২০২৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় যে, আজারবাইজানি সশস্ত্রবাহিনী একটি বৃহৎ মাত্রার সামরিক মহড়ার উদ্দেশ্যে সামরিক সরঞ্জাম স্থানান্তর করতে শুরু করেছে এবং উক্ত সরঞ্জামগুলোর ওপরে ‘A’, ‘F’, ‘∆’ প্রভৃতি চিহ্ন অঙ্কিত রয়েছে। একই সময়ে তুরস্ক ও ইসরায়েল থেকে আগত সামরিক পরিবহন বিমান আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অবতরণ করতে শুরু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এরকম একটি ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, আজারবাইজান আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে নতুন করে একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং সামরিক মহড়ার আড়ালে আর্মেনীয়–আজারবাইজানি সীমান্তের কাছে সৈন্য সমাবেশ করছে। উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশ ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর আগে রুশ সশস্ত্রবাহিনী একইভাবে সামরিক মহড়ার আড়ালে রুশ–ইউক্রেনীয় সীমান্তের কাছে সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছিল এবং রুশ সামরিক সরঞ্জামগুলোর ওপরে ‘Z’, ‘V’, ‘O’ প্রভৃতি চিহ্ন অঙ্কিত ছিল। রাশিয়া ও ইউক্রেন এবং আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার অস্ত্রভাণ্ডারের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ সোভিয়েত-নির্মিত, সুতরাং শত্রুর সামরিক সরঞ্জাম থেকে নিজেদের সামরিক সরঞ্জাম আলাদা করার জন্য এরকম চিহ্ন সংযোজন করা হয়।
আর্মেনীয়–আজারবাইজানি দ্বন্দ্বের পটভূমি
আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যবর্তী দ্বন্দ্ব শতাব্দীপ্রাচীন। ১৯০৫–১৯০৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ককেশাস অঞ্চলে মুসলিম (সেসময় ‘ককেশিয়ান তাতার’ নামে পরিচিত ছিল) এবং আর্মেনীয়দের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ১৯১৮ সালে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া রাশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে একটি প্রলম্বিত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯১৮–১৯২০ সালে সংঘটিত প্রথম আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের ফলে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার একাংশ সোভিয়েত রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং আর্মেনিয়ার বাকি অংশ তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সোভিয়েত সরকার জাতিগত আর্মেনীয়-অধ্যুষিত নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলকে আজারবাইজানি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করে, কিন্তু একইসঙ্গে নাগর্নো-কারাবাখকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে। আর্মেনিয়া ও নাগর্নো-কারাবাখের আর্মেনীয়রা এই সমাধানে সন্তুষ্ট ছিল না, এবং ১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েত সরকারের দুর্বলতার পরিপ্রেক্ষিতে নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
১৯৮৮–১৯৯৪ সালে দ্বিতীয় আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে নাগর্নো-কারাবাখের আর্মেনীয়রা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ‘আর্তসাখ প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করে। এই যুদ্ধে আর্মেনিয়া ও আর্তসাখ আজারবাইজানকে পরাজিত করে এবং যুদ্ধের ফলে প্রাক্তন নাগর্নো-কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশসহ এর পার্শ্ববর্তী সাতটি আজারবাইজানি জেলার সম্পূর্ণ/আংশিক ভূখণ্ড আর্তসাখের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আর্মেনিয়া আর্তসাখকে সর্বতোভাবে সহায়তা করে, কিন্তু এখন পর্যন্ত আর্মেনিয়া বা জাতিসংঘের অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্র আর্তসাখকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। অর্থাৎ, আর্তসাখ-নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে আজারবাইজানের ভূখণ্ড।
