুলোকে খাবার ভেবে ভুল করে খেয়ে ফেলার পর সামুদ্রিক প্রাণীদের জীবন মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ে যায়। কারণ, এসব প্লাস্টিক তাদের পাকস্থলীতে জমে থাকার ফলে সত্যিকারের খাবার খাওয়ার জায়গা থাকে না, আবার অজৈব পদার্থ হওয়ায় প্লাস্টিকগুলো পরিপাকও হয় না। ফলে দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেই মারা যায় অনেক প্রাণী। এছাড়াও, প্লাস্টিকের ধারালো কোণার আঘাতে দেহের অভ্যন্তরীণ ক্ষত থেকে পচন বা রক্তক্ষরণেও মৃত্যু হয়ে অনেক প্রাণীর।
খাবার গ্রহণের সময় গ্রাসের সাথে সাথে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিকের আবর্জনা প্রবেশ করে তিমি কিংবা বড় স্তন্যপায়ী প্রাণীদের পেটে। তাদেরও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। তাছাড়া, প্লাস্টিকের প্যাকেট কিংবা দড়িতে পেঁচিয়ে আটকে যাওয়ার মতো ব্যাপার তো অহরহই ঘটে। কেবল পানির নিচেই না, সমুদ্রের তীর বসবাসরত ৯৫% পাখির মৃত্যু হয় পেটে প্লাস্টিক যাবার কারণে। শুধুমাত্র ফেলে দেয়া দড়ি ও মাছ ধরার জালে আটকা পড়ার কারণেই প্রতি বছর ৩,০৮,০০০ ডলফিন, তিমিসহ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যু হয়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের তথ্যানুসারে, সমুদ্রে এই মুহূর্তে বিভিন্ন আকার আকৃতির ৫.২৫ ট্রিলিয়নেরও বেশি প্লাস্টিকের টুকরো রয়েছে। যার প্রতিটি হতে পারে অসংখ্য প্রাণীর মৃত্যুর কারণ।
কিন্তু এই চলমান সমস্যার পালে যেন নতুন করে হাওয়া দিয়েছে কোভিড-১৯। এ বছরের শুরুর দিকে যখন বিশ্বব্যাপী একের পর এক দেশে লকডাউনের ঘোষণা দেয়া হলো, তখন হুট করেই থেমে গেল কলকারখানা, রাস্তাঘাটে থামল যানবাহন চলাচল। উল্লেখযোগ্য হারে কমে এলো বায়ু দূষণ। পৃথিবী যেন হুট করেই একটু বেশি সবুজ হতে শুরু করল। বাতাসে কমে এলো দূষিত ও ক্ষতিকর উপাদানের পরিমাণ। প্রকৃতির জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত আশীর্বাদ রূপেই যেন হাজির হলো করোনাভাইরাস প্যানডেমিক।
কিন্তু, মাসকয়েক পরেই, বিভিন্ন দেশে একে একে লকডাউন তুলে নেয়া হচ্ছে। আর লকডাউন শেষে ‘নিউ নরমাল’ জীবনে ঘর থেকে বের হতে শুরু করেছে মানুষ। যেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় উপকরণের অন্যতম অংশ হয়ে উঠেছে পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই)। বডি স্যুট, ফেস শিল্ডের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম হলেও, মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভস এখন আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। নিরাপত্তায় নির্ভারতা খুঁজে নিয়ে নিয়মিত রুটিনে ফেরার চেষ্টা করছে সবাই।
কিন্তু, সম্প্রতি ফ্রান্সে প্রকাশিত এক চাঞ্চল্যকর তথ্য যেন আবারও দেখাচ্ছে অশনি সংকেত। করোনাভাইরাস প্যানডেমিকের ফলে দূষণ এবার এক ভয়ঙ্কর নতুন মাত্রা অতিক্রম করতে চলেছে। ফরাসি পরিবেশবাদী সংস্থা ‘অপেরেশন মেয়ো প্রোপ’ নিয়মিত নিকটবর্তী সমুদ্র এলাকায় প্লাস্টিকসহ ক্ষতিকর আবর্জনা পরিষ্কার অভিযান চালায়। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে তারা জানিয়েছে জানিয়েছে, তাদের স্কুবা ডাইভার টিম সমুদ্রে আশঙ্কাজনক পরিমাণের পিপিই বর্জ্য খুঁজে পাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান এ বর্জ্যের উপস্থিতি একেবারেই নতুন।
এক সাক্ষাৎকারে অপেরেশন মেয়ো প্রোপ এর অন্যতম সদস্য লরেন্ট লম্বার্ড বলেন,
এই পরিস্থিতি একেবারেই নতুন। এ ধরনের কোনো সমস্যা আগে কখনো দেখা যায়নি। গ্লাভস খুঁজে পাবার ব্যাপারটা আলাদা হলেও, মাস্ক তো আমি কখনোই এভাবে দেখিনি। করোনা সংকট শেষে, লকডাউন শেষে, মানুষ বের হতে শুরু করল। মাস্ক পরে রাস্তাঘাটে ঘোরাফেরা করতে করতে মুখ থেকে মাস্ক খুলে যেখানে সেখানে ফেলাও শুরু করল। তারই ফলস্বরূপ ধরে এসব খুঁজে পাচ্ছি আমরা। আর এখান থেকেই শুরু। এটাই এখন দূষণের নতুন এক অধ্যায়।
কেবল ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতাই নয়, রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া ছাড়া এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। যথাস্থানে পিপিই বর্জ্য ফেলা যেমন একজন নাগরিকের দায়িত্ব, তেমনি সেই বর্জ্যগুলোকে যথাযথ নীতিমালা মেনে নিষ্কাশন করাও নগর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব।
বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যেই যেখানে সেখানে পিপিই বর্জ্য ফেলা রোধে বিভিন্ন রকমের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। জনসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি অর্থদণ্ডও দেয়া হচ্ছে। ফ্রান্সে এ বছর মে মাসে যত্রতত্র পিপিই ফেলার শাস্তিতে জরিমানা বাড়িয়ে ৬৮ ইউরো থেকে ১৩৫ ইউরো করা হয়েছে।
লরেন্ট লম্বার্ড আরও বলেন,
আমরা এভাবে যেখানে সেখানে মাস্ক না ফেললে তো সমুদ্রে এসব খুঁজে পাওয়া যেত না। কারণ, সমুদ্রে পাওয়া ৮০ শতাংশ আবর্জনাই ভূমি অঞ্চল থেকে আসে। বৃষ্টির পানিতে ভেসে নদী নালা সহ বিভিন্ন পথ হয়ে সাগরে গিয়ে পড়ে। সবার প্রতি একটাই অনুরোধ থাকবে, আপনার আবর্জনাগুলো যথাস্থানে ফেলুন। যেখানে সেখানে ফেললে শেষ পর্যন্ত সেগুলো সমুদ্রে গিয়েই মিলবে। নিজের ও অন্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো এটাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
সংস্থাটির ডাইভারদের পাওয়া যেসব বর্জ্যকে ‘কোভিড ওয়েস্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে অসংখ্য ডিসপোজেবল মাস্ক, লেটেক্স হ্যান্ড গ্লাভস ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল। একটি সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক পুরোপুরি ভেঙে যেতে সময় নেয় প্রায় ৪৫০ বছর। ভাসমান মাস্ক ও গ্লাভসগুলোকে অনেক সময় জেলিফিশ ভেবে ভুল করে খেয়ে ফেলে ডলফিনসহ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীরা। অনেক মাস্কে পলিপ্রোপিলিনের মতো উপাদানও থাকে। সব মিলিয়ে, ক্ষতির দিক থেকে এগুলো টাইম বোমার চেয়ে কোনো অংশেই কম না। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এখন থেকেই যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া না হলে, করোনাভাইরাস প্যানডেমিক আঘাত হানবে ঝুঁকির মুখে থাকা সামুদ্রিক প্রাণীজগতে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে হংকংভিত্তিক সংস্থা ওশেনএশিয়া-ও একই ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিল। জনবসতিহীন প্রত্যন্ত দ্বীপ সোকো আইল্যান্ডে অভিযান চালিয়েও পিপিই বর্জ্য খুঁজে পায় তারা। সংস্থাটির সদস্য গ্যারি স্টোকস বলেন,
মাত্র ১০০ মিটার দৈর্ঘ্যের সমুদ্র সৈকতে প্রায় ৭০টি মাস্ক খুঁজে পাই আমরা। এক সপ্তাহ পর পাওয়া যায় আরও ৩০টি।
জনমানবশূন্য এই দ্বীপে এসব আবর্জনা দেখে কৌতূহলী হয়ে নিকটস্থ আরও কিছু সৈকতে অভিযান চালায় তারা এবং সবখানেই খুঁজে পাওয়া যায় এই পিপিই বর্জ্য। স্টোকস আরও বলেন,
এখন সবখানেই এই আবর্জনা পাওয়া যাচ্ছে। সামাজিক জীবনে এসবের ব্যবহার নিয়মিত হবার পর থেকে সমুদ্র অঞ্চলেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আরও কিছু ক্ষতিকর উপহার রেখে যাচ্ছি আমরা।
পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করে। তবে বাকি ৬০ শতাংশ মানুষ সমুদ্র অঞ্চল থেকে বহুদূরে বসবাস করলেও, কোনো না কোনোভাবে তাদের জীবনে সমুদ্র অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ঠিকই রয়েছে।
পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, প্যানডেমিক পরবর্তী বছরগুলোতে সামুদ্রিক জগতে প্লাস্টিক দূষণের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পাবে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগরে প্রতি বছর ৫৭০ হাজার টন প্লাস্টিক ফেলার পাশাপাশি প্রতি মিনিটে সমুদ্রে ফেলা হয় ৩৩,৮০০টি প্লাস্টিক বোতল। সামুদ্রিক জীবন কিংবা পরিবেশের কথা না ভাবলেও, অন্তত নিজেদের সুস্থতার স্বার্থে প্লাস্টিক ও পিপিই দূষণের প্রতি আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কারণ বছরের পর বছর সমুদ্রের পানিতে মিশে যাওয়া এসব মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা শেষ পর্যন্ত আমাদের কাছেই ফিরে আসবে নতুন কোনো আঘাত রূপে। আর প্যানডেমিক আক্রান্ত এ পৃথিবীতে সম্ভবত এটাই হতে চলেছে পরবর্তী প্যানডেমিকের সবচেয়ে বড় কারণ।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় পিপিই বা পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্টকেই সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে মানবজাতি। কিন্তু, এ অস্ত্র আমাদের রক্ষা করলেও, দিনশেষে কি এটাই হয়ে দাঁড়াবে কোটি কোটি প্রাণীর মৃত্যুর কারণ? আর প্রকৃতির কোলে বেঁচে থেকে প্রকৃতি ধ্বংস করে ডেকে আনা সেই ভয়ঙ্কর প্যানডেমিকের দায় কি আমরা কোনোভাবে এড়াতে পারব?