লোহিত সাগর ও আরব সাগরের নীল জলরাশির সমুদ্রতট ঘেঁষে অবস্থিত পৃথিবীর অন্যতম দস্যুরাষ্ট্র সোমালিয়া। হর্ন অব আফ্রিকার এ দেশের নামটুকু শোনামাত্র মানসপটে ভেসে ওঠে পণ্য পরিবাহী জাহাজ লুটপাট, নাবিকদের অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় কিংবা অতর্কিত হামলা, গোলাবর্ষণ ইত্যাদি সব দুর্ধর্ষ কর্মকান্ডের ভয়ংকর চিত্রপট। সেজন্য পৃথিবী জুড়ে কুখ্যাতিরও জুড়ি নেই তাদের। কিছুকাল পূর্বেও যে দেশের জনগণ মৎস্য আহরণ আর শস্য উৎপাদনকে বেছে নিয়েছিল জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন হিসেবে, রাতারাতি কিভাবে তারা পরিণত হলো এক ভয়ংকর দস্যু জাতিতে? কী এমন ঘটলো যার কারণে হতদরিদ্র এ দেশটি বদলে গেল জলদস্যুতার বীভৎস থাবায়? অতিসাধারণ জেলে পরিবার থেকে উঠে আসা এ মানুষগুলোই বা দস্যুপণায় মেতে উঠল কীভাবে? চলুন জেনে আসা যাক এর পেছনের ইতিহাস।
প্রাথমিক ইতিহাস
১৬৫০-পরবর্তী সময়; এডেন উপসাগরের নিকটবর্তী এ দেশ তখন রাজনৈতিক শাসন ও স্বৈরাচারী উপনিবেশ থেকে পুরোপুরি মুক্তভূমি। দেশের সর্বত্র তখন শান্ত-স্নিগ্ধ-নির্মল পরিবেশ। আর্থিক অভাব-অনটন থাকলেও তার ছিটেফোঁটাও বোঝার উপায় ছিল না। সমুদ্রের নোনাজল থেকে মৎস্য আহরণ করে সুখেই দিনাতিপাত করছিল মানুষগুলো। ঠিক সেসময় বিশ্বের অন্য প্রান্তে রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে মরিয়া হয়ে ওঠে শক্তিধর সাম্রাজ্যগুলো। যাতায়াতের জন্য তারা বেছে নেয় নির্ঝঞ্জাট সমুদ্রপথকে। পুরো বিশ্বের এখানে-সেখানে দাপটে চষে বেড়ায় তারা। চলে একের পর এক সাম্রাজ্য অভিযান, রাজ্য জয়ের প্রচেষ্টা।
এসব অভিযানে নাবিক ও কুলি হিসেবে যাদের ব্যবহার করা হতো, তাদের উপর চলতো অকথ্য নির্যাতন। হাড়ভাঙা খাটুনির পরও মিলত না একবেলার আহার। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় রোদে পুড়ে যেন একেকজন কালো ছাই। খাদ্যাভাবে, রোগ-শোকে তাদের কর্মক্ষমতা যখন শূন্যের কোঠায়, তখন অসহায় এসব মানুষদের ছুড়ে ফেলা হতো সাগরের অতল জলরাশিতে। অথৈ জলেই তারা ঢলে পড়তো মৃত্যুর কোলে। ঠান্ডা জলের সংস্পর্শে আধো ডুবো এ লাশগুলো ঢেউয়ের তোড়ে আছড়ে পড়তো সোমালিয়া উপকূলে। তা দেখেই আঁতকে উঠতো সোমালি মানুষগুলোর মন। রক্তক্ষরণ হতো হৃদয়ে। এতেই শক্তিধর রাজ্যসমূহের প্রতি জন্ম নিল বিরূপ ধারণা।
ঔপনিবেশিক শাসন
এর ঠিক কিছুকাল পর। ভৌগোলিকভাবে বন্দরের সুবিধাজনক এ দেশে যাত্রাবিরতির উদ্দেশ্যে নোঙর করা শুরু করলো পালতোলা জাহাজগুলো। সুচতুর দলপতি ও তুখোড় নাবিকরা নীরবে-নিভৃতে পরখ করতে শুরু করলো তাদের জীবন প্রক্রিয়া। চলতে লাগলো সময়। কোনোরূপ ক্ষতির আশঙ্কা না দেখায় সোমালিরাও সাহায্য করছিল তাদের। সময়ের সাথে সাথে জাহাজে ভেসে বেড়ানো এসব মানুষগুলোর প্রতি বিরূপ মনোভাব কেটে গিয়ে তৈরি হতে লাগলো ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।
