২০০৫ সালে জার্মানিতে নির্বাচনের দশ দিন আগে চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোয়েডার একটা বৈঠকের ব্যবস্থা করেন তার খুব ভালো বন্ধু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে। প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের কাছে পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় তিনি একটা কাজ সমাপ্ত করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, যা তার উত্তরসূরি আদৌ করবেন কিনা তা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। সোভিয়েত আমল থেকেই রাশিয়ার কাছ থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে আসছে জার্মানি তথা ইউরোপীয় দেশগুলো। এই গ্যাস সংযোগ আনার জন্য ইউক্রেন, বেলারুশ, পোল্যান্ড, এবং বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর ওপর দিয়ে আনতে হতো। এর জন্য তাদের ট্রানজিট ফি দিতে হতো। এর মাঝে ইউক্রেনের মধ্য দিয়েই শতকরা ৮০ ভাগ ট্রানজিট অতিক্রম করতে হতো। নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে আলোচনা শুরু হয় সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে সরাসরি রাশিয়া ও জার্মানির মধ্যে গ্যাস সংযোগের ব্যবস্থা করার। ২০০৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তাদের মধ্যে চুক্তি হয় এই গ্যাস লাইনের।
নির্বাচনে অনুমিতভাবেই শ্রোয়েডার হেরে যান। তার চ্যান্সেলরশিপ শেষ হওয়ার কিছুদিন পর ওই গ্যাস সংযোগ পরিচালনা করার জন্য নতুন গঠিত কোম্পানি নর্ড স্ট্রিমের বোর্ড অব ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন। এই নর্ড স্ট্রিম প্রকল্পকে বিশ্লেষকরা পুতিন ও শ্রোয়েডারের বন্ধুত্বের ফসল হিসেবেই দেখেন।
৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এই প্রকল্পের নাম ছিল ‘নর্ড স্ট্রিম ১’। বাল্টিক সাগরের নিচে দিয়ে অতিক্রম করা এই এই গ্যাস সংযোগের কাজ শেষ হয় ২০১১ সালে অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের প্রশাসনের সময়। এতে ইউরোপে প্রতি বছর ৫৫ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আমদানি করা সম্ভব হয়। তার চেয়েও বড় ব্যাপার এতে ইউক্রেনসহ বাল্টিক দেশগুলোর ওপর ইউরোপীয় দেশগুলোর নির্ভরশীলতা অনেকখানি কমে যায়। এতে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১৫ সালে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ নামে নতুন প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়। রাশিয়া থেকে ইউরোপে ১,২৩০ কিলোমিটারের এই গ্যাস সংযোগের কাজ ২০১৮ সালে শুরু হয়ে ২০২১ সালে শেষ হয়। ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এই প্রকল্পে আগের চেয়ে ধারণ ক্ষমতা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এতে ইউক্রেনের ওপর নির্ভরশীলতা পুরোপুরি দূর করার চেষ্টা হয়। আর এতেই শুরু হয় বিতর্ক।
নর্ড স্ট্রিম ২ এর পুরো মালিকানা রাশিয়ার রাষ্ট্র মালিকানাধীন গ্যাস কোম্পানি গাজপ্রমের। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ইউক্রেনের ট্রানজিট থেকে আয়ের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া প্রকল্প ঘোষণার সময়টাও ছিল একটু নাজুক। কারণ এর আগের বছরই ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের অধীনে থাকা ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নিয়েছিল।
তবে জার্মানির তখনকার চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল ও বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস উভয়ই নর্ড স্ট্রিম ২-কে শুধুমাত্র ব্যবসায়িক প্রকল্প হিসেবে দেখেন। জার্মানির শিল্প খাতের জন্য এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ। জার্মানি তাদের শেষ তিনটি পারমাণবিক চুল্লী বন্ধ করে দেওয়ার জন্য এই গ্যাস সংযোগের প্রয়োজন। নতুন সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে কয়লার ওপর নির্ভরশীলতা দূর করার ঘোষণা দিয়েছে। সেটা বাস্তবায়নের জন্যও প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ প্রয়োজন।
গ্যাস সংযোগ বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলের অঙ্গরাজ্যগুলোর জন্য। সেখানে বিএএসএফ কেমিকেলস, ডেইমলার অটোমেকার, সিমেন্সের কারখানা থাকায় জ্বালানির চাহিদা বেশি। উত্তর দিকে উইন্ড টার্বাইনের মাধ্যমে নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হলেও সেগুলো দক্ষিণের দিকে নিয়ে যেতে জার্মান জনগণের আপত্তি আছে। জার্মানি ছাড়াও ইউরোপীয় অন্যান্য দেশগুলো কম খরচে জ্বালানির চাহিদা জোগাতে পারবে। গাজপ্রমের জন্যও এটা ইউরোপে জ্বালানি রপ্তানি করার জন্য এর পারমাণবিক চুল্লী ও কয়লার ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর একটা সুযোগ।
