একপাশে সুউচ্চ আল্পস পর্বতমালা, আরেকদিকে নীল লেম্যান হ্রদ। আর এর মাঝখানে রয়েছে ইউরোপের অন্যতম প্রধান কূটনীতিক কেন্দ্র জেনেভা। রেডক্রসের সদর দপ্তর কিংবা জাতিসংঘের ইউরোপীয় সদর দপ্তরও এখানে, ইউরোপের ব্যাংক খাতও অনেকটা এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে এগুলো বাদ দিলেও জেনেভার আরেকটি নিজস্ব পরিচয় আছে, আর তা হলো জেনেভা মোটর শো। প্রতিবছর গ্রহের সবচেয়ে সেরা এবং নতুন গাড়িগুলো এখানে জড়ো করে অটোমোবাইল কোম্পানিগুলো। চোখধাঁধানো নজরকাড়া গাড়িগুলোর নামের পাশে প্রাইসট্যাগের অঙ্কটাও থাকে বেশ ভারি। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি, ২০১৯ সালের জেনেভা মোটর শোতে সবচেয়ে দামি গাড়ির রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে বুগাটির লা ভইচু নোয়াঁ (La Voiture Noire)। এছাড়াও বিএমডব্লিউ, ল্যাম্বোরঘিনি, ফেরারি, কোয়েনিসেগ, পোরশের নতুন গাড়ি থেকে শুরু করে অ্যাস্টন মার্টিন কিংবা অডির কনসেপ্ট কারগুলো তো রয়েছেই। ২০১৯ সালের জেনেভা মোটর শোতে এরকমই কিছু চমকে দেওয়া গাড়িগুলো দেখে নেওয়া যাক।
ফেরারি এফএইট ট্রিবিউটো
ফেরারির পুরনো 488 GTB-কে সরিয়ে দিয়ে সেখানে জায়গা করে নিয়েছে এফএইট ট্রিবিউটো। ৭২০ অশ্বক্ষমতার ইঞ্জিনের এই গাড়ি মাত্র ২.৯ সেকেন্ডের মধ্যেই ৬০ মাইল গতিবেগ ওঠাতে সক্ষম। তাছাড়া 488 GTB-এর তুলনায় এর অ্যারোডায়নামিক সক্ষমতাও ১০% বেশি। এবার ম্যাকলারেন 720S এর সাথে টক্কর দিতে প্রস্তুত হয়ে এসেছে ফেরারি।
ল্যাম্বোরঘিনি হুরাহকান এভো স্পাইডার
জেনেভাতে ল্যাম্বোরঘিনি একটি নয় বরং দুটি কনভার্টিবল গাড়ি নিয়ে এসেছে। আর দুটির মধ্যে তুলনামূলকভাবে ‘সাশ্রয়ী’ হলো হুরাহকান এভো স্পাইডার। মূলত হুরাহকান ক্যুপের সাসপেনশন ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনে পরিবর্তন করা হয়েছে। ৬৪০ অশ্বক্ষমতার ইঞ্জিনের সাহায্যে এটি ০ থেকে ৬২ মাইল গতিবেগ ওঠাতে সময় নেয় মাত্র ৩.১ সেকেন্ড।
ল্যাম্বোরঘিনি অ্যাভেন্টেডর এসজেভি রোডস্টার
হুরাহকান এভো স্পাইডার ছাড়াও দ্বিতীয় যে কনভার্টিবলটি ল্যাম্বোরঘিনি জেনেভাতে এনেছে সেটি হলো অ্যাভেন্টেডর এসজেভি রোডস্টার। বয়সের দিক থেকে একটু বেশি হলেও অ্যাভেন্টেডর মডেল এখনো আকর্ষণীয় ক্রেতাদের কাছে। তবে এসজেভি রোডস্টার মডেলটি হবে লিমিটেড এডিশন, মাত্র ৮০০টি তৈরি করা হবে এই অসাধারণ কনভার্টিবলটি। এর ৬.৫-লিটার ভিটুয়েলভ ইঞ্জিন ৭৭০ অশ্বক্ষমতা শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম, সাথে ২.৯ সেকেন্ড সময় নেয় ৬০ মাইল গতিবেগ ওঠাতে। একইসাথে ধনী এবং ল্যাম্বরঘিনিপ্রেমী হলে এই কনভার্টিবলটি তার জন্য মানানসই।
