মানুষ যন্ত্রের মতো একটানা মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না কোনোকিছুতেই। মানুষকে তার এই সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। একঘেয়ে নাগরিক জীবনে একটানা অনেকদিন থাকার পর শরীর ও মন আর কুলোতে চায় না। ক্লান্ত হৃদয় যান্ত্রিকতা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য হাসফাঁস করে। এরই ফলশ্রুতিতে আমরা সুযোগমতো বেরিয়ে পড়ি। প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা যায়– এমন জায়গাগুলো আমাদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে।
আমাদের দেশে কক্সবাজার, সাজেক কিংবা সেইন্ট মার্টিন দ্বীপের মতো জায়গাগুলোতে সারাবছরই অসংখ্য মানুষ যান ঠিক এই কারণেই। নাগরিক জীবনের ক্লান্তি থেকে উঠে আসতে এই জায়গাগুলোর বিকল্প নেই। আমাদের দেশে যেমন এই জায়গাগুলোতে মানুষজন গিয়ে সময় কাটিয়ে আসে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই এমন বেশ কিছু জায়গা থাকে, যেগুলোতে সে দেশের নাগরিকেরা পাড়ি জমায়।
ধরুন, আপনি এমন একটি জায়গা ঘুরতে বেড়িয়েছেন, যেখানে আপনাকে বহনকারী গাড়ি পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় স্বাচ্ছন্দ্যে এগিয়ে চলেছে, পাহাড়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ঠান্ডা বাতাস আপনার হৃদয় জুড়িয়ে দিচ্ছে, আপনি চোখ বন্ধ করে সেই স্বর্গীয় মুহুর্তগুলো অনুভব করছেন– এসব ভাবতেও কেমন চমৎকার সুখানুভূতি পাওয়া যায়।
বাস্তবে আপনি যখন শ্রীলঙ্কার নুয়ারা এলিয়া নামের সেই চমৎকার শহর ভ্রমণে বেরিয়ে পড়বেন, তখন কল্পনার এই দৃশ্যগুলোই বাস্তব হয়ে ধরা দেবে আপনার সামনে। এপ্রিল মাসে যখন শ্রীলঙ্কায় প্রখর রোদের তাপে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন কলম্বো কিংবা গল থেকে অসংখ্যা মানুষ একটু শান্তির জন্য পাড়ি জমান নুয়ারা এলিয়া নামের সেই শহরে। পুরো শ্রীলঙ্কার তুলনায় এই শহরের বিশেষত্ব হচ্ছে, এখানে তাপমাত্রা অনেক বেশি সহনীয়, এমনকি অন্যান্য জায়গায় যেখানে গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে দাঁড়ায়, তখন এখানে রাতের বেলা পুরোদস্তুর শীত নামে!
একটু ইতিহাসের দিকে যাওয়া যাক। সেই প্রাচীনকাল থেকেই শ্রীলঙ্কা বিভিন্ন রকমের মসলা এবং নারকেলের জন্য পৃথিবীতে খ্যাতি অর্জন করেছিল। যেহেতু মসলা পৃথিবীর সব জায়গায় উৎপাদিত হতো না, তাই উচ্চমূল্যের মসলার ব্যবসা করে শ্রীলঙ্কার মসলা ব্যবসায়ীরা বেশ মুনাফা অর্জন করতো অনেক আগে থেকেই।
এরপর ঔপনিবেশিক যুগ শুরু হওয়ার পর প্রথমে পর্তুগিজদের আগমন ঘটে দ্বীপদেশটিতে। পর্তুগিজদের পর ডাচ দস্যুরা বণিকের ছদ্মবেশে শ্রীলঙ্কার উপকূলে আগমন করে এবং একসময় এখানকার পুরো মসলাব্যবসা কুক্ষিগত করে দেশটিকে নিজেদের উপনিবেশ বানিয়ে ফেলে। ডাচরা মূলত ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরই শ্রীলঙ্কার দিকে নজর দিয়েছিল। ডাচদের সোনালি সময় ফুরিয়ে গেলে পরাক্রমশালী ব্রিটিশরা ডাচদের হাত থেকে শ্রীলঙ্কা শাসনের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নেয়। শ্রীলঙ্কার পূর্বনাম ‘সিলন’ (Ceylon) ব্রিটিশরাই দিয়েছিল। ব্রিটিশরা দীর্ঘকাল শাসন করার পর শ্রীলঙ্কা স্বাধীনতা অর্জন করে। এখনও মসলা কিংবা নারকেলের জন্য শ্রীলঙ্কা তার খ্যাতি ধরে রেখেছে।
নুয়ারা এলিয়া শহরটির সাথে ব্রিটিশদের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ব্রিটিশ সরকারি কর্মকর্তা জন ডেভি ১৮১৯ সালে সর্বপ্রথম এই পাহাড়ি এলাকা আবিষ্কার করেন। তিনি চেয়েছিলেন এখানে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হবে। কারণ তার ধারণা ছিল এখানকার আরামদায়ক শীতল আবহাওয়ায় রোগীরা খুব দ্রুত সেরে উঠতে পারবেন। কিন্তু নুয়ারা এলিয়া শহরটি প্রতিষ্ঠা পায় স্যামুয়েল বেকার নামের একজন পরিব্রাজকের হাত ধরে।
স্যামুয়েল বেকার নুয়ারা এলিয়া প্রতিষ্ঠার আগে আফ্রিকার দেশ উগান্ডায় লেক আলবার্ট আবিষ্কার করেছিলেন ও নীলনদ পাড়ি দিয়েছিলেন। শহরটি প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর খুব দ্রুত ইংরেজ ঔপনিবেশিক ব্যক্তিদের পছন্দের তালিকায় স্থান করে নেয়। কারণ শ্রীলঙ্কার অন্যান্য স্থানগুলোতে যেখানে বাড়তি গরমে কর্মকর্তাদের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে যেত, তখন এই শহরে ভৌগলিক কারণে বেশ আরামদায়ক শীতল আবহাওয়া বিরাজ করতো। এই আবহাওয়ায় স্ট্রবেরি বা লেটুসপাতার মতো সবজি ও ফল উৎপাদন করা সহজ কাজ ছিল।
পৃথিবীর যেকোনো দেশেই চা একটি অর্থকরী ফসল হিসেবে সমাদৃত। শ্রীলঙ্কাও এর ব্যতিক্রম নয়। মজার ব্যাপার হলো, নুয়ারা এলিয়া যে অঞ্চলে অবস্থিত, সেটি হচ্ছে পুরো শ্রীলঙ্কার চা উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্র। এই শহরেও ব্যাপক হারে চা উৎপাদিত হয়৷ ব্রিটিশরা প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে নুয়ারা এলিয়া ও ক্যান্ডির মাঝখানের পাহাড়ি ঢালু এলাকাগুলোতে চা গাছ রোপণ করে। অল্প সময়ের মধ্যেই আশাতীত সফলতা পাওয়ায় ব্রিটিশরা পুরোদমে চা চাষাবাদ শুরু করে দেয়। তবে চা গাছ রোপণের পূর্বে ব্রিটিশরা কফি চাষাবাদেরও চেষ্টা চালিয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের সেই প্রকল্প ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
চা গাছ রোপণের জন্য ব্রিটিশরা স্থানীয় অধিবাসীদের সাহায্য নিয়েছিল। এছাড়া ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশ থেকেও অনেক ব্যক্তি সেই সময় ব্রিটিশদের চা বাগানগুলোতে কাজ করতে আসতো। সেই ব্রিটিশ আমলে নুয়ারা এলিয়ায় চা চাষাবাদ শুরু হয়েছিল, তা এখনও চলছেই৷ নুয়ারা এলিয়া শহরটি বর্তমানে ‘চায়ের রাজধানী’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে।
নুয়ারা এলিয়ায় যে কাজগুলো না করলেই নয়, সেগুলো নিয়েও কথা বলা যাক। যারা নুয়ারা এলিয়ায় ঘুরতে যান, তারা একবার হলেও বিখ্যাত গ্র্যান্ড হোটেলে যান। এখানে শ্রীলঙ্কার মধ্যে সবচেয়ে রাজকীয় চা পাওয়া যায়। চায়ের সাথে সাধারণত স্যান্ডউইচ কিংবা মজাদার কেক খেতে হয়। এরপর নুয়ারা এলিয়ার একেবারে মাঝখানে অবস্থিত ভিক্টোরিয়া পার্কও একটি ‘মাস্ট গো’ জায়গা। এই পার্কে আপনি ঘুরে ঘুরে অনেক ধরনের গাছপালা দেখতে পাবেন। সাধারণত মার্চ থেকে মে– এই তিন মাস সবচেয়ে সৌন্দর্যমন্ডিত থাকে এই পার্ক।
নুয়ারা এলিয়া শহরটা দেখে মনে হবে যেন একটি ছোট ব্রিটিশ শহরের প্রতিচ্ছবি। শহরে এখনও অনেক বাড়ি রয়েছে, যেগুলোতে ‘ক্লাসিক ব্রিটিশ’ স্থাপত্যের ছোঁয়া দেখতে পাওয়া যাবে। এছাড়াও হিল ক্লাব নামের আরেকটি বিল্ডিং রয়েছে, যেটি ছাব্বিশ একর জমির উপর সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। একসময় এখানে পানশালা এবং বিলিয়ার্ড খেলার ঘর ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে একে আবাসিক হোটেলে রূপান্তর করা হয়েছে।
সাধারণত জুন থেকে আগস্ট মাসের শেষ পর্যন্ত নুয়ারা এলিয়ায় বর্ষাকাল বিরাজ করে, তাই এই সময়ে সেখানে ভ্রমণে না যাওয়াই ভালো। এছাড়া বছরের বাকি যেকোনো সময়ে ভ্রমণের জন্য শহরটি একটি আদর্শ জায়গা। নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত রাতের বেলা বেশ শীতল আবহাওয়া বিরাজ করে। এপ্রিল মাসে যখন বসন্তের আগমন ঘটে, তখন পুরো শহর প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। এই মাসে হোটেলে রুম পাওয়া কঠিন হয়ে যায়, প্রতিটি রুমের জন্য বাড়তি ভাড়া গুনতে হয়। তাই অল্প খরচে ভ্রমণ করতে চাইলে এপ্রিল মাসে নুয়ারা এলিয়ায় না যাওয়াই ভালো।
যেখানে শ্রীলঙ্কার কলম্বো কিংবা ক্যান্ডিতে উষ্ণভাবাপন্ন আবহাওয়ায় জনজীবনে হাসফাঁস শুরু হয়, সেখানে অল্প দূরত্বেই আরামদায়ক আবহাওয়ার নুয়ারা এলিয়া যেন প্রকৃতির অপার বিস্ময়েরই প্রতিনিধিত্ব করছে। শ্রীলঙ্কায় উপনিবেশের যুগ শেষ হয়েছে অনেক আগেই, কিন্তু এই একটি শহর যেন রয়ে গিয়েছে উপনিবেশের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। শহরে প্রবেশ করলে আপনার একই সাথে মিশ্র অনুভূতি জাগতে পারে। চা বাগান দেখে মনে হতে পারে এটা অপরূপ সৌন্দর্যের আধার শ্রীলঙ্কারই আরেকটি নগর, আবার ব্রিটিশ স্থাপত্যের ছোঁয়া পাওয়া বাড়ি কিংবা বিভিন্ন বিদেশি গাছের কারণে মনে হতে পারে- এটা হয়তো ব্রিটেনের কোনো গ্রামীণ শহর! সব মিলিয়ে নুয়ারা এলিয়া শ্রীলঙ্কায় ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের জন্য একটি আদর্শ জায়গা।