কিন্তু গাজপ্রম যেহেতু রাশিয়ার রাষ্ট্র মালিকানাধীন কোম্পানি, সেখানে শুধু অর্থনৈতিক ব্যাপার নেই, রাজনৈতিক প্রভাবও আছে। ইউক্রেন ট্রানজিট থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের ট্রানজিটের চুক্তি আছে। নর্ড স্ট্রিম ২ কার্যকর হয়ে গেলে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এখানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারা। ইউক্রেন ছাড়া পোল্যান্ড ও স্লোভাকিয়াও এই প্রকল্পের বিরোধিতা করছে ট্রানজিট প্রসঙ্গে। ক্রিমিয়া সংকট ও ইউক্রেন সীমানায় রুশ সেনাদের সাম্প্রতিক উপস্থিতি আগুনে আরো ঘি ঢেলে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র এই গ্যাস সংযোগকে দেখছে তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোর নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ। এতে ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার ওপর অতি মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে যেতে পারে এবং রাশিয়ার হাতের পুতুলে পরিণত হতে পারে। কারণ রাশিয়া হয়তো এই গ্যাস সংযোগকেই কূটনীতির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে। তাই নর্ড স্ট্রিম ২ এর ওপর অবরোধ আরোপ করার চিন্তা করছে যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া ইউরোপীয় দেশগুলো একচেটিয়া রাশিয়ার গ্যাস কেনা শুরু করলে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এতে। যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাস সরবরাহকারীরা পোল্যান্ডে চুক্তি করতে সক্ষম হলেও ফ্রান্স ও আয়ারল্যান্ডে পরিবেশগত দিক দিয়ে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। তাছাড়া ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য রাশিয়ার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে জ্বালানি আমদানি করা ব্যয়বহুল। এসব দিক রাশিয়াকে কৌশলগত সুবিধা এনে দিয়েছে।
অন্যদিকে খোদ জার্মানিতেও রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য নিয়ে বিরোধিতাকারীর সংখ্যা কম নয়। জার্মানির কোয়ালিশন সরকারের অন্তর্ভুক্ত একটি রাজনৈতিক দল গ্রিন পার্টি। গ্রিন পার্টি নর্ড স্ট্রিম ২ প্রকল্প সমর্থন করে না। কিন্তু চ্যান্সেলর শলৎস এ প্রসঙ্গে বলেন, এটা একটা বেসরকারি প্রকল্প। এটা কার্যকর হওয়ার বিষয়ে জার্মানির প্রতিষ্ঠানগুলোই সিদ্ধান্ত নেবে। ২০২০ সালে রাশিয়ায় পুতিন বিরোধী নেতা হিসেবে জনপ্রিয় অ্যালেক্সেই নাভালনিকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যাচেষ্টা করা হলে তখনকার চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের ওপর চাপ আসে এই প্রকল্প বন্ধ করার। নর্ড স্ট্রিম ২ কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করতে বলা হয়। কিন্তু মার্কেল বলেন, গ্যাস সংযোগের সাথে ‘ব্যক্তিগত বিষয়ের’ সম্পর্ক নেই।
বাস্তবতা হচ্ছে জার্মানি কয়েক দশক ধরেই জ্বালানির জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। তাই তাদেরকে রাশিয়ার সাথে বোঝাপড়া করেই চলতে হয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্রদেরও খুশি রাখতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জার্মানির চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া যদি তাদের জ্বালানি সংযোগকে অর্থনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, অথবা ইউক্রেনে আক্রমণ করে, সেক্ষেত্রে জার্মানিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ইউরোপীয় অন্যান্য দেশগুলোকেও সেরকম মনোভাবের জন্য চাপ দিতে হবে। এগুলোর মধ্যে রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানিতে অবরোধ আরোপের কথাও আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি ইউক্রেনকে বিশুদ্ধ জ্বালানির দেশে রূপান্তরিত করতে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ তুলে আনার জন্য প্রচারণাও চালাবে, যাকে বলা হচ্ছে গ্রিন ফান্ড। জার্মানি প্রাথমিকভাবে এই ফান্ডে ১৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া দ্বিপাক্ষিক জ্বালানি প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনে আরো ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে জার্মানি।
নর্ড স্ট্রিম ২ এর নির্মাণ কাজ ২০২১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর শেষ হয়ে গেলেও ভূরাজনৈতিক বিষয়ের পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতারও সম্মুখীন হচ্ছে। এর কার্যক্রম শুরু করার আগে জার্মান নিয়ন্ত্রকদের বেঁধে দেওয়া অতিরিক্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হচ্ছে। জার্মান জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিনেৎজা (BNetzA) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্দেশনা অনুযায়ী গাজপ্রমের সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক প্রকল্প পরিচালনা সংস্থার জার্মান শাখা খুলতে হচ্ছে। এরপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিনেৎজার পর্যবেক্ষণ শেষে এর অনুমতি মিলবে। তবে অন্তত ২০২২ সালের শেষ অর্ধের আগে এর কার্যক্রম শুরু হচ্ছে না। এর পাশাপাশি ইউক্রেন যেন এতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপ তো আছেই।