অ্যাস্টন মার্টিন ভ্যানকুইশ ভিশন কনসেপ্ট
তবে ল্যাম্বোরঘিনিই একমাত্র কোম্পানি নয় যারা তাদের নতুন দুটি সুপারকার জেনেভাতে এনেছে, তালিকাতে রয়েছে অ্যাস্টন মার্টিনের নামও। অ্যাস্টন মার্টিনের এই ভ্যানকুইশ ভিশন কনসেপ্ট গাড়িতে রয়েছে অ্যাস্টনের নতুন টুইন-টারবো ভি-সিক্স ইঞ্জিন।
অ্যাস্টন মার্টিন এএম-আরবি ০০৩
ভ্যানকুইশের পাশাপাশি জেনেভাতে এএম-আরবি ০০৩-কেও এনেছে অ্যাস্টন মার্টিন। অ্যাস্টন মার্টিন ভ্যালকাইরির রোড-ফ্রেন্ডলি সংস্করণ বলা যেতে পারে এই মডেলটিকে। অ্যাস্টনের নতুন ভি-সিক্স ইঞ্জিনও এই গাড়িতে প্রথম যুক্ত হতে যাচ্ছে। এএম-আরবি ০০৩-এর মাত্র মাত্র ৫০০টি গাড়ি তৈরি হবে বলে জানিয়েছে কোম্পানি কর্মকর্তারা, তবে একে বাজারে পাওয়া যাবে ২০২১ সাল থেকে।
জিনেটা আকুলা
শুধু ফেরারি-ল্যাম্বোরঘিনির মতো বিশাল নামীদামী ব্র্যান্ডগুলোই নয়, জেনেভা কাঁপাতে ছোটখাটো অটোমোবাইল কোম্পানিগুলোও তাদের সেরা গাড়িগুলো নিয়ে এসেছে। আর সেই তালিকায় রয়েছে যুক্তরাজ্যের অটোমোবাইল কোম্পানি জিনেটার ‘আকুলা’ গাড়িটি, রাশিয়ান ভাষায় যার অর্থ ‘হাঙর’। এর ভিএইট ইঞ্জিন ৫৭৫ অশ্বক্ষমতার হলেও এর অসাধারণ ডিজাইনের কারণে ওজন অনেক কমে গিয়েছে, ফলে এর গতিও আরও বেশি। মাত্র ২ হাজার পাউন্ড ওজনের চেয়ে সামান্য বেশি এই গাড়ি মাত্র ২০টি বানানো হবে, আর ইতোমধ্যেই ১২টি গাড়ি বিক্রি হয়ে গিয়েছে।
কোয়েনিসেগ জেসকো
বুগ্যাটি জেনেভাতে বিশ্বের সবচেয়ে দামী গাড়ি নিয়ে এসেছে, অন্যদিকে কোয়েনিসেগ নিয়ে এসেছে সম্ভাব্য সবচেয়ে দ্রুততম গাড়িটি। অনেক আগে থেকেই জল্পনা-কল্পনা চলছিলো অ্যাগেরাকে সরিয়ে দিয়ে নতুন কোনো গাড়িকে কোয়েনিসেগ তাদের মূল অস্ত্র বানাবে, আর সেটিই হলো এই জেসকো। টুইন-টার্বো ভিএইট ইঞ্জিনের সাহায্যে ১২৮০ অশ্বক্ষমতা উৎপাদন করতে পারে এই কোয়েনিসেগ জেসকো। কোয়েনিসেগের ভাষ্যমতে, শীঘ্রই এটি ৩০০ মাইল/ঘণ্টা গতিবেগের জেসকোর নতুন সংস্করণ আনতে যাচ্ছে, যা সুপারকারগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ গতিবেগসম্পন্ন হবে।
রিম্যাক সি_টু
