মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আরোহণের শুরুতে সংকল্প করেছিলেন যে, দশকের পর দশক ধরে চলা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানকল্পে তিনি এমন একটি ‘বড় এবং অধিকতর ভালো’ চুক্তির মধ্যস্থতা করবেন যে, কেউ কোনোদিন তা কল্পনা করেনি। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২৮ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে সাথে নিয়ে তার বহুল প্রতীক্ষিত ‘মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা’ (Middle East Peace Plan) প্রকাশ করেছেন।
পরিকল্পনা অনুসারে, এ অঞ্চলে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন নামে দুইটি আলাদা স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হবে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একে ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’ (Deal of the Century) বলে অভিহিত করেছেন। তিনি দাবি করেন যে, ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের জন্য তার এই শান্তি পরিকল্পনা আগামী ৮০ বছর স্থায়ী হওয়ার জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। কিন্তু আদতে এই পরিকল্পনা ৮০ মিনিটও স্থায়ী হবে কিনা তা নিয়ে বিশ্লেষকগণ যথেষ্ট সন্দিহান।
ট্রাম্পের আড়ালে এই পরিকল্পনার নেপথ্য নায়ক যে ট্রাম্পের ইহুদি জামাতা জ্যারেড কুশনার তা খুব সহজেই অনুমেয়। প্রস্তাবিত এই পরিকল্পনা প্রস্তুতকালে কোনো ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিকে রাখা হয়নি এবং এর পরতে পরতে ইসরায়েলের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু একে ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যানের স্বীকৃতি দানের সাথে তুলনা করেছেন। অপরদিকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এই পরিকল্পনাকে সরাসরি বাতিল করে দিয়েছে।
‘Peace to Prosperity’ শিরোনামের এই পরিকল্পনা দুইটি অংশে বিভক্ত- রাজনৈতিক প্রস্তাবনা এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। রাজনৈতিক প্রস্তাবনায় প্রধানত চারটি বিষয় রাখা হয়েছে- ‘অবিভক্ত জেরুজালেম’ হবে ইসরায়েলের সার্বভৌম রাজধানী, পশ্চিম তীর এবং ইসরায়েলের মধ্যকার সীমানা নতুন করে অঙ্কিত হবে, ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা ইসরায়েলে ফিরতে পারবে না এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কোনোরকম প্রতিরক্ষা বাহিনী সৃষ্টি করতে পারবে না।
জেরুজালেম প্রসঙ্গ
১৯৪৮ সালের প্রথম আরব ইসরায়েল যুদ্ধের পর জেরুজালেম শহর পশ্চিম জেরুজালেম এবং পূর্ব জেরুজালেম- এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পশ্চিম জেরুজালেম ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এটি ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। অপরদিকে পূর্ব জেরুজালেম ফিলিস্তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এটির নিয়ন্ত্রণ থাকে জর্ডানের হাতে।
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেমসহ পুরো পশ্চিম তীর দখল করে নেয় এবং পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরায়েলের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত (Annex) করে নেয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই অন্তর্ভুক্তিকে অবৈধ মনে করে। কিন্তু ইসরায়েল সম্পূর্ণ জেরুজালেমকে নিজেদের বলে দাবি করে এবং সেই লক্ষ্যে এখানে ক্রমাগত ইহুদি বসতি নির্মাণ করে চলে যা আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে সম্পূর্ণ অবৈধ। বর্তমানে পূর্ব জেরুজালেমে ২১৫০০০ ইহুদি সেটেলার বসবাস করে।
ফিলিস্তিনিরা তাদের ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী করতে চায় পূর্ব জেরুজালেমকে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনায় সেটিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। সেখানে জেরুজালেমের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘Israel’s undivided capital’ অর্থাৎ ইসরায়েলের অবিভক্ত রাজধানী। অপরদিকে পূর্ব জেরুজালেম শহরের পূর্ব দিকে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পরবর্তীতে স্পষ্ট করেন যে, এটি হবে পূর্ব জেরুজালেমের সীমানার বাইরে পূর্ব দিকে অবস্থিত আবু দিস গ্রাম এলাকায়।
সীমানা পুনঃনির্ধারণ
সীমানা পুনঃনির্ধারণ সম্পর্কে জানার পূর্বে বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। বর্তমান ফিলিস্তিন দুইটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত- পশ্চিম তীর এবং গাজা। এদের মধ্যে পশ্চিম তীর হচ্ছে প্রধান ভূমি। জর্ডান নদীর পশ্চিমে অবস্থিত বলে একে পশ্চিম তীর বলা হয়। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল এই পশ্চিম তীর দখল করে নেয়। সেই থেকে পশ্চিম তীর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পশ্চিম তীরে ক্রমাগত ইহুদি বসতি নির্মাণ করে চলেছে। বর্তমানে পশ্চিম তীরে ২৫০ ইহুদি বসতিতে (১৩০ অফিসিয়াল, ১২০ আনঅফিসিয়াল) ছয় লক্ষ থেকে সারে সাত লক্ষ ইহুদি সেটেলার বসবাস করে।
জর্ডান উপত্যকা হলো পশ্চিম তীরের পূর্ব দিকের লম্বা আকৃতির একটি সীমান্তবর্তী অংশ যা পশ্চিম তীরকে জর্ডানের সাথে যুক্ত করেছে। এই উপত্যকা পশ্চিম তীরের মোট ভূমির ৩০ শতাংশ যা অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনায় ‘Conceptual Map’ শিরোনামে নতুন করে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে পশ্চিম তীরের অবৈধ ইহুদি বসতি এলাকাগুলো (পশ্চিম তীরের ৩ শতাংশ) এবং জর্ডান উপত্যকা ইসরায়েল রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত (Annex) হবে।
‘জর্ডানের সাথে ইসরায়েলের শান্তিচুক্তি থাকার ফলে বর্তমানে জর্ডানের দিক থেকে নিরাপত্তা উদ্বেগ না থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য শক্তি জোরপূর্বক জর্ডানের ভূমিকে ইসরায়েল আক্রমণের প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে পারে’ এমন খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে জর্ডান উপত্যকার স্থল এবং আকাশসীমায় ইসরায়েলি সার্বভৌমত্ব থাকার কথা বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে ইসরায়েল জর্ডান উপত্যকা এবং পশ্চিম তীরের ইহুদি বসতিগুলো অ্যানেক্স করার তোড়জোড়ও শুরু করে দিয়েছে। এতে করে পশ্চিম তীর চারদিক হতেই ইসরায়েল দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়বে। [জর্ডান উপত্যকা অ্যানেক্সেশন সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে]
এসব ভূমির পরিবর্তে ফিলিস্তিনকে ইসরায়েলের পশ্চিম দিকে অবস্থিত নেগেভ মরুভূমির দুইটি প্রায় বিচ্ছিন্ন অঞ্চল প্রদান করা হবে যেখানে থাকবে রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া, ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন এবং আবাদের জন্য কৃষি ভূমি। প্রস্তাবনা অনুসারে বিচ্ছিন্ন গাজা এবং পশ্চিম তীর একটি টানেল দ্বারা সংযুক্ত থাকবে। সর্বোপরি এই পরিকল্পনা মোতাবেক ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের মোট ভূমির ইসরায়েল পাবে ৮৫ শতাংশ এবং ফিলিস্তিন পাবে ১৫ শতাংশ। এই নতুন সীমানায় অভিযোজনের জন্য উভয় রাষ্ট্র সময় পাবে চার বছর।
এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে একদিকে পশ্চিম তীরের অবৈধ ইহুদি বসতিগুলো যেমন ‘জায়েজ’ করা হবে, তেমনি অন্যদিকে জর্ডান উপত্যকার মত উর্বর ভূমি (যা কিনা পশ্চিম তীরের মোট আবাদযোগ্য কৃষির জমির ৫০ শতাংশ) ছিনিয়ে নিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্র দ্বারা ফিলিস্তিনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হবে। অথচ এমন উর্বর ভূমির পরিবর্তে দেওয়া হবে নেগেভ মরুভূমির অংশ! ঠিক যেন গরু মেরে জুতো দান!
নো রাইট টু রিটার্ন
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনি শরণার্থী সমস্যা একটি বড় ফ্যাক্টর। ১৯৪৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাস্তুচ্যুত হওয়া মোট ফিলিস্তিনি শরণার্থীর সংখ্যা সাত মিলিয়নেরও (৭০ লক্ষ) বেশি। এই বিশাল সংখ্যক ফিলিস্তিনি শরণার্থী বর্তমানে পশ্চিম তীর এবং গাজা সহ জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক এবং মিশরের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে বসবাস করে।
শান্তি আলোচনায় ফিলিস্তিনিদের অন্যতম দাবি হলো বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে তাদের বাড়িতে ‘প্রত্যাবর্তনের অধিকার’ ফিরিয়ে দিয়ে তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করা। কিন্তু ইসরায়েল তা মানতে নারাজ। বর্তমানে ইসরায়েলের মোট জনসংখ্যা ৯ মিলিয়নের মতো, যাদের মধ্যে প্রায় ১.৯ মিলিয়ন আরব মুসলিম। ইসরায়েল মনে করে, ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ফিরতে দিলে নিজ দেশে ইহুদিরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্র এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত। তাই শান্তি পরিকল্পনায় এই শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের অধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে এবং আরব-ইসরায়েল সংঘাতের ফলে সৃষ্ট ইহুদি শরণার্থীরা, যাদের বেশিরভাগকেই ইসরায়েল নাগরিকত্ব প্রদান করেছিল, তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এমনকি ইহুদি শরণার্থী গ্রহণ করার জন্য ইসরায়েল রাষ্ট্রকে ‘এই শান্তি পরিকল্পনা হতে আলাদা একটি যথাযথ আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ায়’ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারেও জোর দেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের বিকল্প হিসেবে শরণার্থীদের জন্য সম্ভাব্য তিনটি পথ বাতলে দেওয়া হয়েছে– শরণার্থীদেরকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করা অথবা বর্তমান আশ্রয়দাতা দেশের অনুমতি সাপেক্ষে সেই দেশের নাগরিক হিসেবে অন্তর্ভুক্তকরণ অথবা OIC (Organization of Islamic Cooperation) এর আগ্রহী সদস্য দেশগুলো প্রতি বছর পাঁচ হাজার করে দশ বছরে মোট পঞ্চাশ হাজার শরণার্থী গ্রহণ।
লক্ষণীয় যে, ইসরায়েল রাষ্ট্র এবং ইহুদি শরণার্থীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে করার কথা বলা হচ্ছে অথচ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফিলিস্তিনি নাগরিকদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের অধিকারকে অস্বীকার করা হচ্ছে।
আবার, যেখানে ইসরায়েল ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের ৮৫ শতাংশ ভূমি নিয়েও শরণার্থীদের নিজ ভূমিতেই প্রত্যাবর্তন মেনে নেবে না সেখানে ৫ মিলিয়ন জনসংখ্যাসহ মাত্র ১৫ শতাংশ (যা কিনা মাত্র ৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার) ভূমি নিয়ে ফিলিস্তিন কীভাবে আরো অতিরিক্ত ৭ মিলিয়ন মানুষকে তার নিজ দেশের নাগরিক করবে সেটা বোধগম্য নয়। উপরন্তু, আশ্রয় দাতা দেশগুলো কিংবা ওয়াইসির সদস্য দেশগুলি ফিলিস্তিনি শরণার্থীদেরকে নাগরিক হিসেবে মেনে নিতে রাজি হবে কিনা সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
প্রতিরক্ষা প্রসঙ্গ
১৮১ পৃষ্ঠার এই পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, “The State of Palestine will not be able to develop military or paramilitary capabilities inside or outside of the State of Palestine” অর্থাৎ ফিলিস্তিন তার রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কিংবা বাইরে কোনোরকম সামরিক অথবা আধাসামরিক বাহিনী গঠন করতে পারবে না। এছাড়া আরো বলা হয়েছে, ইসরায়েল রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি এমন কোনো অস্ত্র যেমন- যুদ্ধবিমান, ট্যাংক, মেশিনগান, মাইন, রকেট, মিসাইল, লেজার অস্ত্র, নৌ জাহাজ/ট্যাংক/যুদ্ধবিমান বিধ্বংসী অস্ত্র কিংবা কোনো সামরিক স্থাপনা, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, সাইবার এবং ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক যুদ্ধ সক্ষমতা, অস্ত্র উৎপাদন/আহরণ সুবিধা এবং সামরিক প্রশিক্ষণ সুবিধা ইত্যাদির মালিক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হতে পারবে না।