২০২০ সালে সংঘটিত তৃতীয় আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধে আজারবাইজান আর্মেনিয়া ও আর্তসাখকে পরাজিত করে এবং আর্তসাখ-নিয়ন্ত্রিত সাতটি আজারবাইজানি জেলা ও প্রাক্তন নাগর্নো-কারাবাখের অংশবিশেষ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। তদুপরি, যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুসারে আর্মেনিয়া নিজস্ব ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে আজারবাইজানি মূল ভূখণ্ড ও আজারবাইজানি-নিয়ন্ত্রিত নাখচিভান প্রজাতন্ত্রকে (এবং তুরস্ককে) সংযুক্তকারী একটি করিডোর প্রদান করতে সম্মত হয়। উক্ত করিডোরটি আর্মেনিয়ার সিউনিক প্রদেশের মধ্য দিয়ে স্থাপিত হওয়ার কথা। আজারবাইজানিরা সিউনিককে ‘জাঙ্গেজুর’ নামে অভিহিত করে এবং উক্ত করিডোরকে ‘জাঙ্গেজুর করিডোর’ নামে আখ্যায়িত করে। কিন্তু ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আর্মেনিয়া আজারবাইজানকে উক্ত করিডোর প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানায়।
এমতাবস্থায় আজারবাইজানের মূল লক্ষ্য দুইটি — আর্তসাখ-নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডের উপর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা এবং ‘জাঙ্গেজুর করিডোর’ উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য আর্মেনিয়াকে বাধ্য করা। যুদ্ধের পর আর্মেনিয়া আজারবাইজানকে উক্ত করিডোর দিতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে ২০২১ সালের মে থেকে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ চলছে এবং আজারবাইজান আর্মেনিয়ার সিউনিক ও গেঘারকুনিক প্রদেশদ্বয়ের কিছু সীমান্তবর্তী অঞ্চল (প্রায় ৫০ থেকে ২১৫ বর্গ কি.মি. ভূখণ্ড) দখল করে রেখেছে।
এদিকে ২০২০ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুসারে আর্তসাখে পাঁচ বছরের জন্য রুশ শান্তিরক্ষী সৈন্যদল মোতায়েন করা হয়েছে এবং এমতাবস্থায় ২০২৫ সালের আগে আজারবাইজান আর্তসাখের বিরুদ্ধে আক্রমণাভিযান পরিচালনা করবে, এরকম সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু আর্তসাখের ওপর চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে আজারবাইজান ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে আর্তসাখের উপর অবরোধ আরোপ করে রেখেছে এবং এর ফলে আর্মেনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন আর্তসাখে একটি গুরুতর মানবিক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে।
অর্থাৎ, ২০২১ সালের মে থেকে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে একটি নতুন সংঘর্ষ চলমান।
আর্মেনীয় কূটনীতি এবং আঞ্চলিক ভারসাম্যের পরিবর্তন
কার্যত, ১৯৮৮–১৯৯৪ সালের যুদ্ধের পর আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যবর্তী সামরিক ভারসাম্য আর্মেনিয়ার পক্ষে ছিল। আর্মেনীয় ও আর্তসাখ সশস্ত্রবাহিনীদ্বয় আজারবাইজানি সশস্ত্রবাহিনীর তুলনায় অধিকতর দক্ষ ও মনোবলসম্পন্ন ছিল; রাশিয়ার সঙ্গে আর্মেনিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল; এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সক্রিয় প্রভাবশালী আর্মেনীয় লবির প্রভাবে আর্মেনীয়–আজারবাইজানি দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল। কিন্তু আজারবাইজান উক্ত যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য দৃঢ়সংকল্প ছিল। আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি হায়দার আলিয়েভ ও ইলহাম আলিয়েভ রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার মধ্য দিয়ে রুশ–আর্মেনীয় মৈত্রীকে বহুলাংশে শিথিল করতে সক্ষম হন, তুরস্ক ও ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি লবির সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে সেখানকার আর্মেনীয় লবির প্রভাবকে নিষ্ক্রিয় করার প্রচেষ্টা চালান। তদুপরি, আজারবাইজান তার সশস্ত্রবাহিনীকে নতুন করে গড়ে তোলে এবং রাশিয়া, তুরস্ক ও ইসরায়েল থেকে আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের মাধ্যমে সশস্ত্রবাহিনীর আধুনিকায়ন ঘটায়।
