ভারতের গোয়ায় অবস্থিত ছোট্ট এক গ্রাম নিরংকল। গোয়ার একটি ব্যস্ততম শহর পোণ্ডা। এই শহর থেকে নয় কিলোমিটার দূরে আনারস, আম আর নারিকেলের গাছের সারি ধরে এঁকেবেকেঁ যাওয়া পথ পাড়ি দিলেই ছোট্ট গ্রামটির দেখা পাওয়া যাবে। সুদূর বিস্তৃত বাবলা গাছে ঘেরা এই গ্রামের জনজীবনে এখনও শহুরে হাওয়ার ছোঁয়া লাগেনি। এখনও এখানে যানবাহনের শব্দের পরিবর্তে পাখির ডাকে মুখরিত থাকে চারপাশ। এখানেই বসবাসরত অবেহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত একটি আদিবাসী গোষ্ঠী ভানারমার। অনেকটা আদিকালের মানুষের মতো তারা জীবনযাবন করে। তীর নিক্ষেপে বিশেষ পারদর্শী এ সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিরা ‘বানর শিকারী’ হিসেবে পরিচিত।
প্রচলিত আছে, একলব্যের বংশধর এই ভানারমার গোষ্ঠী। প্রাচীন মহাভারতের একটি বিশেষ চরিত্র একলব্য, তীর ছোঁড়ার ক্ষেত্রে যিনি বিশেষ দক্ষ ছিলেন। শুরুতে হস্তিনাপুরের রাজ্যে কৌরব ও পান্ডবদের গুরু দ্রোণাচার্যে কাছে তিনি তীরচালনা শিখতে চান। তার শিষ্য হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকলেও নিম্নবংশীয় হওয়ার কারণে একলব্য গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে প্রত্যাখ্যাত হন। কিন্তু একলব্য থেমে যাননি, গুরুর একটি মূর্তি নির্মাণ করে সামনে রেখে নিজেই নিজেকে প্রশিক্ষিত করতে লাগলেন এবং একসময় সেরা তীরন্দাজ হয়ে উঠলেন। পরবর্তীতে গুরু দ্রোণাচার্য তীরচালনার গুরুদক্ষিণা হিসেবে একলব্যর হাতের বুড়ো আঙুল কেটে তার পদতলে সমর্পণের আদেশ করেন এবং একলব্য সেই আদেশ পালন করেন। পৌরাণিক ইতিহাসের চরিত্র একলব্যের বর্তমান বংশধর ভানারমারদের অবশ্য এখন আর তীরচালনার পূর্বে আঙুল কেটে কারো কাছে সমর্পণ করতে হয় না।
শত শত বছর ধরে তারা বানর শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। ভানারমারদের শিকারের ধরন ছিল খানিকটা এমন- শিকারের সময় তাদের সাথে কুকুর থাকত। শিকারের আগে তারা বনে কুকুর ছেড়ে দেওয়া হতো, আর এদিকে ভানারমারেরা তীর-ধনুক নিয়ে প্রস্তুত থাকত। বানরগুলো ছুটোছুটি করে বন থেকে বেরিয়ে আসা মাত্র তীর নিক্ষেপ করে শিকার করা হতো তাদের। ১৯৭২ সালে ভারত সরকার প্রণীত বন্য পশু সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, তাদের বানর শিকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে ভানারমার সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য হিসেবে ব্যবহৃত তীর-ধনুকগুলো স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করে আসছে।
বানর শিকার নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে তারা জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষিকাজ করে থাকে; বাদাম চাষ, আখ চষ, সুপারি ও নারিকেল সংগ্রহ করা ইত্যাদি। এছাড়াও অনেকে মৎস্যশিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের গড় দৈনিক আয় দিয়ে পরিবারের জন্য দু-মুঠো আহার যোগানো রীতিমতো কষ্টসাধ্য। ভানারমার পুরুষদের গড় দৈনিক আয় ১৫০ রূপি, আর নারীদের ক্ষেত্রে ৭৫ রুপি। দারিদ্র্য এই সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণ গ্রাস করে রেখেছে।
মৌলিক অধিকারগুলো থেকে তারা চরমভাবে বঞ্চিত এবং বেশ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাদের বসবাস। বিশুদ্ধ খাবার পানি, চিকিৎসা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, এমনকি বিদ্যুৎ সুবিধাটুকুও নেই। তবে অনেকেই তাদের সাধ্য অনুযায়ী সোলার প্যানেল বসিয়েছে, যাতে তাদের মোবাইল চার্জ করতে পারেন। কাজের জন্য তাদের দূর এলাকায় যেতে হয় এবং সপ্তাহান্তে হয়তো কেবল একবারই তারা পরিবার-পরিজনের কাছে আসতে পারে। তাই যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম মুঠোফোন। একদিন কাজে অনুপস্থিত থাকা মানে একদিনের আয় কম, অর্থাৎ একদিন অভুক্ত থাকার পূর্ব প্রস্তুতি।