আর এ সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী শক্তিগুলো। ঝোপ বুঝে কোপ দিলো সেখানে এবং পরিকল্পনা মাফিক পাঁচ খন্ডে বিভক্ত করলো বৃহৎ সোমালি জনপদকে। উত্তর আর দক্ষিণ সোমালিয়া গেল ব্রিটেন আর ইতালির অধীনে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অংশটুকু নিয়ে কেনিয়ার সাথে এঁটে দেওয়া হলো। বর্তমান জিবুতি কুক্ষিগত হলো ফরাসিদের মুষ্টিতে আর অবশিষ্ট ওগাদেন অঞ্চল যায় ইথিওপিয়ার দখলে। কেবল মৎস্য আহরণ আর শস্য উৎপাদনে অভ্যস্ত সোমালিদের তখন অস্ত্র আর গোলাবারুদের মুখে কিছুই করার ছিল না। শুরু হলো শাসন-শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হওয়ার এক রোমহর্ষক অভিযাত্রা।
সিয়াদ বারের আগমন
১৮৮৫ থেক ১৯৬৯ সাল নাগাদ নোংরাভাবে শাসিত হলো সোমালি জনপদ। অতঃপর ১৯৬৯ সালের শেষাংশে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সোমালিয়ার রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে সিয়াদ বারে নামে এক সেনা কর্মকর্তা। ব্রিটিশ ও ইতালীয়দের নিকট থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সিয়াদ বারের হাত ধরেই চলতে লাগলো সোমালিয়া। তবে, দানাবাধা ওগাদেন যুদ্ধ, সামরিক বিবাদ, অতর্কিত হামলা, গোত্র সংঘাত, নির্বিচারে গণহত্যা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে তোপের মুখে ১৯৯২ সালে ক্ষমতার মসনদ ছেড়ে কেনিয়ায় পালারতে বাধ্য হয় ষাটোর্ধ্ব এ নেতা। অবসান ঘটে সুদীর্ঘ ২২ বছরের সিয়াদ বারে শাসনের। বিলুপ্ত হয় সোমালিয়ান সরকার ব্যবস্থা।
সিয়াদ বারের পতনের পর অস্থিতিশীল গোষ্ঠীগুলো পুনরায় মেতে উঠে ক্ষমতা দখলের অন্তর্দ্বন্দ্বে। শান্ত-স্নিগ্ধ সোমালি জনপদ আবারও পরিণত হয় নরকভূমিতে। বিষয়টি নজর কাড়ে যুক্তরাষ্ট্রের। মিত্র দেশগুলোর সহযোগিতায় তারা সেখানে গড়ে তুলে সামরিক মহড়া। পাঠায় মানবিক সহযোগিতা। শুরু হয় হামলা-অভিযান। এসব অভিযানে চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ধরপাকড়। নিহত হয় হাজারো মানুষ। তবে, কিছুদিন যেতে না যেতেই হাঁপিয়ে উঠে আমেরিকাও। তোপের মুখে বাধ্য হয় সোমালিয়া ছাড়তে। অতঃপর, ১৯৯৫ সালে তল্পিতল্পা গুটিয়ে সোমালিয়া ছেড়ে যায় তারা।
ইউরোপীয়দের বেআইনি কর্মতৎপরতা