উল্লেখ্য, কার্যত আর্মেনিয়ার একমাত্র সামরিক মিত্র হচ্ছে রাশিয়া। আর্মেনিয়া রাশিয়ার চুক্তিবদ্ধ সামরিক মিত্র, রুশ-নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট সিএসটিও ও জয়েন্ট সিআইএস এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের অংশ এবং রুশ-নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক জোট ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নের সদস্য। আর্মেনিয়ায় রুশ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে এবং রুশ সীমান্তরক্ষীরা তুর্কি–আর্মেনীয় সীমান্ত প্রহরা দেয়। আর্মেনীয় রাষ্ট্রনায়করা স্পষ্টভাবেই জানতেন যে, বৃহত্তর ও অধিক সমৃদ্ধিশালী আজারবাইজানের বিরুদ্ধে আর্মেনিয়ার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি, কারণ রাশিয়া ব্যতীত অন্য কোনো বৃহৎ শক্তি আর্মেনিয়ার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করতে প্রস্তুত ছিল না।
কিন্তু ২০১৮ সালে আর্মেনিয়ায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে এবং এর মধ্যে দিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যবর্তী সামরিক ভারসাম্য আজারবাইজানের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ২০১৮ সালে আর্মেনিয়ায় সংঘটিত একটি ‘রঙিন বিপ্লবে’র ফলে আর্মেনীয় প্রধানমন্ত্রী (ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি) সের্ঝ সার্গসিয়ান ক্ষমতাচ্যুত হন এবং নিকোল পাশিনিয়ান প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন। পাশিনিয়ান একজন পশ্চিমাপন্থী ও রুশবিরোধী রাজনীতিবিদ। তিনি আর্মেনিয়ার জয়েন্ট সিআইএস এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ও ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নে যোগদানের বিরোধী ছিলেন এবং আর্মেনিয়ায় অবস্থিত রুশ সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করে দেয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। তদুপরি, তিনি আর্মেনীয় রাজনীতিতে আর্তসাখ থেকে আগত আর্মেনীয় রাজনীতিবিদদের প্রভাবের তীব্র বিরোধী ছিলেন।
পাশিনিয়ান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক মৈত্রী ছিন্ন করা থেকে বিরত থাকেন, কারণ সেটি হতো আর্মেনিয়ার জন্য একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ। কিন্তু তিনি এমন বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যার ফলে রুশ–আর্মেনীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তিনি এমন বেশকিছু ব্যক্তিকে আর্মেনীয় মন্ত্রিপরিষদের অন্তর্ভুক্ত করেন যারা আর্মেনিয়ায় পশ্চিমা-অর্থায়িত বিভিন্ন এনজিওর সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তার সরকার বেশকিছু রুশপন্থী আর্মেনীয় রাজনীতিবিদ ও সামরিক কর্মকর্তাকে বিচারের মুখোমুখি করে। এদের মধ্যে ছিলেন প্রাক্তন আর্মেনীয় রাষ্ট্রপতি সের্ঝ সার্গসিয়ান ও রবার্ট কোচারিয়ান এবং সিএসটিওর তদানীন্তন মহাসচিব কর্নেল-জেনারেল ইউরি খাৎচাতুরভ। আর্মেনীয় প্রচারমাধ্যম ক্রমশ রুশবিরোধী প্রচারণা চালাতে থাকে। এসবের ফলে রুশ–আর্মেনীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে।
