‘ভারত জোড়ো যাত্রা’য় রাহুল গান্ধীর প্রাপ্তি

ভারতে নরেন্দ্র মোদীবিরোধী জোট গঠনের চেষ্টা চলছে গত নির্বাচনের আগে থেকেই। কিন্তু, বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারতে বিস্তৃত আদর্শের মিশেলে সেই জোটের সমীকরণ মেলেনি। ফলে, ভারতীয় রাজনীতিতে গত অর্ধযুগ থেকে একটি প্রশ্ন ঘুরে ঘুরে বহুবার এসেছে, যদি নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী না হন, তবে কে?

মোদীর বিকল্প কে হবেন এই প্রশ্নের ঘূর্ণিতে বার বার আটকে গেছে বিরোধী শিবিরের তোড়জোড়। তার বিকল্প হিসেবে যে ভারতের জনগণ রাহুল গান্ধীর ওপর আস্থা রাখতে পারেননি, সেজন্য অবশ্য রাহুল গান্ধীর নিজের দায় বারো আনা। রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত জীবন, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জনসম্পৃক্ততা থেকে রাহুল গান্ধী যতটা পিছিয়ে ছিলেন, দিল্লির মসনদ দূরের বাতিঘরে পরিণত করতে আর কারো সাহায্যের দরকার ছিল না তার। কিন্তু গত ১৩৫ দিনে যেন এক বদলে যাওয়া রাহুল গান্ধীকে দেখল ভারত। ১২টি রাজ্য ও দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে তিন হাজার নয়শো কিলোমিটারের বেশি পথ পায়ে হেঁটেছেন তিনি।

সময়ের সাথে তার যাত্রায় বেড়েছে উপস্থিতি। তার সাথে যোগ দিয়েছেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, চলচ্চিত্র ও মিডিয়া জগতের মানুষজন। এমনকি, যাত্রার শুরুতেও যারা হাসি-ঠাট্টা করেছিলেন, যাত্রার শেষদিনে এসে তাদেরও ভুল ভেঙেছে। রাহুল গান্ধীকে প্রথমবার দেখা গেছে কুশীলব রাজনীতিকের ভূমিকায়। শুধু বিরোধী শিবির নয়, খোদ কংগ্রেসেও তাকে নিয়ে যে সংশয় ছিল, সেটা কেটে গেছে নিঃসন্দেহে। দলের সর্বস্তরের নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলতে পারাটাও প্রাপ্তির খাতাতেই ভিড়বে।

ভারত জোড়ো যাত্রা’র রুট; Image Source: The Hindu

রাহুল গান্ধী বার বার বলে এসেছেন, এ যাত্রা তার নিজের কিংবা কংগ্রেসের জন্য নয়। এই যাত্রা বিভক্তির বিরুদ্ধে এক লড়াই। কিন্তু উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দলের প্রধান মুখ যখন কথাটি বলছেন, তখন তিনি নিজেও জানেন যে ভারত জোড়ো যাত্রাকে অনৈর্বাচনিক দৃষ্টিতে দেখবার সুযোগ নেই। এক বছর পর অনুষ্ঠিতব্য ২০২৪ জাতীয় নির্বাচন ঘুরে-ফিরে তাই এজেন্ডায় চলেই এসেছে। কিন্তু, সেই এজেন্ডায় কি রাহুল গান্ধী সফল? ভারত জোড়ো যাত্রা কি তাকে ভারতের ১৫ তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় নিয়ে যাবে?

কালের বিচারে এ প্রশ্ন তোলা রইল। এটাও সত্যি যে ভারত জোড়ো যাত্রা পুঁজি করে কংগ্রেস যদি আগামী নির্বাচনে লড়তে চায়, তবে তা হবে খুবই দুর্বল চেষ্টা। কারণ, এই মুহূর্তে ভারতীয় জনতা পার্টির জনপ্রিয়তায় ধস নামানোর জন্য যে গণজোয়ার দরকার, সেই উদ্দেশ্য অধরাই রয়ে গেছে। তাহলে, ভারত জোড়ো যাত্রা থেকে কী পেল কংগ্রেস? এর উত্তর একদম সহজ। আপাতদৃষ্টে ভারত জোড়ো যাত্রা থেকে কংগ্রেসের একমাত্র যোগ হলো রাহুল গান্ধীর উত্থান। এই যাত্রার মাধ্যমে রাহুল গান্ধী নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প হিসেবে বাকি সবার থেকে নিজেকে এগিয়ে রাখলেন। অন্তত, দিল্লির আখড়ায় সেই আলোচনাই চলছে।

