সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখ দৈনিক ‘দ্য ডেইলি স্টার’–এর সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র স্টার উইকেন্ড-এ From the shores of hell & back শিরোনামে একটি চমৎকার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। চমৎকার এই প্রতিবেদনে উঠে আসে বাংলাদেশ থেকে ইতালির স্বপ্ন নিয়ে লিবিয়ায় যাওয়া যুবকদের নির্মম দুঃখগাথা। সেই প্রতিবেদনটি করেছিলেন নাইমুল করিম। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য সেটি বাংলায় উপস্থাপন করা হলো। বাংলা করেছেন সিরাজাম মুনির শ্রাবণ। পাঠের সুবিধার জন্য অতিরিক্ত কিছু ছবিও সংযোজন করা হয়েছে। যেহেতু ইংরেজি থেকে বাংলা করা তাই মূল বাংলা থেকে এই বাংলায় ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক। উল্লেখ্য প্রতিবেদনে প্রকাশিত ভুক্তভোগীর নামগুলো মূল নাম নয়, ছদ্মনাম।
“তারা ভেবেছিল আমি মরে গিয়েছি। লিবিয়ার একটি জেলে চার মাসেরও বেশি সময় ধরে আটকা পড়ে ছিলাম। আমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার কোনো সুযোগ পাইনি। তারা ভেবেছিল [লিবিয়া থেকে ইতালি যাবার পথে] আমি সম্ভবত নৌকা থেকে সমুদ্রে পড়ে গিয়েছি এবং সেই ভয়ানক সমুদ্রে চিরকালের জন্য হারিয়ে গিয়েছি।” এমনটাই বলছিলেন আব্দুল লতিফ।
“আমি শিক্ষা পেয়েছি। আমার বিদেশ যাবার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। জেলখানার সেই সময়টা খুব ভয়ঙ্কর ছিল। পুরো চার মাসে এক লোকমা ভাত খেতে পাইনি। আমার শরীর ভেঙে পড়েছে পুরোপুরি। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ লাগে তখন যখন আমার স্ত্রী-সন্তানদের অবস্থা দেখি। চার মাস ধরে তারা শান্তিতে খেতে পারেনি কিছু নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেনি একটা দিন। আমার চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি যেন তাদের।” বলছিলেন আবদুল লতিফ।
গত ২৬শে সেপ্টেম্বর লিবিয়া থেকে বাংলাদেশে ফেরত আসা ১৫৭ জনের মাঝে তিনি একজন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিলে লিবিয়ার বিভিন্ন জেল থেকে বাংলাদেশিদের মুক্ত করে গত সপ্তাহে একটি ফ্লাইটে করে দেশে পাঠিয়েছে। ‘স্টার উইকেন্ড’ তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলেছে। তারা জানাচ্ছেন বাংলাদেশ ও লিবিয়ার দালাল চক্র কীভাবে তাদেরকে প্রতারিত করেছে। কীভাবে ইউরোপ যাবার লোভ দেখিয়ে তাদেরকে শেষ সম্বলটি পর্যন্ত শোষণ করে নিয়েছে।
২০১৭ সালে একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেছেন আব্দুল কাদের। তার লেখাপড়ার পেছনে তার পরিবার প্রায় সাত লক্ষ টাকা খরচ করেছিল। উচ্চশিক্ষার জন্য কাদেরকে বিদেশ পাঠানোর ইচ্ছাও ছিল। কিন্তু এক দালালের প্ররোচনায় নষ্ট হয়ে যায় তার স্বপ্ন।
“নজরুল ও শাহীন (দালালদ্বয়) আমাকে প্ররোচিত করে। এদের কারণেই আজ আমি নিঃস্ব। তারা আমাকে বলেছিল ১০ লক্ষ টাকা দিলেই সব হয়ে যাবে, ইতালিতে পেয়ে যাবো ভালো কোনো চাকরি।” বলছিলেন ২৭ বছর বয়সী আব্দুল কাদের।