অবশ্য পাশিনিয়ান রাশিয়াকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য কিছু প্রতীকী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আর্মেনিয়া সিরিয়ায় ‘মানবিক সহায়তা’র উদ্দেশ্যে ৮৩ সদস্যের একটি ক্ষুদ্র সৈন্যদল প্রেরণ করে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়া সিরীয় গৃহযুদ্ধে সিরীয় সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করছে, এবং আর্মেনিয়ার এই পদক্ষেপ ছিল সিরিয়ায় রুশ সামরিক অভিযানের প্রতি সুস্পষ্ট সমর্থন। কিন্তু রুশ–আর্মেনীয় সম্পর্কের ক্রমাবনতি রোধ করার জন্য এটি যথেষ্ট ছিল না। তদুপরি, পাশিনিয়ান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর আর্মেনিয়া ও আর্তসাখের মধ্যবর্তী সম্পর্কের অবনতি ঘটে, কারণ পাশিনিয়ান শুরু থেকে আর্মেনিয়ায় আর্তসাখি রাজনীতিবিদদের প্রভাবের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং আর্তসাখি রাষ্ট্রনায়করাও পাশিনিয়ানের উত্থানকে ইতিবাচকভাবে দেখেননি। সর্বোপরি, ২০১৯ সালের আগস্টে পাশিনিয়ান আর্তসাখ সফর করেন এবং সেখানকার একটি জনসভায় আর্মেনিয়া ও আর্তসাখকে একত্রিত করার আহ্বান জানান। ইতিপূর্বে কোনো আর্মেনীয় রাষ্ট্রনায়ক আর্তসাখকে আর্মেনিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেননি। ফলে পাশিনিয়ানের এই পদক্ষেপ আজারবাইজানকে ক্ষিপ্ত করে।
এভাবে পাশিনিয়ান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর আর্মেনিয়ার সঙ্গে রাশিয়া, আর্তসাখ ও আজারবাইজান সকলেরই সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এমতাবস্থায় ২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের সময় রাশিয়া আর্মেনিয়াকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে, কিন্তু আর্মেনিয়ার পক্ষে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে। এই যুদ্ধ চলাকালে আর্মেনিয়া পূর্ণ সৈন্য সমাবেশ করা থেকে বিরত থাকে এবং এটি যুদ্ধে আর্মেনিয়ার অবস্থানকে দুর্বল করে ফেলে। অবশ্য ৯ নভেম্বর আজারবাইজানি সৈন্যরা আর্মেনীয় ভূখণ্ডে একটি রুশ হেলিকপ্টার ধ্বংস করলে যুদ্ধে রুশ হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা দেখা দেয় এবং এমতাবস্থায় আজারবাইজান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। উক্ত যুদ্ধবিরতি চুক্তির ফলে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া আর্তসাখে রুশ সৈন্য মোতায়েনের বিষয়ে সম্মতি প্রদান করে এবং এর ফলে আর্তসাখ পরিপূর্ণভাবে বিলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়।
২০২১ সালে আর্মেনীয়–আজারবাইজানি সীমান্ত সংঘর্ষ শুরুর পর আর্মেনিয়া সিএসটিওর কাছে সামরিক সহায়তা প্রার্থনা করে। রাশিয়া ও সিএসটিও আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে সংঘাত নিরসনের জন্য মধ্যস্থতা করে, কিন্তু আর্মেনিয়াকে সামরিক সহায়তা প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানায়। আর্মেনিয়া ২০২০ সালে সম্পাদিত যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করা সত্ত্বেও চুক্তির শর্তানুসারে আজারবাইজানকে করিডোর দিচ্ছে না এবং এটি এই সীমান্ত সংঘাতের মূল কারণ। সুতরাং সিএসটিওর বাকি সদস্যদের দৃষ্টিকোণ থেকে এই সংঘাতের জন্য আর্মেনিয়াই দায়ী। তদুপরি, সিএসটিওর বাকি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আজারবাইজানের সুসম্পর্ক বিদ্যমান এবং এমতাবস্থায় তারা আর্মেনিয়ার হয়ে আজারবাইজানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আগ্রহী নয়। সর্বোপরি, রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর দুই দিন আগে (অর্থাৎ ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি) রাশিয়া ও আজারবাইজান “মিত্রসুলভ মিথষ্ক্রিয়া সংক্রান্ত ঘোষণা” করে এবং ঘোষণাটির ১৭ নং ধারা অনুসারে রাশিয়া ও আজারবাইজান একে অপরের ওপর কোনো ধরনের আক্রমণ পরিচালনা থেকে বিরত থাকার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। এমতাবস্থায় রাশিয়ার আর্মেনিয়ার জন্য আজারবাইজানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে, এরকম সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে ওঠে।