ভারত জোড়ো যাত্রা ২০২৪ সালের নির্বাচনের দৌড়ে নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প হিসেবে সবচেয়ে এগিয়ে রাখলো রাহুল গান্ধীকে; Image Source: The Diplomat

এই পদযাত্রায় রাহুল গান্ধী ১১৩টি পথসভা করেছেন, ২৭৫টি মতবিনিময় সভা করেছেন, এবং ১৩টি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তার ক্যারিয়ার গ্রাফ বিবেচনায় গত ১৩৫ দিন ছিল সবচেয়ে কর্মচঞ্চল। সেই সাথে মিডিয়াও সামলেছেন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে পরিণতভাবে। পুরো যাত্রায় তার পরনে ছিল সাদা হাফহাতা টি-শার্ট। তাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমি যখন মধ্যপ্রদেশ পৌঁছালাম, তখন তিনটি বাচ্চা মেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো। তাদের গায়ে ছেঁড়া পোশাক। তারা শীতে কাঁপছিল। সেদিনই ঠিক করলাম, শীতে শরীরে কাঁপন ধরার আগপর্যন্ত গরম জামা পরব না। আমি ওদের জানাতে চাই, ওদের সঙ্গে আছি।” তার পরনের সাদা টি-শার্ট নিয়েও কম সমালোচনা হয়নি বিজেপি শিবিরে। রাহুল নিজেকে অতিক্রম করে সেসব ভালোই সামলেছেন। শ্রীনগরের ঐতিহাসিক লালচকে পতাকা উত্তোলন করে তিনি বলেছেন, “আমাকে বার বার কাশ্মীরে পদযাত্রা করতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এতে নিরাপত্তার ঝুঁকি আছে। কিন্তু আমি ভাবলাম, যারা আমাকে ঘৃণা করে, তাদের একটা সুযোগ দেওয়া যাক। তারা আমার শার্টের রং বদলে দিক। এটাকে লাল করে দিক!

শ্রীনগরে জনসভায় রাহুল গান্ধী; Image Source: BCCL 2023

পদযাত্রা ভারতের রাজনীতিতে নতুন নয়। স্বাধীনতার পর ভারতে নিদেনপক্ষে পাঁচবার বড়সড় রাজনৈতিক পদযাত্রা হয়েছে। ১৯৮৩ সালে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা চন্দ্রশেখর জাতীয় আস্থা অর্জনে বিশাল এক পদযাত্রা করেন। স্বাধীনতাপূর্ব ভারতেও ১৯৩০ সালের মহাত্মা গান্ধী এক পদযাত্রা করেন ইংরেজদের একচেটিয়া লবণ কর নীতির বিরুদ্ধে। ২৪ দিনে ২৪০ মাইল হেঁটে ব্রিটিশ আইন ভেঙে ডান্ডি গ্রামে তিনি তৈরি করেন লবণ। মহাত্মা গান্ধীর লবণ সত্যাগ্রহের সাথে ভারত জোড়ো আন্দোলনের তুলনা চলে না। দেশ, কাল, সমাজের কাঠগড়ায় সেই তুলনা টেকে না। কিন্তু গুরুত্বের কাঠগড়ায় ভারত জোড়ো যাত্রা কি একেবারেই উড়িয়ে দেবার মতো? ভারতের রাজনীতি নিঃসন্দেহে বিভেদের এক কঠিন সময় পার করছে। তার মধ্যে রাহুল গান্ধী কন্যাকুমারী থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যে ঐক্যের ডাক দিলেন, তার গুরুত্ব তো আর অস্বীকার করা যায় না।

জেলে থাকা অবস্থায় জওহরলাল নেহরু তার দশ বছরের মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি লিখে ভারত চিনিয়েছিলেন। এই চিঠিতেই ইন্দিরা শিখেছিলেন ভারতের সংস্কৃতি, আর বুঝেছিলেন ভারতের মানুষকে। পিতা-কন্যার সেই পাঠ পরে বই আকারে বেরিয়েছিল ‘The Discovery of India’ শিরোনামে। রাহুল গান্ধী প্রপিতামহের সেই পাঠ দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পায়ে হেঁটে আত্মস্থ করলেন।

Language: Bangla
Topic: Rahul Gandhi's achievements from the Bharat Jodo Yatra
References:
1. Rahul and Priyanka Gandhi's Bharat Jodo Yatra: Can unity walk help defeat India PM Modi? - BBC
2. Rahul Gandhi: Can long march revive India's Congress party in digital age? - BBC
3. Bharat Jodo Yatra is over, where does Rahul Gandhi go from here - The Times of India

Related Articles

Exit mobile version