একটা সুন্দর সকাল। মাধবী মুখোপাধ্যায় (ছদ্মনাম) কাজে বের হবেন কিছুক্ষণ বাদেই। নয়া দিল্লী থেকে সরাসরি মিরাটের দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে, সেটি ধরে তিনি এগোচ্ছেন। নিজেই সদ্য কেনা মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটা চালাচ্ছেন। রাস্তায় প্রতি কিলোমিটারে প্রচুর প্লাস্টিক। পথচারীদের ব্যবহৃত কোমল পানীয়ের বোতল, খেলনা গাড়ি, পলিথিন ব্যাগ, ব্যবহৃত চায়ের কাপসহ প্লাস্টিক জাতীয় কী নেই রাস্তায়! এসব মাড়িয়েই তাকে প্রতিদিন কাজে যেতে হয়। কী একটা বিশ্রী অবস্থা, তাই না?
না, একেবারেই বিশ্রী নয়। কারণ প্লাস্টিক পণ্যগুলোর একটিও দৃশ্যমান নয়। পিচঢালা রাস্তার একটি অংশই হচ্ছে এসব উচ্ছিষ্ট প্লাস্টিক দ্রব্য। ভাবছেন পাগলের প্রলাপ বকছি? একেবারেই না। নয়াদিল্লীর সাথে নিকটবর্তী শহর মিরাটকে যুক্ত করা এই মহাসড়ক নির্মাণে ব্যবহৃত প্রযুক্তি তৈরি করেছেন ত্যাগরাজার কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক রাজাগোপালান বাসুদেবান। এই প্রযুক্তির মূলনীতি হলো সড়ক নির্মাণে ব্যবহৃত মোট বিটুমিনের শতকরা ১০ ভাগের বদলে বিশেষায়িত (repurposed) প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রয়োগ।
বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী প্লাস্টিক বর্জ্য ভিত্তিক রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে ভারত। প্রাথমিকভাবে দু’টো উদ্দেশ্যে এই প্রকল্পের কাজ করা হচ্ছে। প্রথমত, সমুদ্রে প্লাস্টিক পণ্যের দূষণের হার কমানো এবং দ্বিতীয়ত, স্থলভাগে (বিশেষত আবাদি জমিতে) প্লাস্টিকের মজুদ হ্রাস করা। এছাড়াও আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে বিশেষায়িত প্লাস্টিক ব্যবহারের মাধ্যমে কোনোভাবে রাস্তাকে অধিক টেকসই করা যায় কিনা তা দেখা। ২০৪০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক পরিবেশে ১.৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক জমা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যার মাঝে ভারত একাই প্রতি বছর ৩.৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন করে থাকে। এত বেশি পরিমাণ প্লাস্টিক পণ্যের উৎপাদন এবং তা থেকে সৃষ্ট বর্জ্যের বিকল্প ব্যবহার কী হতে পারে সে ভাবনা থেকেই মূলত উদ্ভব ঘটে বাসুদেবানের এই প্রযুক্তির।
বাসুদেবান উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তিতে যেকোনো ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্যেরই গন্তব্য হতে পারে ভারতের রাস্তা। অর্থাৎ, বিটুমিনের সাথে মেশানোর আগে কী ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য— সেটি পরিষ্কার, যাচাই-বাছাই বা পৃথকীকরণের কোনো প্রয়োজনই নেই। পলিইথিলিন, পলিপ্রোপাইলিন ফোম, প্লাস্টিকের ব্যাগ, কাপ, বিভিন্ন জাতীয় প্লাস্টিক ফিল্ম ইত্যাদি যেকোনো ধরনের প্লাস্টিক দ্রব্যকে পাথর আর বালির মিশ্রণে যুক্ত করা হয়। এরপর এই মিশ্রণকে ১৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করা হলে প্লাস্টিক গলে যায়। এরপর টুকরো করা পাথর, বালি আর গলিত প্লাস্টিক একত্রিত হয়ে যে স্তর তৈরি করে তাতে বিটুমিন ঢেলে দেওয়া হয়।
কোনো জলাশয়ে বা আবাদি জমিতে প্লাস্টিকের মিশে যাওয়াকে রোধ করার পাশাপাশি রাস্তার উন্নয়নেও এই প্রযুক্তির ভূমিকা আছে। রাস্তার ক্ষয়ে যাওয়াকে রোধ করতে প্লাস্টিক বর্জ্যের কার্যকারিতা এখন প্রমাণিত। তাছাড়া রাস্তায় গর্ত বা খানাখন্দ তৈরি হওয়ার হারও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে আসে এ প্রযুক্তিতে। প্লাস্টিক বর্জ্যের ব্যবহারের কারণে রাস্তার নমনীয়তা বৃদ্ধি পায়। এখন পর্যন্ত বাসুদেবানের পরিচালনায় সম্পন্ন একটি প্রজেক্টের ১০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও সেসব রাস্তায় কোনো ধরনের গর্ত বা দেবে যাওয়ার আলামত মেলেনি।
বাসুদেবানের হিসেব মোতাবেক বিটুমিনের পাশাপাশি স্বল্প পরিমাণে প্লাস্টিক বর্জ্যের ব্যবহার প্রতি কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ ৩ টন কমাতে সক্ষম। এছাড়া অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা তো রয়েছেই। বিটুমিনের সাথে উচ্ছিষ্ট প্লাস্টিক ব্যবহারের কারণে কিলোমিটার প্রতি রাস্তা নির্মাণ খরচ কমেছে ৬৭০ মার্কিন ডলার (প্রায় ৫৫ হাজার টাকা)।