ভানারমারদের বসবাসের কুটিরগুলোরও জীর্ণ দশা। ঘাস-পাতা আর কাদা-মাটি দিয়ে বানানো কুটিরগুলোতে তারা দিনযাপন করে। কুটিরগুলো বসবাসের জন্য খুব একটা সুবিধাজনক না হলেও দিনের পর দিন এভাবেই তারা দিনযাপন করে আসছে। উঠোনের মাঝে কাদামাটি দিয়ে তৈরি উনুনে সকলের জন্য রান্না হয়ে থাকে।
ভানারমার নারীরা একটি বিশেষ কায়দায় শাড়ি পরিধান করে থাকে, যা তাদের ঐতিহ্যের বাহক। শাড়িকে অনেকটা পেঁচিয়ে স্কার্টের মতো করে হাঁটুর উপর পর্যন্ত পরা হয়।
তাদের মাঝে এখনও পৌঁছেনি শিক্ষার আলো। নেই ভোট দানের কোনো অধিকার। মদ্যপান ও ধূমপানে আসক্ত এই সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষ। নেশাগুলো তাদের তিলে তিলে শেষ করে দেয়। শুধু প্রাপ্তবয়স্ক এবং বয়ঃবৃদ্ধরাই নয়, বরং পনের বছরের নিচের সদস্যদেরকেও নিয়মিত তামাক পাতা চিবোতে দেখা যায়।
ছোট্ট এই গ্রামে হাতেগোনা যে কয়টি পরিবার আছে, সকলে একসাথে একটি পরিবারের ন্যায় থাকে। তারা শান্তিপ্রিয় হিসেবে পরিচিত। এই গোত্রের মধ্যে একজন নেতৃত্ব প্রদানকারী থাকেন, যার মতামত ও সিদ্ধান্ত সকলে মেনে চলে। খুব স্বভাবতই যে মানুষগুলো সমাজে সবকিছু থেকে পিছিয়ে রয়েছে, তাদের সামাজিক প্রথা- যেমন বিয়ের ক্ষেত্রেও রয়েছে অজ্ঞতার ছোঁয়া। এ সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েদের বাল্যকালেই বিয়ে দেওয়া হয়।
২০১৬ সালের আগপর্যন্ত তাদের জীবনের চিত্রপট এমনই ছিল। ২০১৬ সালে এই গ্রামের অধিবাসীদের উপর অতর্কিত এক হামলার পর ভানারমার গোষ্ঠী গোয়া, তথা ভারত সরকারের নজরে আসে। হামলায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও তাদের জীর্ণ বাড়িঘরগুলো অনেকটা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় ঘটনাটি বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এর আগপর্যন্ত অনেকেই তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত ছিল না।
শিক্ষার অভাব ও দুনিয়াদারি সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে এ হামলার পর তারা কোনো রকমের পদক্ষেপ বা আইনি প্রক্রিয়ার জন্য আবেদন করেনি। পার্শ্ববর্তী গ্রামের জনৈক নারী তাদের হয়ে নিকটস্থ পুলিশ স্টেশন এবং গোয়ার মানবাধিকার কমিশনে একটি অভিযোগ দাখিল করে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে পুলিশ সেখানে আসে এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী ও দাতব্য সংস্থা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তাদের সহায়তায় খাদ্যদ্রব্য ও অর্থ বিতরণ করা হয়।
সরকারের পক্ষ থেকে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি-ঘর পুনঃনির্মাণের জন্য অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয় এবং এলাকায় বিশুদ্ধ পানি পানের কোনো সুবিধা না থাকায় একটি ছোট পানির ট্যাংক বসানো হয়।
পরের বছর তাদেরকে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করা হয়। ভারতের স্বাধীনতার প্রায় সাত দশক পরে এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী ভোট দানের অধিকার পায়। এছাড়াও বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করানো, ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করার মতো বিভিন্ন কাজ করতে তারা সক্ষম হয়।
৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সালে গোয়ায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভানারমার জনগোষ্ঠী অংশগ্রহণ করে। এই গোষ্ঠীর মোট ৪২ জন সেই নির্বাচনে ভোট প্রদান করে, কেননা কেবল এই ক’জনকেই তখন ভোটার কার্ড প্রদান করা হয়েছিল।
ধীরে ধীরে আশার আলো দেখতে শুরু করেছে অবহেলিত এই জনগোষ্ঠী। তারা আশা রাখে, অদূর ভবিষ্যতে উপযুক্ত বাসস্থান, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, চিকিৎসা সুবিধা ও বৈদ্যুতিক সংযোগের মতো অত্যন্ত আবশ্যক সুবিধাগুলোও তারা পাবে।
সুবিধাবঞ্চিত এই মানুষগুলোও স্বপ্ন দেখে একটু ভালো থাকার, একটি সুস্থ জীবনের প্রত্যাশা তারাও করে। সরকারের একটু সুদৃষ্টি এই মানুষগুলোর ভাগ্য বদলে দিতে পারে।