তাকে দুবাই এবং ওমানের ট্রানজিট ভিসা দেওয়া হয়েছিল। ওমান থেকে টার্কিশ এয়ারলাইনস ফ্লাইটে করে তিনি আসেন লিবিয়ায়। “আমার দালাল আমাকে লিবিয়ার জন্য একটি স্টিকার ভিসা দিয়েছিল। বুঝতে পেরেছিলাম এটি ভুয়া কিন্তু তারপরেও কোনোএকভাবে লিবিয়া পৌঁছাতে সক্ষম হই।” বলছিলেন আব্দুল কাদের।
লিবিয়া পৌঁছানোর পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বাশার নামের এক লোকের কাছে। তার সাথে চুক্তি করা ছিল যে তিনি কাদেরকে ইতালি পৌঁছে দেবেন। বাশারের কাছে পৌঁছানোর পরই তার লোক তার কাছ থেকে পাসপোর্ট ও মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়।
কাদের অনেকটা অবাক হয়ে জানতে পারেন আগামী তিন মাস পর্যন্ত তাকে ইতালি পৌঁছাতে পারবে না বাশার, কারণ সীমান্তে কড়া নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। “তারপর সে আমাকে আমার পরিবারের কাছে ফোন দিতে বলে এবং তাদের মাধ্যমে আরো আড়াই লাখ টাকা ঢাকার এক দালালের কাছে পাঠাতে বলে। সে বলেছে এগুলো এখানে তিন মাসের থাকা খাওয়ার জন্য লাগবে। আমি এর প্রতিবাদ করলে তার লোকেরা আমাকে মারধর করে।”
এরপর আড়াই মাস কাদের জিম্মি থাকে বাশারের কাছে। “আমি তার কাছে হাত জোর করতে থাকি আমাকে ছেড়ে দেবার জন্য। সে তার টাকা ইতোমধ্যে পেয়ে গেছে। কিন্তু তার মনে আরো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল। সে আমাকে আরেকজনের কাছে হস্তান্তর করে দিতে চেয়েছিল। হস্তান্তর করে এর মাধ্যমে বাগিয়ে নেবে আরো কিছু অর্থ। দুই লাখ টাকার বিনিময়ে আমি বিক্রি হয়ে যাই আরেক বাংলাদেশি দালাল রিপনের কাছে। তার বাড়ি মানিকগঞ্জ
“প্রথম দিক রিপন আমার সাথে খুবই ভালো ব্যবহার করে। আমাকে তার ভাই বলে সম্বোধন করে এবং আমার দুঃখে দুঃখ প্রকাশ করে। আমাকে বেশ ভালো মানের খাবারও দেয়। এরপর সে আমাকে তার ফোন ধরিয়ে দিয়ে বলে আরো দুই লাখ টাকা ব্যবস্থা করার জন্য।
“সে বলে যে আমি যদি আমার পরিবারের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা এনে না দেই তাহলে লিবিয়ানরা আমাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু আমি জানতাম এগুলোর সবই মিথ্যা। এই টাকার সবই সে তার নিজের পকেটে নিয়ে নেবে। এর প্রতিবাদ করাতে আমি আবারো মার খাই। পরবর্তী দুই দিন সে আমাকে কোনো খাবার দেয়নি,” বলেন কাদের।
দুই দিনের টর্চারের পর আর সহ্য করতে না পেরে কাদের ভেঙে পড়েন এবং তার মায়ের কাছে বলেন বাংলাদেশে রিপনের লোকের কাছে যেন টাকা পাঠিয়ে দেয়। রিপন শর্ত দিয়ে দেয় এই টাকা বিকাশে কিংবা কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে পাঠানো যাবে না। সরাসরি ক্যাশ টাকা পরিশোধ করতে হবে।
শেষমেশ নৌকায় করে ইতালিতে পৌঁছানোর একটি সুযোগ পান কাদের। একটি রাবারের নৌকায় ১৭০ জন লোক উঠানো হয়। সেখানে ৩৮ জন ছিল বাংলাদেশি। কাদেরের ভাষ্যে ১৩ ঘণ্টার এই ভ্রমণ ছিল তার জীবনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভ্রমণ।
