দাতব্য কাজ মূলত দুটি কারণে করি। এটি একাধারে অর্থপূর্ণ ও চমৎকার
বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের এক বার্ষিক রিপোর্টে নিজের দাতব্য কাজ নিয়ে এভাবেই অভিব্যাক্তি ব্যক্ত করেন বিল গেটস।
বিল গেটস নাম শুনলেই করলেই সর্বপ্রথম সবার মানসপটে ভেসে উঠবে পৃথিবীর সেরা ধনকুবের এর কথা। সকলেই তাকে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে চেনেন। প্রযুক্তিজগৎ বদলে দেয়া মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা কিংবা পৃথিবীর সেরা ধনকুবের পরিচয়ের বাইরেও তার অনেক বড় পরিচয় আছে।
বিল গেটস প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেন পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, বাসস্থান, দারিদ্র্য বিমোচনসহ এমন কোনো খাত নেই যেখানে ব্যয় করেননি তিনি!
শুধু বিত্ত-বৈভবের দিক দিয়ে বিল গেটস সবার সেরা নন, উদারতা কিংবা মানবিকতার দিক দিয়েও পৃথিবীতে অসামান্য নজির স্থাপন করে চলেছেন তিনি। মৃত্যুর পরে বিল গেটস তার আয়ের ৯৯.৯৬ শতাংশ দান করে দেবেন এবং সন্তানেরা তার মৃত্যুর পর মাত্র ৩০ মিলিয়ন ডলার পাবে। বর্তমানে তার সম্পদের মূল্যমান ১০৫ বিলিয়ন ডলার প্রায়। তাকে সর্বকালের অন্যতম সেরা দানবীর বললেও অত্যুক্তি হবে না।
বিল গেটস মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পৃথিবীর প্রযুক্তি দুনিয়ার খোলনলচে পাল্টে দেন। পৃথিবীকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। আর বর্তমানে গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পৃথিবীর অনগ্রসর কোটি মানুষের ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন করছেন তিনি।
বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন
বিল গেটস ও তার স্ত্রী মেলিন্ডা গেটসের নিজস্ব উদ্যোগে বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০০ সালে। সে থেকে আজ অবধি পৃথিবীর অবহেলিত জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার ফাউন্ডেশনটি খরচ করে চলেছে। এটি বর্তমানে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দাতব্য সংস্থা। সংস্থাটি এখন পর্যন্ত ৫০ বিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ ব্যয় করেছে দাতব্য কাজে।
এশিয়া-আফ্রিকার অনুন্নত দেশসমূহে প্রতিবছর বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। একটি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, সচেতন, শিক্ষিত ও স্বাস্থ্যবান বিশ্ব গড়ে তোলা এ সংস্থার প্রধান উদ্দেশ্য। সংস্থাটি টেকসই শিক্ষা ব্যবস্থা, অনুন্নত দেশগুলোতে স্বাস্থ্য খাতে অনুদান, কৃষি খাতের আধুনিকায়ন, প্রাণঘাতী ব্যাধির ভ্যাকসিন আবিষ্কারে বিনিয়োগ ও অনুন্নত দেশগুলোতে অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে থাকে। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, বিল গেটসের দাতব্য সংস্থা কোনো ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাদের দাতব্য কাজ চালায় না, পৃথিবীর প্রতি নিজেদের দায়িত্ববোধ থেকেই তারা এমনটা করে থাকে।
শিক্ষাখাতে অবদান
১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পিছিয়ে পড়া ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য উইলিয়াম এইচ ফাউন্ডেশন (দ্য বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের আগের নাম) ১,৫২৫ কোটি ডলারের বৃত্তি দেয়, যা শিক্ষাখাতে আমেরিকার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সর্বাধিক অনুদান। এ অনুদান আমেরিকায় উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। এর মাধ্যমে প্রতি বছর ১,০০০ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় সহায়তা লাভ করে।
স্নাতক সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদের জন্য ২০০০ সালে বিল গেটস ‘গেটস কেমব্রিজ’ বৃত্তি চালু করেন। ’গেটস কেমব্রিজ’ বৃত্তি বর্তমান পৃথিবীতে আর্থিক অনুদানের দিক দিয়ে সর্ববৃহৎ ও সেরা শিক্ষাবৃত্তি। এ বৃত্তির আওতায় প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শতাধিক মেধাবী মেধাবৃত্তি পেয়ে থাকে।
- সংস্থাটি কে -১২ প্রকল্পের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষার উন্নয়নে ২০০৯ সালে ৩৭৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করে।
- ২০১৮ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ ও আফ্রিকার অনুন্নত ১০ দেশে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতিকল্পে ৬৮ মিলিয়ন ডলার অনুদান প্রদান করে।
- এমআইটিসহ সারা বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুলে প্রতিবছর শিক্ষা বিস্তার ও আধুনিকায়নে কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেন বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।
স্বাস্থ্য