দুই দশক আগে ভারতে এই প্রকল্পের শুরু হয়। আজ অবধি দেশটি প্রায় ১ লক্ষ কিলোমিটার পথ প্লাস্টিক মিশ্রিত বিটুমিন দিয়ে নির্মাণ করেছে। এরপর থেকেই এশিয়া মহাদেশের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি প্রযুক্তিটি ইউরোপের একাধিক দেশে আলোর মুখ দেখা শুরু করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, ভিয়েতনাম, মেক্সিকো, ফিলিপাইন এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও খুব সম্প্রতি নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাস্তা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে। একাধিক কেস স্টাডি থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে বিটুমিনের পাশাপাশি প্লাস্টিকের ব্যবহার রাস্তাকে মজবুত করে। অত্যাধিক উচ্চ ও নিম্ন তাপমাত্রা, জলাবদ্ধতা, বেশি ভারী যানবাহন চলাচলের প্রতি সহনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এসব রাস্তায় ফাটল ও খানাখন্দের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে কম হয়। এ প্রসঙ্গে ওসান রিকভারি অ্যালায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা ডগ উডরিং বলেছেন,
প্লাস্টিক দূষণের হার কমাতে আমাদের আসলে বাস্তববাদী চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। এত বেশি পরিমাণ প্লাস্টিক দ্রব্যাদি সমুদ্রের পানিতে আর আবাদি জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যে, কোনো সুবিশাল কলেবরের এবং দীর্ঘমেয়াদি-টেকসই প্রকল্প ছাড়া এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। কংক্রিট, বিটুমিন ইত্যাদি প্রচলিত পদ্ধতির পাশাপাশি যদি প্লাস্টিকের ব্যবহারকে ব্যাপক আকারে করা যায় তাহলে প্লাস্টিক দূষণের একটি নির্ভরযোগ্য সমাধান হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
প্লাস্টিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে কাজ করছেন গ্রেগ হোয়াইট। তিনি অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অভ সানশাইন কোস্টের নির্মাণ প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। রাস্তা নির্মাণে প্লাস্টিক ব্যবহারের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন,
প্লাস্টিক দূষণের সমাধান হিসেবে রাস্তা নির্মাণে এর ব্যবহারের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হচ্ছে রাস্তার কোনো শেষ নেই। নতুন রাস্তা নির্মাণ হচ্ছেই নিরবচ্ছিন্নভাবে এবং সে সাথে পুরোনো রাস্তা সারানোর কাজ তো রয়েছেই। এই যে সমাধানের একটি পথ হিসেবে যোগানের চূড়ান্ত অন্তহীনতা এই ব্যপারটিই সবচেয়ে চমকপ্রদ।
অস্ট্রেলিয়ার চারটি প্রতিষ্ঠান মিলে সামগ্রিকভাবে শতাধিক মাইল রাস্তা নির্মাণ সম্পন্ন করেছে প্লাস্টিক ব্যবহারের মাধ্যমে। প্রাথমিকভাবে শুধু শহরতলীর পথগুলোর দিকেই আমাদের নজর সীমাবদ্ধ। কারণ নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে, স্থানীয় সরকার নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধাদি নিয়ে যতটা ভাবে কেন্দ্র সরকারের সে তুলনায় কোনো মাথাব্যথাই নেই। স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা যতটা সানন্দে এরকম টেকসই একটি সমাধানকে বেছে নিতে পারছেন ততটা পারছে না দেশের সরকার। কিন্তু দেশের হাজার হাজার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মহাসড়কগুলোতে এই প্রযুক্তির ব্যবহার সরকারের সুদৃষ্টি ছাড়া একেবারেই সম্ভব নয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে অ্যাসফল্টে সঠিক প্লাস্টিক যোগ করতে পারলে রাস্তা অবশ্যই দীর্ঘ মেয়াদের জন্য টিকে যাবে।
প্লাস্টিকের ব্যবহার সন্দেহাতীতভাবে একটি প্রশংসনীয় ও কার্যকর সমাধান। তবে কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে এই প্রযুক্তির। বিটুমিনের পাশাপাশি এত হাজার হাজার টন প্লাস্টিক পোড়ানো হলে প্রচুর পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ হবে প্লাস্টিকের দহন থেকে। বাসুদেবানের গবেষণা অনুযায়ী এই পদ্ধতির জন্য প্লাস্টিককে তাপ দিতে হয় ১৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। তার বক্তব্য এই যে এটি নিরাপদ সীমার মাঝেই আছে। ২৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গেলেই শুধু প্লাস্টিক বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণ শুরু করে। এর আগ পর্যন্ত এটি শুধু কঠিন থেকে তরলে পরিণত হয়।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্লাস্টিকের (মাইক্রোপ্লাস্টিক) ছড়িয়ে পড়া। রাস্তা নির্মাণে যে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহৃত হচ্ছে সেখান থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক যে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়বে না— সে বিষয়ে কোনো সুনিশ্চিত প্রমাণ মেলেনি। তাই এই আশঙ্কাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। উর্ধ্বমুখী জনপ্রিয়তার এই প্রযুক্তি নির্মাণ প্রকৌশলের ভবিষ্যতকে কতটা বদলে দিতে পারবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।