“প্রথমত, নৌকায় অতিরিক্ত লোক উঠানো হয়েছিল। নৌকার শেষ মাথায় একটা পাইপের মধ্যে আমি নড়েবড়ে অবস্থায় বসা ছিলাম। তখন ঢেউও ছিল তীব্র। আমাদের সাথে আরো দুটি নৌকা যাত্রা করেছিল। সেখানের তিনজন লোককে পড়ে যেতে এবং সমুদ্রের অতলে হারিয়ে যেতে দেখেছি। আমিও হয়তো পড়ে যেতাম। লম্বা সময়ে এক পর্যায়ে আমার ঘুম চলে এসেছিল এবং ঝিমুনি শুরু হয়েছিল। ভাগ্য ভালো, সে সময়টায় এক বাংলাদেশি আমাকে ধরে রেখেছিল।” তিনি বলেন।
সকাল বেলায় কাদেরের নৌকা জিরো পয়েন্টে পৌঁছায়। একটি ইতালীয় জাহাজ ও একটি ইতালীয় হ্যালিকপ্টার আসে তাদেরকে গ্রহণ করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সেই সময়ে একটি লিবিয়ান নৌবাহিনীর জাহাজ এসে উপস্থিত হয় এবং কাদেরের নৌকাটিকে আটক করে। নৌকার সকলকে ত্রিপলির একটি জেলখানায় পাঠানো হয়।
কাদের সেই জেলে দুই মাসের মতো থেকেছিলেন। সেখানে যেসব ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন সেগুলো এখনো তাকে তাড়া করে ফেরে।
“আমাদের কাছে টাকা কিংবা মোবাইল ফোন যা আছে সব পুলিশের কাছে জমা দিতে বলে। তারা বলেছিল আমরা যখন ছাড়া পাবো তখন আমাদেরকে সকল টাকা ও মোবাইল ফেরত দিয়ে দেবে। তবে এটি ছিল ডাহা মিথ্যা কথা। আমাদের কাউকে কাউকে উলঙ্গও করা হয়েছিল এবং গোপন অংশে ধরে ধরে দেখা হয়েছিল কোনো টাকা লুকিয়ে রেখেছে কিনা তা দেখার জন্য।
বাংলাদেশি ৩৮ জনকে বাকি যাত্রীদের থেকে আলাদা করে ফেলা হয় এবং ৫ ফুট বাই ২০ ফুটের রুমে আবদ্ধ করে রাখা হয়। কাদেরের ভাষ্য মতে গুদাম ঘরের অবস্থাও এর চেয়ে ভালো হয়ে থাকে।
“আমরা ৩৮ জনকে ঠাসাঠাসি করে ঢোকানো হয় এবং শাটার আটকে রাখা হয়। এর ভেতরে শ্বাস নেওয়াই কষ্টকর। শাটারের নিচের অংশে সামান্য ফাঁকা ছিল। আমরা কয়েকজন করে করে ঐ অংশে নাক রেখে শ্বাস নিতাম। খাবার পেতাম খুবই অল্প। তারা এক প্রকারের রুটি দিতো আমাদের যা দিয়ে কখনোই পেট ভরতো না। প্রতি দুই দিনে এক বালতি করে পানি পেতাম।
অনেকে পানি খেতেও ভয় পেতো কারণ সেই রুমে কোনো টয়লেট ছিল না। প্রতিদিন সবার জন্য ১০ মিনিট করে দেওয়া হতো বাথরুমে যাবার জন্য। একসাথে পাঁচ জনের বেশি বের হওয়া যেতো না। তাই প্রতিদিন সকলের বাথরুমে যাওয়া সম্ভব হতো না।
মুরুব্বীদের একজনের পেট খারাপ হয়ে গেল। তিনি বাথরুমের বিরতি পর্যন্ত চেপে রাখতে পারলেন না। খাবার পানির বালতিতেই বিপদ থেকে উদ্ধার হন। পুরো দিন আমরা কেউ এক ফোঁটা পানি খেতে পারিনি।” কাদের বলেন।
জেলের মধ্যে দুই মাস থাকার পর কাদেরের দালাল রিপন তাকে জেলের বাইরে নিয়ে আসতে সক্ষম হয় এবং তাকে তার ঘরে নিয়ে যায়। এবার রিপন কাদেরকে একটি চাকরি দেয়। সেখানে দোকানদার হিসেবে য় মাস কাজ করেন। এরপর নৌকায় করে ইতালি যাবার আরেকটি সুযোগ আসলে তিনি এই চাকরিটি ছেড়ে দেন।
“সেখানে প্রচুর বাংলাদেশি আছে যারা দালাল হিসেবে কাজ করে। এটাই তাদের ব্যবসা,” বলেন কাদের।