রিম্যাক জেনেভাতে নিয়ে এসেছে তাদের কনসেপ্ট ওয়ানের উত্তরাধিকার সি_টুকে। এই অল-ইলেক্ট্রিক হাইপারকার চারটি ইলেক্ট্রিক মোটোরের সাহায্যে ১,৯১৪ অশ্বক্ষমতা উৎপাদন করতে সক্ষম! এছাড়াও মাত্র ১.৮৫ সেকেন্ডেই এটি ৬০ মাইল/ঘণ্টা গতিবেগ ওঠাতে সক্ষম। ২০২০ সালের মধ্যেই এটি পুরোদমে বাজারে ছাড়তে চায় রিম্যাক।
পিনিনফারিনা বাতিস্তা
জেনেভাতে ইতালি থেকে আসা সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন গাড়িটি ল্যাম্বোরঘিনি বা ফেরারি নিয়ে আসেনি, বরং নিয়ে এসেছে ‘সুন্দর ও স্টাইলিশ’ গাড়ির জন্য বিখ্যাত পিনিনফারিনা কোম্পানি! পিনিনফারিনা প্রায় সবটুকুই নিজেদের যন্ত্রাংশ দিয়েই বাতিস্তা গাড়িটি তৈরি করার চেষ্টা করেছে, যদিও রিম্যাকের চেসিস আর ১৯০০ অশ্বক্ষমতার ইলেক্ট্রিক মোটর এতে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ২ সেকেন্ডের কম সময়ের মধ্যেই এটি ৬০ মাইল/ঘণ্টা গতিবেগ উঠাতে সক্ষম, যা সর্বোচ্চ ২৮০ মাইল/ঘণ্টা পর্যন্ত উঠতে পারবে। মাত্র ১৫০টি বাতিস্তা তৈরি করবে পিনিনফারিনা।
জেনেভা মোটর শো-এর মূল আকর্ষণ দেখার আগে দেখে নেওয়া যাক এখানে আসা অন্যান্য বড় কোম্পানিগুলোর অসাধারণ গাড়িগুলো।
-
মিতসুবিশি এঙ্গেলবার্গ ট্যুরার
-
লাগোন্ডা অল-টিরেইন কনসেপ্ট
-
অডি কিউফোর ই-ট্রন
-
বিএমডব্লিউ সেভেন সিরিজ
-
বেন্টলি মুলসান ডব্লিউও
-
টয়োটা জিআর সুপ্রা
-
মার্সিডিজ বেঞ্জ সিএলএ শ্যুটিং ব্রেক
-
হোন্ডা ই প্রোটোটাইপ
-
নিসান আইএমকিউ কনসেপ্ট
বুগাটি লা ভইচু নোয়াঁ
জেনেভা মোটর শো এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় গাড়িটি ছিল ১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বুগাটি ‘লা ভইচু নোয়াঁ (La Voiture Noire), যা একে বানিয়ে দিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দামী গাড়ি। তবে খারাপ সংবাদটি হচ্ছে, আপনার কাছে ১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থাকলেও তা আপনি কিনতে পারবেন না, কারণ মাত্র একটিই লা ভইচু নোয়াঁ বানানো হয়েছে, এবং তা একজন বুগাটিপ্রেমী কিনেও ফেলেছেন! বুগাটি কোম্পানির ১১০ বছর বয়স হওয়া উপলক্ষে এই বিশেষ গাড়িটি তৈরি করেছে তারা। বুগাটির প্রতিষ্ঠাতা জাঁ বুগাটির সম্পূর্ণ কালো রঙয়ের বিখ্যাত টাইপ ফিফটিসেভেন আটলান্টিকের মতো করে এটিও সম্পূর্ণ কালো রঙ করা হয়েছে। এর নাম অর্থাৎ লা ভইচু নোয়াঁর অর্থও হচ্ছে ‘দ্য ব্ল্যাক কার’। এর ৮ লিটার কোয়াড-টার্বো ডব্লিউসিক্সটিন ইঞ্জিন ১৪৭৯ অশ্বক্ষমতা শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম।