প্রখ্যাত আর্জেন্টাইন লেখক হোর্হে লুইস বোর্হেস একবার বলেছিলেন, “আমি সবসময় স্বর্গকে একটি গ্রন্থাগার হিসেবে কল্পনা করেছি।” সত্যিই, যারা বুকওয়ার্ম তথা গ্রন্থকীট, তাদের মধ্যে গ্রন্থাগারের পরিবেশ একধরনের স্বর্গীয় অনুভূতিরই সৃষ্টি করে। আর যদি সেই গ্রন্থাগারটিতে লক্ষ লক্ষ বই থাকে? তাহলে তো সেটি কেবল গ্রন্থকীট নয়, যেকোনো রুচিশীল মানুষকেই হতবাক করে দিতে বাধ্য!
২০২০ সালে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় অবস্থিত তুর্কি রাষ্ট্রপতির আবাসস্থল প্রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সে (Cumhurbaşkanlığı Külliyesi) তুরস্কের বৃহত্তম গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। গ্রন্থাগারটির নামকরণ করা হয় ‘প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি’ (Cumhurbaşkanlığı Kütüphanesi)। গ্রন্থাগারটিতে বইয়ের পাশাপাশি রয়েছে প্রচুর অ্যাকাডেমিক জার্নাল, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, অডিও ফাইল, মানচিত্র, ডাকটিকিট, চিত্র এবং পাণ্ডুলিপি।
এই সুবৃহৎ গ্রন্থাগারটিতে রয়েছে বিশ্বে প্রচলিত ১৩৪টি ভাষায় লিখিত ৪০ লক্ষাধিক বই, প্রায় ১২ কোটি ইলেক্ট্রনিক সংস্করণ, প্রায় ৫,৫০,০০০ ই–বুক ও দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ, প্রায় ১২ কোটি আর্টিকেল ও প্রতিবেদন এবং প্রায় ৬৫ লক্ষ ই–ডিসার্টেশন (গবেষণামূলক প্রবন্ধ)! তদুপরি, তুর্কি রাষ্ট্রীয় আর্কাইভের ৪ কোটি ৫০ লক্ষ ডকুমেন্ট, তুর্কি পাণ্ডুলিপি সংস্থা থেকে সংগৃহীত প্রায় ৩,০০,০০০ পাণ্ডুলিপি, তুর্কি রেডিও ও টেলিভিশন কর্পোরেশনের (Türkiye Radyo ve Televizyon Kurumu, TRT) আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত প্রায় ১২ লক্ষ অডিও ফাইল এবং ৪৬টি ডাটাবেজ থেকে সংগৃহীত ৬০,০০০ ই–ম্যাগাজিন রয়েছে এই গ্রন্থাগারটিতে।
এটি একটি ‘আমানত গ্রন্থাগার’ (depository library), এজন্য তুরস্কে প্রকাশিত প্রতিটি বইয়ের একটি কপি এখানে জমা রাখতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন রাষ্ট্রে অবস্থিত তুর্কি দূতাবাসগুলো তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় সেখান থেকে বই সংগ্রহ করে সেগুলো এই গ্রন্থাগারে প্রেরণ করে।
২০১৬ সালে তুর্কি রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান এই গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন এবং প্রচুর গবেষণা ও পর্যালোচনার পর তুরস্কের শীর্ষ বুদ্ধিজীবী, গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপক ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই পরিকল্পনাটি রূপায়িত হয়। ৩ বছর ধরে প্রায় ৩,০০০ মানুষের পরিশ্রমে গ্রন্থাগারটি গড়ে ওঠে। ২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান গ্রন্থাগারটি উদ্বোধন করেন এবং উজবেকিস্তানের রাষ্ট্রপতি শাভকাত মির্জিয়োয়েভ এসময় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। মির্জিয়োয়েভ উজবেকিস্তানে প্রাপ্ত পবিত্র কুরআনের একটি দুষ্প্রাপ্য কপি গ্রন্থাগারটিতে উপহার হিসেবে প্রদান করেন।
গ্রন্থাগারটি ১,২৫,০০০ বর্গ মিটার বা প্রায় ১৫,০০,০০০ বর্গ ফুট জায়গায় নির্মিত হয়েছে। তুর্কি প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে এই গ্রন্থাগারটির পিছনে তুর্কি সরকার সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে। শ্বেত ও গোলাপি মার্বেল পাথরে সজ্জিত গ্রন্থাগারটি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে সেলজুক, ওসমানীয় এবং আধুনিক স্থাপত্যশৈলী। গ্রন্থাগারটিতে যতগুলো বইয়ের তাক রয়েছে, সেগুলোকে এক সারিতে দাঁড় করালে সেটি ২০১ কি.মি. দীর্ঘ হবে!
গ্রন্থাগারটি দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা তুর্কি পরিচয়পত্র বা বিদেশি পাসপোর্টধারী যেকোনো ব্যক্তির জন্য উন্মুক্ত এবং একসঙ্গে প্রায় ৫,০০০ পাঠককে অধ্যয়নের সুযোগ দিতে সক্ষম। গ্রন্থাগারটির বর্তমান পরিচালক আয়হান তুগলু। গ্রন্থাগারটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিশ্বের কোনো গ্রন্থাগারেই প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এত বেশি সংখ্যক বই ছিল না!
গ্রন্থাগারটির অন্যতম একটি আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে সিহান্নুমা (Cihannuma, ‘বৈশ্বিক মানচিত্রাবলি’) হল। হলটির কেন্দ্রীয় গম্বুজ ৩২ মিটার উঁচু এবং ২৭ মিটার প্রশস্ত। ৩,৫০০ বর্গ মিটার জুড়ে অবস্থিত হলটিতে ১৬টি স্তম্ভ রয়েছে, যেগুলো ১৬টি ঐতিহাসিক তুর্কি রাষ্ট্রের নির্দেশক। এই রাষ্ট্রগুলো হলো বৃহৎ হুন সাম্রাজ্য, পশ্চিম হুন সাম্রাজ্য, ইউরোপীয় হুন সাম্রাজ্য, শ্বেত হুন সাম্রাজ্য, গোকতুর্ক সাম্রাজ্য, অ্যাভার খাগানাত, খাজার খাগানাত, উইঘুর খানাত, কারা–খানিদ খানাত, গজনভী সাম্রাজ্য, সেলজুক সাম্রাজ্য, খরজেম সাম্রাজ্য, সোনালি হোর্ড, তৈমুরীয় সাম্রাজ্য, মুঘল সাম্রাজ্য এবং ওসমানীয় সাম্রাজ্য।
হলটির গম্বুজে পবিত্র কুরআনের নাযিলকৃত প্রথম সূরা অর্থাৎ সূরা আলাকের ৪র্থ ও ৫ম আয়াত খোদাই করা হয়েছে। আয়াত দুটির অর্থ হচ্ছে– “যিনি (আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন কলমের সাহায্যে; শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতোই না” (O, kalemle yazmayı öğretendir, insana bilmediğini öğretendir)। এই আয়াত দুইটি দ্বারা শিক্ষা ও লেখনীর তাৎপর্য বোঝানো হয়েছে।
সিহান্নুমা হলে বিশ্বে প্রচলিত ১৩৪টি ভাষায় লিখিত প্রায় ২ লক্ষ বই রয়েছে। হলটিতে একটি ‘বিশ্ব গ্রন্থাগার’ রয়েছে। যেসব রাষ্ট্রে তুরস্কের দূতাবাস রয়েছে, সেসব রাষ্ট্র থেকে ঐসব রাষ্ট্রের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত বই তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয় এবং এই ‘বিশ্ব গ্রন্থাগারে’ জমা রাখা হয়। এখানে একসঙ্গে ২২৪ জন পাঠক পড়াশোনা করতে পারেন।
গ্রন্থাগারটিতে ‘দুষ্প্রাপ্য বইয়ের গ্রন্থাগার’ নামক একটি অংশ রয়েছে এবং এখানে প্রায় ৫০,০০০ দুষ্প্রাপ্য বই রয়েছে। এই বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ১০৭২–৭৪ সালে প্রখ্যাত তুর্কি পণ্ডিত মাহমুদ কাশগড়ী কর্তৃক রচিত তুর্কি ভাষাসমূহের প্রথম বিস্তারিত অভিধান ‘দিওয়ান লুঘাত আল–তুর্ক’। তুর্কি সুফিবাদ সংক্রান্ত বিখ্যাত লেখক, সমালোচক ও অনুবাদক আব্দুলবাকি গোল্পিনারলির সংগৃহীত পাণ্ডুলিপিসমূহ এবং খ্যাতিমান তুর্কি কলামিস্ট সেভকেত এইগির ব্যক্তিগত সংগ্রহও এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়া ওসমানীয় আমলে প্রবর্তিত আইনগুলোর কপিও সংরক্ষিত রয়েছে এখানে।
এছাড়া গ্রন্থাগারটিতে রয়েছে একটি স্বতন্ত্র ‘গবেষণা গ্রন্থাগার’। এই অংশে প্রায় ২০,০০০ বই রয়েছে এবং দলগত অধ্যয়নের (group study) জন্য রয়েছে ২০টি কক্ষ।
গ্রন্থাগারটিতে আরো রয়েছে একটি ‘মাল্টিমিডিয়া গ্রন্থাগার’, যেখানে ৪টি ডিজিটাল কক্ষ এবং সেগুলোর অভ্যন্তরে ১২টি পাঠকক্ষ রয়েছে। ডিজিটাল কক্ষগুলোতে রয়েছে টাচস্ক্রিন মনিটর, যেগুলোর মাধ্যমে টিআরটি–এর আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত লক্ষ লক্ষ অডিও ফাইল এবং আরো প্রায় ১০,০০০ অডিও–ভিজুয়াল ম্যাটেরিয়াল দেখা ও শোনা যাবে।
এছাড়া গ্রন্থাগারটিতে একটি ‘সাময়িকী হল’ রয়েছে। এখানকার সংগ্রহে রয়েছে ১,৫৫০টি ম্যাগাজিন ও সংবাদপত্রের বিভিন্ন সংস্করণ। তদুপরি, এখানে টাচস্ক্রিন মনিটরে ১২০টি দেশের ৬০টি ভাষায় লিখিত ৭,০০০ দৈনিক পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন পড়ার সুযোগ রয়েছে।
শিশু–কিশোরদের জন্যও গ্রন্থাগারটিতে পৃথক দুইটি অংশ রয়েছে। ৫ থেকে ১০ বছর বয়সীদের জন্য রয়েছে ‘নাসরেদ্দিন হোজা শিশু গ্রন্থাগার’। এখানে প্রায় ২৫,০০০ বই এবং একটি মাল্টিমিডিয়া সেকশন রয়েছে। ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের জন্য রয়েছে ‘যুব গ্রন্থাগার’ এবং সেখানে প্রায় ১২,০০০ বই রয়েছে।
শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্যও গ্রন্থাগারটিতে বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। তুরস্কের শীর্ষ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি তুর্কসেল এবং তুর্ক টেলিকমের তত্ত্বাবধানে গ্রন্থাগারটিতে দৃষ্টিহীন ও শ্রবণশক্তিহীন ব্যক্তিদের পড়াশোনার জন্য বিশেষ ধরনের কক্ষ নির্মিত হয়েছে।
যেসব পাঠক ভোজনরসিক, তাদেরকেও গ্রন্থাগারটি নিরাশ করবে না। কারণ, গ্রন্থাগারটিতে একটি রেস্তোরাঁ, একটি ক্যাফে এবং একটি বেকারি (bakery) রয়েছে। এজন্য কোনো চরম গ্রন্থকীট যদি সারাদিন এই গ্রন্থাগারটিতে পড়ে থাকতে চায়, তাহলেও তার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না!
গ্রন্থাগারটি কেবল বইয়ের সংগ্রহশালাই নয়, এটি একটি গবেষণা কেন্দ্রও বটে। এখানে তরুণ–তরুণীদের জন্য কর্মশালার আয়োজন করা হয় এবং সেখানে তারা প্রাকৃতিক ও কারিগরি বিজ্ঞানের চর্চা করতে পারে। এছাড়া গ্রন্থাগারটিতে নিয়মিত বিভিন্ন সেমিনার–সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয় এবং এসবে যোগদান করে পাঠকরা বিখ্যাত লেখক ও বৈজ্ঞানিকদের সাহচর্য লাভ করতে পারে।
প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি এখন পর্যন্ত তুরস্কে নির্মিত সবচেয়ে বড় গ্রন্থাগার। কিন্তু এই অবস্থানটি গ্রন্থাগারটির পক্ষে বেশি দিন ধরে রাখা সম্ভব হবে না। কারণ তুর্কি সরকার তুরস্কের বৃহত্তম শহর ইস্তাম্বুলে নতুন একটি গ্রন্থাগার নির্মাণ করতে যাচ্ছে, যেটিতে থাকবে ৭০ লক্ষাধিক বই! কিন্তু অনন্য নির্মাণশৈলীতে সৃষ্ট প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি যে তুর্কি পাঠকদের জ্ঞানার্জন ও গবেষণার জন্য বিরাট এক সুযোগ হিসেবে থেকে যাবে, সেটি বলাই বাহুল্য।