সম্মানীত এলাকাবাসী, মুসল্লি ভাই ও বোনেরা, উঠুন, সাহরির সময় হয়েছে। উঠুন, সাহরি খান। রোজা রাখুন। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করুন।
কী? পরিচিত মনে হচ্ছে কথাগুলো? রমযানের সময়ে এমন ডাক শুনেছেন নিশ্চয়ই? ইসলাম ধর্মে পবিত্র মাস রমযানে সাহরির সময় হলে মধ্যরাতে কিছু লোক এভাবে পাড়া-মহল্লায় ঘুমন্ত মুসলমানদের ডেকে তোলার কাজ করেন। ঐতিহ্যবাহী কাজটি যারা করেন, তাদের ‘মেশারাতি’ বলা হয়ে থাকে। এই মেশারাতিদের নিয়েই আজকের লেখা।
মেশারাতির শুরু
মেশারাতির শুরুটা বেশ পুরনো, সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর সময়ে। সে সময় হযরত বিল্লাল বিন রাবাহ (রা.) নামে একজন সাহাবী ছিলেন। তিনি ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হিসেবে অত্যধিক পরিচিত। তাঁকেই প্রথম মেশারাতি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে ঐতিহাসিক বিভিন্ন সূত্রে। তিনি রমযান মাসে মধ্যরাতে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে মানুষকে ঘুম থেকে জাগাতে ডেকে বেড়াতেন। তবে আরেক সূত্রে এসেছে যে, ফাতেমী খেলাফতের সময়ে মিশরে প্রথম মেশারাতির শুরু হয়।
বলা হয়ে থাকে, একসময় মসজিদের ইমামরাও মিনারের একেবারে উঁচুতে লন্ঠন হাতে উঠে জোরে জোরে মানুষকে সাহরি খাওয়ার জন্য ডাকতেন। আরব নিউজের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রথম দিকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাঁক দিতেন মেশারাতিরা। একই সময়ে কেউ কেউ ড্রামের মাধ্যমে আওয়াজ সৃষ্টি করে মানুষকে জাগিয়ে তোলার কাজটি করতেন। হযরত বিল্লালও এভাবে মানুষকে জাগাতেন বলে কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে। এই ব্যাপারটি বেশ কার্যকর হওয়ায় অনেক এলাকায় অনুসরণীয় হয়ে ওঠে এই পদ্ধতি।
কোনো কোনো এলাকায় ঐতিহ্যবাহী এই কাজে মেশারাতি একা বেরোতেন না। শিশুরা দলবেধে লন্ঠন হাতে বের হওয়ার রীতি ছিল আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে।
অনেক এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে রীতিমতো বাড়ির কারো নাম ধরে ডেকে তোলার কাজ করতেন কোনো কোনো মেশারাতি। সেই যুগে ছোট্ট একটি এলাকায় সকলেই একে অপরকে চেনার কারণে এমনটা ঘটত।
দেশে দেশে মেশারাতি
সৌদি আরবে মেশারাতির প্রচলন হলেও পরবর্তীতে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়েছে এই রীতি। ইসলামী ঐতিহাসিকদের মতে, মেশারাতি আরো সম্প্রসারিত পরিসর নিয়ে ৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ফাতেমীয় খেলাফতকালে মিশরের রাজধানী কায়রোর রাস্তায় দেখা যেতে শুরু করে। সেসময় মেশারাতিরা হাতে একটি ছোট ড্রাম বা তবলা নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। সেই ড্রামে আঘাত করে আওয়াজ সৃষ্টির মাধ্যমে ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো হতো সাহরির জন্য।
মেশারাতিদের নির্দিষ্ট পোশাক পরিধান করে এই কাজ করার রীতি চালু হয় সেসময় থেকেই। কায়রোর রাস্তায় সেসময় জালেবিয়া নামে আলখাল্লা জাতীয় পোশাক ও মাথায় কাপড় বেঁধে মেশারাতির কাজ করতে দেখা যেত লোকেদের। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাম ধরে ডাকার রীতিও চালু ছিল সেসময়।
অন্যান্য দেশে ঠিক কবে থেকে ছড়িয়েছে এই রীতি তা নিয়ে সঠিক তথ্য জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয় মিশর থেকেই দেশে দেশে সম্প্রসারিত হতে শুরু করে রমযানের ঐতিহ্যবাহী এই রীতি। পরবর্তীতে জর্দান, ইন্দোনেশিয়া, সিরিয়া, লেবানন, মরক্কো, ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যের সিংহভাগ দেশে তাদের দেখা গিয়েছে। বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও মেশারাতির প্রচলন দেখা যায়। বাংলাদেশে পাড়া-মহল্লায় এখনও দেখা মেলে মেশারাতির। তবে এই অঞ্চলে মেশারাতি পরিচিত ‘জাগনদার দল’ নামে। মহল্লাভেদে অবশ্য নামের পার্থক্যও দেখা মেলে।
কী বলে ঘুৃম থেকে ডেকে তোলেন মেশারাতিরা?
“মুসল্লি ভাই ও বোনেরা উঠুন, আল্লাহর প্রশংসা করুন।” ” বা “সাহরির সময় হয়েছে; উঠুন, সাহরি খান, রোজা রাখুন।” কিংবা “পবিত্র মাসটি শেষ হওয়ার আগে আল্লাহর ইবাদাত করুন, সাহরি খান।“- এ ধরনের বাক্যের মাধ্যমে মেশারাতিরা সাহরীর জন্য মুসল্লিদের জাগ্রত করার চেষ্টা করেন এই রীতির উৎপত্তিলগ্ন থেকেই।
মিশরে যখন এই রীতি সম্প্রসারিত হয় তার কয়েক বছর পর ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশনের ব্যাপারটিও যোগ হয় মেশারাতিদের এই কাজে। হামদ, নাত বা কেরাতও যুক্ত হতে শুরু করে মেশারাতিদের কাজে। মিষ্টি-মধুর ইসলামী সংগীতের সাথে মেশারাতিদের হাতে থাকা তবলা বা দফে আঘাতের সুর অন্যরকম এক আবহের সৃষ্টি করে দিত। পরবর্তীতে অন্যান্য দেশেও দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে মিল রেখে মেশারাতিদের কাজের ধারায় পরিবর্তন এসেছে।
মেশারাতির কাজ কি শুধু পুরুষরাই করেন?
মেশারাতি রীতি শুরুর পর থেকে পুরুষদেরই এই কাজ করতে দেখা যেত। নারীদের এই কাজে না দেখার সঙ্গত কারণও ছিল। মধ্যরাতের এই কাজে নারীদের মূলত দেখা না যাওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে নিরাপত্তাহীনতাকেই দেখা হত। এছাড়া অনেকটা পথ হাঁটতে হতো বলে পুরুষদেরই এই কাজে পারদর্শিতা ছিল বেশি। তবে গেল বেশ কয়েক বছর ধরে নারীদেরও এই কাজে যোগ দিতে দেখা গেছে। মিশরে যেমন দালাল আবদেল কাদের নামে ৪৬ বছর বয়সী এক নারীর মেশারাতির গল্প উঠে এসেছে বিশ্ব গণমাধ্যমে। তিনি ২০১১ সালে এই কাজে নাম লেখান।
আবদেল বলছিলেন, তার কাছ এই কাজ কখনো নিরাপত্তাহীনতার মনে হয়নি। বরং তিনি কাজটি বেশ উপভোগ করেন। বেশ পরিশ্রমী এই নারী রমযান মাসজুড়ে মেশারাতির কাজ শেষে খুব সকালে দোকানে স্বামীর সাথে কাজ করতে যান।
মেশারাতি কি শুধুই স্বেচ্ছাসেবী কাজ?
শুরুর দিকে মেশারাতি স্বেচ্ছাসেবী কাজ হিসেবে প্রচলিত ছিল। নিজ ধর্মকে ভালোবেসে কিংবা নিজ ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গা থেকেই এলাকাভিত্তিক এই কাজটি ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশে। স্বেচ্ছাসেবী মনোভাব থেকে কাজটি করলেও রমযান শেষে অনেক মেশারাতিই নানা উপহার পেতেন উপকারভোগীদের কাছ থেকে। উপহার হিসেবে অর্থ কিংবা খাবারও পেতেন কেউ কেউ।
পরবর্তীতে ধীরে ধীরে অনেকেই একে মৌসুমি পেশা হিসেবে নিয়েছেন। অনেকে আবার বংশ পরম্পরায় এই চর্চা টিকিয়ে রেখেছেন। তবে পেশা হিসেবে নিতে গিয়ে অনেক মুসল্লির কাছে এটি যন্ত্রণার বিষয় হিসেবেও ঠেকেছে। রমযান শেষে অনেক স্থানেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেশারাতিদের জোর পূর্বক অর্থ আদায়ের ঘটনা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ঐতিহ্যের জায়গায় বিশৃঙ্খল এক পেশাদারি মনোভাবই স্থায়ী হতে শুরু করেছে এই কাজে।
আধুনিকতায় হারাচ্ছে মেশারাতির ঐতিহ্য?
আধুনিক এই যুগে মানুষ দিনে দিনে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠছে। পকেটে থাকা মোবাইলেই এখন অ্যালার্মের সুবিধা থাকায় ঘুম ভাঙানোর কাজটি যান্ত্রিক শক্তির হাতেই চলে গেছে। বিনোদন কিংবা কাজের খাতিরে বর্তমানে অনেকে সাহরি পর্যন্ত জেগেই থাকেন, একবারে খেয়েই ঘুমাতে যান। মেশারাতি তাই আধুনিকতার ছোঁয়ায় তার প্রায় শতবর্ষের পুরনো ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।
একইসাথে মেশারাতির বিকল্প হিসেবে ব্যতিক্রমী কিছু উদ্যোগও নিতে দেখা গেছে দেশে দেশে। ইন্দোনেশিয়ায় ২০১৯ সাল থেকে সাহরিতে মুসল্লিদের জাগাতে রীতিমতো যুদ্ধ বিমানের ব্যবহার শুরু হয়েছে। বিমানের তুমুল শব্দে ঘুমন্ত মানুষের ঘুম ভাঙছে সেখানে। মেশারাতির ঐতিহ্য তাই আজ বিলীন হওয়ার পথে।