কাদের নতুন এই প্রস্তাবে রাজি হন এবং তার মাকে বলেন আরো ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা পাঠাতে। তারপর তাকে ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তার নৌকা অপেক্ষা করার কথা। সেখানে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করেন তিনি। কিন্তু কেউ নিতে আসেনি। এরপর তাকে পুলিশ আটক করে এবং দেশে ফেরত পাঠায়।
ফেরত আসা ১৫৭ জনের কেউ কেউ আছেন যারা প্রতারিত হবার পরেও, এত কষ্টকর অভিজ্ঞতার মাঝে দিয়ে যাবার পরেও আবার বিদেশ যেতে চান। ২২ বছর বয়সী শাহনেওয়াজ খান তাদের একজন। লিবিয়া হয়ে ইতালি যাবার জন্য তিনি দালালকে ৮ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। আগের জনের মতো তিনিও মারধরের শিকার হয়েছিলেন। এমনকি পিভিসি পাইপ দিয়েও তাকে পেটানো হয়েছিল। একজন থেকে আরেকজনের কাছে কয়েকবার করে বিক্রি করা হয়েছিল। শেষমেশ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং দেশে ফেরত আসেন।
“দালালরা আমাকে পিভিসি পাইপ দিয়ে পিটিয়েছিল। ফেরত আসার পরে এখনো স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারি না। ভালোভাবে কথা বলার শক্তিও নেই। আর ওদিকে দালালের বাড়িয়ে নতুন দালান বানিয়েছে। ন্যায়বিচার কি পৃথিবী থেকে উঠে গেছে?
“আমাকে আবারো বাইরে যেতে হবে এবং টাকা উপার্জন করতে হবে। এখানে যদি ব্যবসা করার মতো পর্যাপ্ত ঋণ পেতাম তাহলে একটা ব্যবসা দিতে পারতাম। কিন্তু পাই না। আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা তেমন বেশি নেই। তাই আমার অন্য কোনো পথও খোলা নেই।” বলছিলেন শাহনেওয়াজ।
লিবিয়ার দিনগুলোর কথা মনে হলে এখনো গা শিওরে উঠে ২১ বছর বয়সী মান্নান কাজীর। বাড়িতে ফিরে আসার পরেও তিনি ঠিকমতো খেতে পারছেন না।
“দেশে ফিরে আসার পর আমার বাবা-মা আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ভর মাপার নিক্তির উপর উঠে দেখলাম আমার ভর কমেছে প্রায় ২০ কেজি। লিবিয়া যাবার সময় আমার ভর ছিল ৬৫ কেজি আর সেখান থেকে ফেরত আসার পর হয়েছে ৪৫। এই মাপ দেখে সেখানেই কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন আমার বাবা-মা।
আমার অবস্থা এখন খুবই খারাপ। আমার কারণে আমার পরিবারের সকল টাকা শেষ হয়ে গেছে। আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার টাকাও এনেছিল ধার করে। ভবিষ্যতে কী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে এমনটা ভাবতে গেলে বুকে ব্যথা ধরে আসে।” দুঃখ করে বলছিলেন মান্নান।
মান্নানের সাথে লিবিয়া গিয়েছিলেন তার খালাতো বোনের স্বামী তোফায়েল। অন্যান্য বাংলাদেশিদের মতো তিনিও প্রতারিত হয়েছিলেন এবং তাকেও কয়েকবার করে বিক্রি করা হয়েছিল। মান্নানের ভাষ্য অনুসারে, তোফায়েলের লিবিয়ার আটকে পড়ার খবর শুনে এবং আরো টাকা দেবার কথা জেনে তার বাবা স্ট্রোক করে এবং তাতে মারা যায়।