একদিকে আমেরিকার সোমালিয়া ছেড়ে যাওয়া, অন্যদিকে শাসন-শোষণের পর দেশটিতে বিরাজ করা স্থবির পরিস্থিতি। এমনকি ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করতে অবশিষ্ট কোনো সম্বলও ছিল না তাদের। নিম্নবিত্ত এ দেশটি যুদ্ধের তান্ডবে পরিণত হয়েছে নরকপুরীতে। নিজেদের সমুদ্র উপকূলও তখন নিরাপত্তার অভাবে খাঁ খাঁ করছে। এ সময় ইউরোপীয় দেশগুলোতে শুরু হয় শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির বাণিজ্যিক প্রচেষ্টা। বাজার সম্প্রসারণে উঠেপড়ে লাগে তারা। বৃদ্ধি পায় সম্ভাবনাময় শিল্পকারখানার সংখ্যা। তবে, এসবের সাথে তাল মিলিয়ে তৈরি হয় ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্য পদার্থ।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সুনির্দিষ্ট স্থান, পরিকল্পনা ও নীতিমালার অভাবে বর্জ্য বোঝাই বৃহদাকার কন্টেইনারসমূহ স্থানান্তরিত হয় ইতালীয় মাফিয়াদের কাছে। তারা সেগুলো খালাস করে সোমালিয়ার উপকূলে। ক্ষতিকর এসব বর্জ্যে বিদ্যমান ক্যাডমিয়া, নিকেল ও সীসার মতো কেমিক্যালের তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে উপকূলের আনাচে-কানাচে। আশপাশের মানুষগুলো আক্রান্ত হয় বিচিত্র সব রোগে। কমতে শুরু করে সমুদ্র উপকূলের মৎস্য সম্পদ।
রাতের আঁধারে যে জাহাজগুলো বর্জ্য খালাস করছিল, ফিরে যাওয়ার পূর্বে তারাই ধরে নিয়ে যাচ্ছিল মিলিয়ন ডলার মূল্যের ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ। এমনকি দিনের বেলায়ও সোমালিয়ার উপকূল থেকে বেআইনিভাবে মৎস্য শিকার করছিল ইয়েমেন, ইরান ও ইউরোপীয় দেশগুলো। এর মাধ্যমে ফুলে ফেঁপে উঠছিল তারা, পূর্ণ করছিল নিজেদের অর্থ ভান্ডার। এতে করে উপকূলের মৎস্যের অভাব ক্রমশই প্রকট হতে শুরু করলো। বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও তেমন কোনো সুফল পাওয়া গেল না। পদক্ষেপের ছিটেফোঁটাও গ্রহণ করেনি কেউ। এতে ক্ষোভ সৃষ্টি হয় সমগ্র জেলেপাড়ায়। সিদ্ধান্ত হলো- উপকূলে রহস্যজনকভাবে ঘুরে বেড়ানো জাহাজগুলোকে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাড়িয়ে দেবে তারা। শুরু হলো ছোট ছোট নৌকা করে পাহারা দেওয়া।
প্রথম আক্রমণ
১৯৯৫ সালের কোনো একদিন। উপকূলে অবৈধ জাহাজের অনুপ্রবেশ রোধে চলছে নজরদারি। নিত্যদিনের মতোই বসেছে কঠোর পাহাড়া। স্থানীয় জেলেদেরই কয়েকটি দল পালাক্রমে পালন করছে এ দায়িত্ব। তবে, তাদের ছোট নৌকা করে এসব গতিদানবের কাছাকাছি যেতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এমনই এক দিনে, আচমকা অদূরে ভেসে থাকা একটি জাহাজের দেখা মিলল।
দেরি না করে তারাও ঝটপট তৈরি হয়ে রওনা করল এর জেটির পানে। ছোট নৌকা করে তারা ঘিরে ফেলতে সমর্থ হলো একে এবং ডাঙার কাছাকাছি নিয়ে এলো। জেলেদের কোটরাগত বিবর্ণ চোখ আর শুকনো চোয়ালের মুখাবয়ব দেখে জাহাজের নাবিকরা বেশ ভরকে গেলো। তাই, তাদের শর্তমতো ক্ষতিপূরণ প্রদানে সম্মত হলো তারা। প্রদান করা হলো মূল্যবান অর্থসামগ্রী। সবকিছু বুঝে নেওয়ার পর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক জেলেরাও ছেড়ে দিল তাদের।
