চেতন ভগত: ফোন রেখে অর্থনীতি নিয়ে ভাবো, তরুণ সমাজ!

চেতন ভগত। ইংরেজি ভাষায় ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাসিক। পাশাপাশি তিনি একজন কলামিস্টও। সমসাময়িক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে পত্রিকায় লেখেন। আর এসব লেখনীর মাধ্যমে তিনি যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেন ভারতীয় তরুণ সমাজের উপর, যারা তারা উপন্যাসের পাগল ভক্ত। চলমান করোনাকালে সেই তরুণ সমাজকেই সাবধান করে একটি নতুন কলাম লিখেছেন তিনি টাইমস অভ ইন্ডিয়ায়, যা নিয়ে ইতোমধ্যেই আলোচনার ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। চলুন দেখা যাক, কী বার্তা তিনি দিয়েছেন এই কলামের মাধ্যমে।

ভারতীয়রা এখন বলিউডের বিভিন্ন ষড়যন্ত্রকে এক হাত নিতে ব্যস্ত। তাদের কাছে এই বিষয়টি অবশ্যই তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারপরও কথাটা বলা যেতেই পারে যে, ভারতীয় অর্থনীতি এক কঠিন বিপর্যয়ের দোরগোড়ায়। গত ত্রৈমাসিকে জিডিপি সংকুচিত হয়েছে ২৩.৯ শতাংশ, যা একেবারে অপ্রত্যাশিত না হলেও, ভয়াবহ ও অভূতপূর্ব তো বটেই।

এর কারণ করোনাভাইরাস, ঈশ্বর কিংবা সরকারি নীতিমালা কিংবা এই তিনের সমষ্টি, যা-ই হোক না কেন, তাতে কিছুই যায় আসে না। বিষয়টি এখন রান্নাঘরে ছড়িয়ে যাওয়া দুধের মতো। আমরা সারাদিন বসে তর্ক করে যেতে পারি যে কেউ ওটাকে লাথি মেরেছে নাকি ওটা নিজে থেকেই পড়ে গেছে, কিংবা নাটের গুরু আসলে বিড়াল কি না। কিন্তু মূল কথা হলো, ঘরে এখন আর দুধ নেই, এবং আমাদেরকেই এর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আমাদেরকেই এই অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।

কঠিন বিপর্যয়ের দোরগোড়ায় ভারতের অর্থনীতি; Image Source: Observer Research Foundation

কেউ কেউ হয়তো বিশ্বাস করে বসে আছেন যে গত ত্রৈমাসিক ছিল নিছকই ব্যতিক্রম, এবং সামনেই আবার আমরা দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়াব। কিন্তু আমার কাছে তেমন বিশ্বাসকে অতি আশাবাদ মনে হচ্ছে। আমি চাই তেমন কিছুই যেন ঘটে। কিন্তু আমার এমন বিশ্বাস করারও যথেষ্ট কারণ আছে যে তেমনটি ঘটবে না।

ডিমনিটাইজেশনও কেবল একবারের ঘটনাই ছিল, তা-ও সেটির স্থায়িত্ব ছিল মাত্র মাস দুয়েক। অথচ তাতেই ভারতীয় অর্থনীতির স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হয়েছিল কয়েক বছরের জন্য। ঠিক সেরকমই, জিডিপি যদি একবারের জন্যও এতটা তলিয়ে যায়, তার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। যেমন অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে, অনেকে চাকরি হারাবে, ব্যাংক থেকে লোন পাওয়া যাবে না, এবং আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেবে।

একবার যদি কিছু ভেঙে যায়, সেটির পক্ষে খুব সহজে সোজা হয়ে দাঁড়ানো সম্ভব হয় না। তাছাড়া, আমরা যদি অমন অদৃষ্টবাদী বিশ্বাস জারি রাখি যে “ঈশ্বর এই সমস্যা সৃষ্টি করেছেন, কেবল ঈশ্বরই এটার সমাধান করে দেবেন,” তাতে সত্যি বলতে, কোনো সমাধানই আসবে না। ঈশ্বর আমাদের মস্তিষ্ক দিয়েছেন, যেটিকে বরং আমরা ব্যবহার করতে পারি এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে।