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলামের মতে, দালালরা কাদেরের মতো লোকেদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের সাথে প্রতারণা করে। তিনি জানাচ্ছেন তাদের গবেষণা অনুসারে ইউরোপে গমনকারী বাংলাদেশিদের বেশিরভাগই ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। এই বয়সের লোকদেরকেই দালালরা বিশেষভাবে টার্গেট করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিআর আবরারের মতে বাংলাদেশে যুব সমাজের জন্য কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে অনেক যুবকই হতাশ থাকে। এই সুযোগে দালালরা সহজেই তাদেরকে ব্রেইনওয়াশ করে ফেলে। তিনি আরো বলেন, আমাদের জিডিপি ঠিকই বাড়ছে কিন্তু সুযোগ সুবিধা বাড়ছে না। যে সকল যুবক দালালদের এই ফাঁদে পা দিচ্ছে তাদের এ ছাড়া আর অন্য পথ খোলাও নেই।
আইওএম বাংলাদেশের প্রধান জর্জি গিগারির মতে তাদের পেছনে এক শক্তিশালী চক্র আছে। তিনি বলছেন “অবৈধ পথে যাওয়া বাংলাদেশিদেরকে ফিরিয়ে আনতে আমরা কমপক্ষে এক যুগ ধরে কাজ করে যাচ্ছি। লিবিয়া হয়ে ইউরোপ যাবার জন্য মানুষ এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন “মানুষের মস্তিষ্ক সে জিনসটাকেই গ্রহণ করে যে জিনিসটা সে শুনতে চায়। গবেষণা বলছে মানুষ হাজারটা নেতিবাচক গল্পকে পাশ কাটিয়ে হলেও একটা ইতিবাচক গল্পকে গ্রহণ করে।” তাই ইউরোপ যাওয়া নিয়ে শত শত ভোগান্তির কাহিনী বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও মানুষ ঝুঁকি নিতে চায়, কারণ সেখানে আছে উন্নত জীবনের একটা হাতছানি।
গত সপ্তাহে দেশে ফেরত আসা কয়েকজন ভুক্তভোগী ‘স্টার ইউকেন্ড’কে জানাচ্ছেন, তারা জানেন না এরপর তারা কী করবেন। তাদের অধিকাংশকেই চাপ দেওয়া হচ্ছে তাদের খোয়া যাওয়া টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য। এমনিতেই সর্বহারা, তার উপর টাকা ফেরত দেওয়ার চাপ সব মিলিয়ে তাদের মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ। অথচ তাদেরকে মানসিকভাবে কাউন্সেলিং করার কোনো উদ্যোগ সমাজ কিংবা সরকারের নেই। লিবিয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের সাথে কথা বলার সময় অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে আমি (অনুবাদক) কথা বলেছিলাম লিবিয়া প্রবাসী প্রকৌশলী মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার সাথে। তিনি জানাচ্ছেন, “লিবিয়া থেকে ইতালিতে লোক যাওয়া এখন প্রায় অসম্ভব। যত মানুষ আসে, বেশিরভাগের পরিণতিই এরকম হয়। দালাল থেকে দালালের কাছে বিক্রি, শেষে পুলিশের মার খেয়ে দেশে ফেরত। আগে লিবিয়ার সমুদ্রসীমা পার হলেই ইতালিয়ানরা উদ্ধার করে ইতালিতে নিয়ে যেত। এখন উল্টো। ইতালিয়ান হেলিকপ্টার বোট দেখলে লিবিয়ান কোস্টগার্ডকে খবর দিয়ে লিবিয়ায় ফেরত পাঠায়। ইতালি-লিবিয়া চুক্তির পর লিবিয়া চোরাই পথে থেকে ইতালিতে অনুপ্রবেশের হার একদমই শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। উপরের চার্টটি দেখুন, পরিষ্কার হয়ে যাবে।”
তাই সবার উচিত বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে দালালদের প্ররোচনা থেকে দূরে থাকা।
ফিচার ছবি- বিবিসি