অনগ্রসর দেশসমূহে দ্য বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন প্রচুর পরিমাণ অর্থ দান করে থাকে।প্রতিবছর প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার তারা ব্যয় করে স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে।
১৯৯৯ সালে গেটস ফাউন্ডেশন গাবিকে (প্রাণঘাতী রোগের ভ্যাকসিন ও টিকা আবিষ্কারে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক সংস্থা) ৭৫ কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তা দেয়। ২০০৫ সালে আরও ৩৭ কোটি ৫০ লক্ষ ডলারের আর্থিক সহায়তা দেয়। ২০০৭ সালে তারা গাবিকে আবারও ৯৫ কোটি ৭০ লাখ ডলারের অনুদান দেয়, যার মাধ্যমে পৃথিবীর অনুন্নত ৭৪টি দেশ স্বাস্থ্যখাতে সাহায্য পেয়ে থাকে প্রতিবছর। তাদের এ অর্থ মূলত নিউমোনিয়া, পোলিও, ম্যালেরিয়া রোগের ভ্যাকসিন তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
- বিল গেটস ২০০৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে ৬৮ কোটি ২৩ লাখ মার্কিন ডলারের অনুদান দেন পোলিও প্রতিরোধের জন্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফান্ডে ইতিহাসে এত টাকা আর কোনো ব্যক্তি একসাথে দেননি।
- ২০০৬ ও ২০১১ সালে বিল গেটস এইডস, টিবি এবং ম্যালেরিয়া প্রতিরোধকল্পে বৈশ্বিক তহবিলে ৫০ কোটি ও ৭৫ কোটি ডলারের আর্থিক অনুদান দেন।
- ২০১২ সালে ফাউন্ডেশনটি ২০ কোটি ৭৭ লক্ষ ডলারের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে ‘গ্লোবাল টিবি ভ্যাকসিন ফাউন্ডেশন’কে।
বর্তমানে মহামারী করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে ১৫০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। প্রয়োজনে তা ২৫০ মিলিয়ন ডলারের উন্নীত করার আশ্বাস দিয়েছেন বিল গেটস।
আফ্রিকা মহাদেশের ১০টি দেশ এবং ৪৫টি জাতির মধ্যে নিয়মিত স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি, স্যানিটেশন
রোগ প্রতিরোধ, গবেষণা এবং স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।
এছাড়া সারা বিশ্বে মাতৃস্বাস্থ্য, শিশু স্বাস্থ্য, নতুন জন্ম নেয়া শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথেই কাজ করে যাচ্ছে ফাউন্ডেশনটি। উপরোক্ত কাজগুলো ছাড়াও পৃথিবী জুড়ে নিরাপদ পানি, মানসম্মত টয়লেট নিশ্চিতকরণে কাজ করছে তারা।
কৃষির উন্নয়ন
কৃষির আধুনিকায়ন এবং উন্নয়নের জন্য বিল গেটস যুগান্তকারী অবদান রেখে চলেছেন। আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলোতে অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য তিনি কৃষিখাতে প্রচুর পরিমাণ অর্থ সাহায্য দেন। গত এক দশকে বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন আফ্রিকার দেশগুলোতে কৃষিখাতে
প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। ইথিওপিয়া, তানজানিয়া, নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলোতে সরকারের সাথে সমন্বয় করে ফাউন্ডেশনটি কৃষিখাতে বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা করছে। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের তিনটি রাজ্যে কৃষিখাতের আধুনিকায়ন ও ফলন বৃদ্ধিতে কাজ করছে তারা।
এ ফাউন্ডেশন বিশেষত চারটি বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে–
১. কৃষিজাত উৎপাদন বৃদ্ধি।
২. কৃষকদের আয় বৃদ্ধি।
৩. কৃষকদের বছরব্যাপী নিরাপদ ও সাশ্রয়ী মূল্যের পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করা।
৪. কৃষিকাজে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি।
২০০৭ ও ২০১০ সালে ‘ইরি’ (আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা সংস্থা)-কে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা দেয় তারা। পৃথিবীর পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর অবস্থার উন্নতি এবং দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য কৃষিখাতে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছে বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ।
সমগ্র পৃথিবীর পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় মানসম্মত পুষ্টিকর খাবার সাশ্রয়ী মূল্যে
নিশ্চিত করার জন্য বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে এবং প্রচুর অর্থ সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীতে যেকোনো দুর্যোগে কিংবা মহামারীতে বিল গেটসের ফাউন্ডেশন সবার আগে দাতব্য কাজে এগিয়ে আসছে গত দুই দশক ধরে।
বিল গেটস শুধু দাতব্য কাজে নিজে একা যুক্ত থাকেননি, পৃথিবীর অন্য ধনকুবেরদেরও নিজের প্রতিষ্ঠিত মানবিক কাজে সম্পৃক্ত করেছেন। তার মতো মহৎপ্রাণ দানবীর পৃথিবীর আঁধার দূর করার জন্য যে অবদান রেখে যাচ্ছেন, সেজন্য পৃথিবীবাসী তার কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে চিরকাল।
বিল গেটস সম্পর্কে জানতে যে বইগুলো পড়তে পারেন।