তদুপরি, রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর পর আর্মেনিয়া এই যুদ্ধে রাশিয়াকে সমর্থন প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানায়। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আর্মেনীয় সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সনদ স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া শুরু করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে, এবং এমতাবস্থায় আর্মেনিয়ার এই সনদ স্বাক্ষরের অর্থ হচ্ছে পুতিন কখনো আর্মেনিয়া সফরে এলে আর্মেনীয় সরকার তাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হবে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আর্মেনিয়া তার ভূখণ্ডে সিএসটিওকে মহড়া করতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। জুনে পাশিনিয়ান ঘোষণা করেন যে, রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধে আর্মেনিয়া রাশিয়ার মিত্র নয়। সেপ্টেম্বরে পাশিনিয়ান মন্তব্য করেন যে, নিরাপত্তার জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভর করা আর্মেনিয়ার একটি ‘কৌশলগত ভুল’ ছিল। এসময় আর্মেনিয়া সিএসটিও থেকে তাদের স্থায়ী প্রতিনিধি ভিক্তর বিয়াগভকে প্রত্যাহার করে নেয়, ইউক্রেনে প্রথম বারের মতো ‘মানবিক সহায়তা’ প্রেরণ করে এবং আর্মেনীয় ভূখণ্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ মহড়ায় অংশগ্রহণ করে। আর্মেনিয়ার এসব পদক্ষেপ রুশ–আর্মেনীয় সম্পর্কে নতুন করে তিক্ততার সৃষ্টি করেছে।
তদুপরি, আর্মেনিয়া কার্যত আর্তসাখকে পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২২ সাল থেকে আর্মেনিয়া ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে, তারা আর্তসাখকে আজারবাইজানের অংশ হিসেবে মেনে নিতে প্রস্তুত। ২০২৩ সালের মে মাসে পাশিনিয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে আর্তসাখকে আজারবাইজানের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। সেপ্টেম্বরে সামভেল শাহরামানিয়ান আর্তসাখের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর পাশিনিয়ান তাকে শুভেচ্ছা জানানো থেকে বিরত থাকেন। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আর্মেনিয়া আর্তসাখকে বিসর্জন দিয়ে নিজস্ব ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, রাশিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্ব আর্মেনিয়াকে কার্যত আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। পশ্চিমাপন্থী আর্মেনীয় সরকার যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে আজারবাইজানের বিরুদ্ধে সহায়তা আশা করছে এবং ভারতের কাছ থেকে অস্ত্র কিনছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স আর্মেনিয়ার পক্ষে কিছু প্রতীকী পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন: ফরাসি আইনসভা আর্তসাখকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। তদুপরি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর্মেনীয়–আজারবাইজানি সীমান্ত পর্যবেক্ষণের জন্য আর্মেনিয়ায় একটি বেসামরিক মিশন প্রেরণ করেছে। কিন্তু আজারবাইজানের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন, প্যারিস বা ব্রাসেলস আর্মেনিয়াকে বিস্তৃত সামরিক সহায়তা প্রদান করবে, এরকম সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আর্মেনিয়ার তুলনায় তুরস্ক ও আজারবাইজান কৌশলগতভাবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ ককেশাসে ফ্রান্সের এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক স্বার্থ নেই যেজন্য ফ্রান্স আজারবাইজানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রুশ প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা হ্রাস করার জন্য আজারবাইজানি গ্যাস আমদানিতে আগ্রহী এবং এমতাবস্থায় আজারবাইজানের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয়া তাদের স্বার্থের অনুকূল নয়।