লকডাউনের কড়াকড়ি দেখা গেছে ভারতে; Image Source: Reuters/A. Dave

এক্ষেত্রে প্রথম ধাপ হলো সমস্যাটিকে স্বীকার করে নেয়া। সৃজনশীল চার্ট বানিয়ে এটি দেখালে কোনো লাভ নেই যে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি আরো বেশি সংকুচিত হয়েছে। কারণ আসলে তো ওটা মিথ্যা কথা। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা কখনোই আমাদের চেয়ে খারাপ হয়নি, হওয়া সম্ভবও ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে কখনোই এত প্রবল লকডাউন ছিল না, এবং তারা নিজেদের কোষাগার থেকেই সাধারণ মানুষকে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার প্রণোদনা দিয়েছে। আর এদিকে আমরা উদযাপন করে গিয়েছি যে বিশ্বের মধ্যে আমাদের লকডাউনই সবচেয়ে কঠোর, সবচেয়ে কঠিন। অনেকে তো আবার এমনও বলেছে, “কামাল কার দিয়া!” এখন জিডিপির এই ক্ষতির মাধ্যমে আমাদের সেই উদযাপনেরই দায় মোচন করতে হবে।

এখন, একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে আমরা হয়তো আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো উপলব্ধি করতে পারব, এবং বুঝতে পারব যে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রগুলোর সাথে আমাদের প্রতিযোগিতা করা খাটে না। কারণ তারা চাইলে আমাদের চেয়ে আরো অনেক বেশি শাটডাউনও সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। এদিকে দেশে কোভিড কেসের ক্রমবৃদ্ধিও প্রমাণ করে দেয় যে, অমন ড্রাকোনীয় লকডাউন ছিল সম্পূর্ণ অদরকারি। হয়তো এটি এসেছে হিন্দু বিশ্বাস থেকে— তোমরা নিজেদেরকে কষ্ট দাও, এবং ঈশ্বর তোমাদের প্রতি সদয় হবেন। সম্ভবত এই কষ্টের প্রতি ভালোবাসার কারণেই, আমরা পালন করেছি সপ্তাহান্তের লকডাউন, কারফিউ, এবং এমন আরো অনেক অযৌক্তিক জিনিস। সেগুলো আসলে রোগ দমনের উদ্দেশ্যে যতটুকু না ছিল, তারচেয়েও অনেক বেশি ছিল বাবু ও আরডব্লিউএ (রেসিডেন্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন) প্রেসিডেন্টদেরকে মানুষের উপর খবরদারির সুযোগ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে। এবং এতে আমাদের কোনো উপকার হয়নি।

কঠোর লকডাউনের পরও থামানো যায়নি ভারতে করোনা সংক্রমণের হার; Image Source: AP

একবার যখন আমরা ভারতীয়রা সমস্যাটিকে স্বীকার করে নেব, তখন আমাদেরকে আরো তলিয়েও দেখতে হবে। আমরা আসলে কী চাই? আমরা কি একটি ধনী রাষ্ট্র হয়ে উঠতে চাই? নিজেরা ধনী জনগণ হতে চাই? একটি পরাশক্তিতে পরিণত হতে চাই? ডজনখানেক প্লেন কিনে, বিজ্ঞাপন বানিয়ে, কিংবা গগণবিদারী জাতীয়তাবাদী বা ধর্মীয় স্লোগানের মাধ্যমে সে স্বপ্নপূরণ হবে না। ওগুলো সবই ভুয়া, নির্বোধ আর কাণ্ডজ্ঞানহীন। এগুলোর কারণ আসলে তলানিতে থাকা আত্মসম্মানবোধ, যা ভারতীয়দের একটি নিত্যকার সমস্যা। আমরা ভারতীয়রা খুবই মরিয়া নিজেদের মনকে এটা মানাতে যে আমরা যথেষ্ট ভালো আছি। দয়া করে এবার থামুন! একটি ধনী রাষ্ট্র হয়ে ওঠাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কোনো গরিব রাষ্ট্রই বিশ্বের কাছে সম্মানের পাত্র নয়, তা সেটির ইতিহাস যতই মহান, সেটির ঐতিহ্য যতই চমকপ্রদ, এবং সেটির খাবার যতই মজাদার হোক না কেন। আপনারা কি ভারতের জন্য শ্রদ্ধা ও সম্মান চান? তাহলে সাহায্য করুন ভারতকে ধনী হয়ে উঠতে।

তার মানে হলো আমাদের মনোযোগ দিতে হবে অর্থনীতিতে, এবং অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর যেকোনো কর্মকাণ্ডেরই বিরোধিতা করতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা একদম উল্টোটা করে চলেছি। যেমন ধরুন, হিন্দু-মুসলিম সমস্যা থেকে যে সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হচ্ছে, সেটি আমাদের দেশের ব্যবসায়িক স্বার্থের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সুস্থ-স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন কেউই এমন কোনো দেশে বিনিয়োগ করতে চাইবে না, যে দেশের জনগণ পরস্পরকে ঘৃণা করে। আরেকটি সমস্যার মূলে রয়েছে সরকার এবং সরকারের বাবুরা, যারা যেকোনো ব্যবসাকে আইন ও নীতিমালার অধীনে এনে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। যোগব্যায়ামে যে ছেড়ে দেয়ার কথা বলা হয়, সেটি এমনই একটি দর্শন যা কোনো ভারতীয় সরকারই বোঝে না। কিন্তু সত্যিই, এখন ছেড়ে দেয়াটা খুব জরুরি। উন্মুক্ত করে দেয়া প্রয়োজন দেশের অর্থনীতি।