আধুনিক জলদস্যুতার উত্থান
সেদিনের সেই ছোট্ট ঘটনাই মোড় নিল আজকের আধুনিক জলদস্যুতায়। তাড়িয়ে দেওয়ার চেয়ে জব্দ করে ক্ষতিপূরণ কিংবা মুক্তিপণ আদায় করা যে বেশ সহজ, সেটি বেশ পছন্দ হয় জেলেদের কাছে। সৃষ্টি হয় বাড়তি আয়ের এক দারুণ সুযোগ! আর তাই নিজেদের শক্তিমত্তার পূর্ণ প্রয়োগে উঠেপড়ে লাগে সবাই। হাতে তুলে নেয় আধুনিক অস্ত্র, গোলাবারুদ, সাজ-সরঞ্জাম। স্টিলের পাতের ছোট নৌকাগুলোর সাথে এঁটে দেয় শক্তিশালী ইঞ্জিন, পাল্টে দেয় ক্ষিপ্র গতির আক্রমণাত্মক যুদ্ধযানে।
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পরিবর্তন ঘটে তাদের কৌশলী কর্মযজ্ঞে। গড়ে ওঠে তিনটি শক্তিশালী ইউনিট। যাদের কার্যক্রমে রাখা হয় ভিন্নতা। এসব ইউনিটে যোগদানে এগিয়ে আসে জেলেদের ছোট ছোট দল, সরকারের সাবেক সেনাসদস্য ও প্রযুক্তিবিদগণ। সমুদ্রের নাড়ি-নক্ষত্র সম্পর্কে সবজান্তা জেলেদের কাজ বাকি সদস্যদের সঠিক পথে পরিচালিত করা, মনুষ্য ম্যাপের মতো দিকনির্দেশনা প্রদান করা। যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতায় এগিয়ে থাকায় সেনাসদস্যদের জায়গা হয় অতর্কিত হামলা ও আক্রমণের অগ্রভাগে। আর, অত্যাধুনিক জিপিএস প্রযুক্তির উৎকর্ষ প্রয়োগ ও বাণিজ্যিক জাহাজের রাডারের চোখ ফাঁকি দিতে কাজে হাত বাড়ায় প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের দল।
আক্রমণের জন্য জলদস্যুরা সাধারণত বেছে নেয় গভীর রাত থেকে ভোরের সময়টা। এসব আক্রমণে ব্যবহৃত হয় RPG-7, TT33, Type56, AK47, AKM, RPK, PK ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র। এছাড়া ব্যবহৃত হয় F1 ও RGD-5-এর মতো হাতবোমাও!
বর্তমান প্রেক্ষাপট
২০০০-১২ সাল পর্যন্ত ছিল সোমালিয়ান জলদস্যুতার স্বর্ণযুগ। সাগরজলে বীরদর্পে চলা এসব জলদস্যু পরিচালনা করেছে শত শত হামলা। এসব অভিযান থেকে হাতিয়ে নিয়েছে মিলিয়ন ডলার অর্থমুদ্রা। যদিও, ২০১৩ সালে জাতিসংঘ, ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বেশ কিছু দেশের কঠোর হস্তক্ষেপ ও দমন নীতির পর দস্যুবৃত্তি কমে আসে অনেকটা। তবে, ২০১৭ সালের মার্চ মাসে জ্বালানিবাহী ট্যাংকার এরিস আক্রমণের মাধ্যমে ৫ বছর পর আবারও বড়সড় কোনো হামলা পরিচালনা করে তারা।
সম্পদ আহরণে শোষক শ্রেণির অনৈতিক কর্মপন্থা অবলম্বন, আভিজাত্যপূর্ণ মোহময় জীবনের লোভ-লালসা আর এর ভয়াল থাবার কবলে পড়ে সোমালিয়ার প্রাণোচ্ছল জেলেরা আজ বয়ে বেড়াচ্ছে জলদস্যুতার কলঙ্কিত বোঝা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আর সময়ের নীরব স্রোতে তারা আজ পুরো পৃথিবীর নিকট বীভৎস জাতিসত্তা। এ জাতিসত্তার উত্থানে ফুলে ফেঁপে ওঠা উন্নত বিশ্ব কতটুকু দায়ী? প্রশ্নটি না হয় তোলা থাকুক আজ।