রাশিয়া ব্যতীত একমাত্র যে রাষ্ট্রটি আজারবাইজানের বিরুদ্ধে আর্মেনিয়াকে সহায়তা করতে পারে, সেটি হচ্ছে ইরান। আজারবাইজানের ক্রমবর্ধমান শক্তিসামর্থ্য, ‘জাঙ্গেজুর করিডোরে’র বাস্তবায়ন এবং তুর্কি–আজারবাইজানি ও ইসরায়েলি–আজারবাইজানি মৈত্রী ইরানি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি। সম্প্রতি নানাবিধ কারণে ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যবর্তী সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছে। নিজস্ব ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারণে ইরান আজারবাইজান কর্তৃক আর্মেনীয় ভূখণ্ড অধিকারকে সমর্থন করে না। কিন্তু পশ্চিমাপন্থী আর্মেনীয় সরকার ইরানের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিশেষ কোনো প্রচেষ্টা চালায়নি এবং ইরানের সঙ্গে সামরিক মৈত্রী স্থাপনের বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেনি। এমতাবস্থায় আজারবাইজানের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধে ইরান আর্মেনিয়ার পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে, এরকম সম্ভাবনা কম। তদুপরি, ইরান আজারবাইজানের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে সেক্ষেত্রে তুরস্ক আজারবাইজানের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারে। এরকম পরিস্থিতি ইরানের জন্য লাভজনক নয়।
অর্থাৎ, আর্মেনিয়ার কৌশলগত পরিস্থিতি এখন খুবই নাজুক। আর্মেনিয়া বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে রাশিয়া ও ইরানকে অসন্তুষ্ট করেছে, এবং এমতাবস্থায় তারা আর্মেনিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করবে, এরকম সম্ভাবনা কম। আর্তসাখের সঙ্গে আর্মেনিয়ার সম্পর্কের গুরুতর অবনতি ঘটেছে। আর্মেনিয়া পশ্চিমা বিশ্বের সাহায্য আশা করছে, কিন্তু কার্যত পশ্চিমা বিশ্ব তাদেরকে সাহায্য করবে বলে প্রতীয়মান হয় না। তদুপরি, আর্মেনিয়া যুদ্ধের জন্য কোনো ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে না। অন্যদিকে, আজারবাইজান সম্ভাব্য যুদ্ধে বিস্তৃত তুর্কি সমর্থন লাভ করবে এবং তারা সুস্পষ্টভাবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আজারবাইজানের দুইটি মূল লক্ষ্যের একটি কার্যত ইতোমধ্যেই অর্জিত হয়েছে। আর্মেনিয়া আর্তসাখকে আজারবাইজানের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, আজারবাইজান আর্তসাখকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে এবং এরকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে আর্তসাখ আজারবাইজানের নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। আর্তসাখকে পরিত্যাগ করে আর্মেনিয়া নিজস্ব ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা করতে চাচ্ছে, কিন্তু ‘জাঙ্গেজুর করিডোর’ উন্মুক্ত করা আজারবাইজানের আরেকটি প্রধান লক্ষ্য এবং আজারবাইজান এই লক্ষ্য পূরণ করতে বদ্ধপরিকর বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ২০২১ সাল থেকে আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি আলিয়েভ বারবার ইয়েরেভান, সিউনিক (জাঙ্গেজুর) ও গেঘারকুনিক (সেভান) অঞ্চলকে ‘ঐতিহাসিক আজারবাইজানি ভূখণ্ড’ হিসেবে দাবি করেছেন এবং আজারবাইজানি প্রচারমাধ্যম এই দাবিগুলোকে ব্যাপকভাবে প্রচার করেছে। প্রতীয়মান হয় যে, ২০২০ সালের যুদ্ধে এবং ২০২১ সাল থেকে চলমান সীমান্ত সংঘর্ষে ক্রমাগত সামরিক সাফল্যের ফলে আজারবাইজান অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠেছে।
এমতাবস্থায় রাশিয়া কিংবা পশ্চিমা বিশ্ব যদি আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে একটি সমঝোতা স্থাপন করতে সক্ষম হয়, সেক্ষেত্রেই কেবল যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হবে। এরকম সমঝোতার ক্ষেত্রে আর্মেনিয়া আজারবাইজানকে ‘জাঙ্গেজুর করিডোরে’র বিষয়ে ছাড় দিতে বাধ্য হবে, এরকম সম্ভাবনাই বেশি। অন্যথায় বর্তমান পরিস্থিতি চলমান থাকলে চতুর্থ আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের সূচনা সময়ের ব্যাপার মাত্র।