মোবাইলে বুঁদ হয়ে আছে ভারতের তরুণ সমাজ; Image Source: Orissa Post

অতিসত্বর সরকারের যা করণীয় তা হলো একটি সত্যিকারের রাজস্ব প্রণোদনা দেয়া। একটি দরিদ্র রাষ্ট্র হিসেবে, আমরা বড় ধরনের প্রণোদনার আশা হয়তো করতে পারি না। কিন্তু সেটি যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, সত্যিকারের যেন হয়। কেবল যেন বড় বড় সংখ্যা বলে খবরের শিরোনাম হওয়ার চেষ্টা করা না হয়।

একটি রাষ্ট্রের সরকারকে অর্থনীতির ব্যাপারে সঠিক পদক্ষেপগুলো নিতে বাধ্য করার জন্য সেই রাষ্ট্রের জনগণকেও অর্থনীতির ব্যাপারে চিন্তাশীল হতে হয়। কিন্তু পরিহাসের বিষয়, এই মুহূর্তে আমাদের তরুণ সমাজের একদমই হেলদোল নেই। অথচ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু তারাই হচ্ছে। তারা বুঝতে পারছে না, সামনে পুরো একটি প্রজন্মকে হয় বেকার থাকতে হবে, নয়তো আশানুরূপ চাকরি পাওয়া হবে না। সাদা কলারের কর্মীদেরকে বনে যেতে হবে ডেলিভারি বয় (ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে)। সাধারণ ভারতীয়রা ক্রমশ আগের চেয়েও দরিদ্র হতে থাকবে, এবং তাদেরকে বাধা পড়তে হবে গুটিকতক ধনী ও অভিজাত শ্রেণীর দাসত্বের বন্ধনে। আর এভাবেই, ভারত ফিরে যাবে ১৯৮০-র দশকে।

তারপরও, তরুণ সমাজ এখন মত্ত হয়ে আছে তাদের মোবাইল ফোন নিয়ে। তারা তাদের সত্তাকে হারিয়ে ফেলছে সস্তা ফোরজি ডাটা প্যাকের গোলকধাঁধায়। তারা সারাদিন বোকা বোকা ভিডিও দেখছে, ভিডিও গেমস খেলছে, পর্নে আসক্ত হচ্ছে, এবং সম্ভবত সারা দিনভর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্যদের সাথে অহেতুক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এগুলো সবই অর্থহীন কাজ। এবং এর মাধ্যমে তারা তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত লক্ষ্য কিংবা জাতীয় সমস্যাগুলো থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সস্তা ডাটা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে। দেশ যখন জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, তখন তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইলে বুঁদ হয়ে সার্কাস দেখে যাচ্ছে।

ইতোমধ্যেই বেশ সাড়া জাগিয়েছে চেতন ভগতের এই কলামটি; Image Source: The Indian Express

তরুণ সমাজের এখনই প্রয়োজন তাদের ফোনটাকে বন্ধ করে উঠে দাঁড়ানো। তাদের প্রয়োজন নিজেদের স্বপ্ন, লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষার দিকে মনোনিবেশ করা। তাদের চিন্তা করা উচিত কীভাবে অর্থোপার্জন করা যায়, যাতে করে তারা ভারতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে। এবং তাদের উচিত প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করে যাওয়া — প্রবৃদ্ধি কেন আরো বেশি নয়?

ভারতের ভবিষ্যৎ এখন আমাদের হাতে। আমরা হয় একটি দরিদ্র রাষ্ট্রে পরিণত হবো, যার জনগণ আশানুরূপ চাকরির অভাবে কেরানি ও ডেলিভারি বয় হবে, পরস্পরের সাথে সার্বক্ষণিক দ্বন্দ্ব-বিবাদ চালিয়ে যাবে। আর নয়তো আমরা হয়ে উঠব একটি ধনী রাষ্ট্র, অর্জন করে নেব বিশ্ববাসীর সম্মান। তো, আপনারা ভিড়তে চান কোন দলে?

চেতন ভগত এর বই সমূহ দেখুন। 

This article is a Bengali translation of the article "The youth need to shut their phones and ask about the economy" by Chetan Bhagat. Necesaary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © PTI

Related Articles

Exit mobile version