পরিকল্পনার আরও একটি অংশ হলো, এ অঞ্চলে হামাস এবং ইসলামিক জিহাদ নামে কোনো সংগঠন থাকবে না। হামাস মূলত একটি গেরিলা সংগঠন যারা বর্তমানে গাজা শাসন করে। ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ বা সংক্ষেপে ইসলামিক জিহাদও একটি সশস্ত্র সংগঠন যারা ইসরায়েলকে শত্রু বিবেচনা করে।
একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র তার নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে সামরিক বাহিনী গড়ে তুলবে এটাই স্বাভাবিক। অথচ এই পরিকল্পনা তা সরাসরি অস্বীকার করে। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন হবে। ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফ্রিডম্যানের কথায় সেই ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, “ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকবে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে। যদিও ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব সরকার ব্যবস্থা থাকবে তবুও নিরাপত্তার স্বার্থে ফিলিস্তিনি এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনীর টহল এবং ইচ্ছেমতো কাজ করার অনুমতি থাকবে” যা ইসরায়েলি বাহিনী ১৯৬৭ সাল থেকেই দখলকৃত পশ্চিম তীরে করে আসছে।
অর্থাৎ যা বহু আগে থেকেই ঘটে আসছে সেটাই এবার সবার অনুমতি নিয়ে রাখঢাক করে করতে চাচ্ছে মার্কিন-ইসরায়েল অক্ষ। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, এই তথাকথিত শান্তি পরিকল্পনা ফিলিস্তিনকে ইসরায়েলের করদ রাজ্যে পরিণত করার একটি আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপত্র মাত্র।
অর্থনৈতিক প্রস্তাবনা
রাজনৈতিক প্রস্তাবনার পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের জন্য অর্থনৈতিক প্রস্তাবনাও রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে তাদের ক্ষমতায়নে কাজ করা হবে। সেই লক্ষ্য অর্জনে আগামী দশ বছরে ফিলিস্তিনে ৫০ বিলিয়ন ডলার নতুন বিনিয়োগ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই বিনিয়োগ কোথা থেকে আসবে সে ব্যাপারে কিছু বলা নেই।
সমালোচকরা এই প্রস্তাবকে ‘একজন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর ইশতেহারের’ সাথে তুলনা করে এর নিন্দা করেন। তারা মনে করেন, ট্রাম্প প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের সহায়তা প্রকল্পে যে অর্থ সাহায্য বন্ধ করেছিল, হয়তো সেটি পুনরায় চালু করে প্রকল্পের চকচকে, প্রচারণামূলক ছবিগুলোকে সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণ বলে চালিয়ে দেবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শুরু থেকেই এই পরিকল্পনায় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এর প্রতি ‘এক হাজারবার না’ বলে একে ‘ইতিহাসের ডাস্টবিনের অন্তর্গত’ বলে অভিহিত করেছেন। এটি প্রকাশের সাথে সাথে পশ্চিম তীর এবং গাজায় মানুষজন এর বিরোধিতা করে তৎক্ষণাৎ বিক্ষোভ করেছে। তুরস্ক এবং ইরান এই পরিকল্পনার নিন্দা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট সিনেটররা একে ‘একপেশে’ উল্লেখ করে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে।
মিশর এবং ফ্রান্স এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এটিকে ‘সতর্কভাবে নিরীক্ষণ’ করবে বলে জানিয়েছে। কাতার এই মধ্যস্থতার পদক্ষেপে সাধুবাদ জানালেও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে পরিকল্পনায় না নেওয়ায় এটি ‘অসাধ্য’ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। জর্ডান এই পরিকল্পনাকে ভালোভাবে নেয়নি। তারা পশ্চিম তীরের ভূমিকে ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্তিকরণ ‘মারাত্মক ফলাফল’ বয়ে আনতে পারে বলে সতর্ক করেছে। অপরদিকে সৌদি আরব এবং যুক্তরাজ্য এই পরিকল্পনার প্রশংসা করে বিবৃতি দিয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের এমন পক্ষপাতিত্ব কারণ
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই তার মিত্র ইসরায়েলের পক্ষে থেকে সবসময় ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষা করলেও উপরে উপরে একটু লৌকিকতা বজায় রেখেছে, ট্রাম্প প্রশাসনের মত এমন ‘চক্ষুলজ্জা বিহীন অন্ধ পক্ষপাতিত্ব’ হয়তো কখনোই করেনি। বিশ্লেষকগণ মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং নেতানিয়াহু নেতৃত্বাধীন ডানপন্থী লিকুদ পার্টির প্রতি ট্রাম্পের সমর্থন এর অন্যতম কারণ যার প্রভাব এই পরিকল্পনাতেও সুস্পষ্ট। তাদের এই বন্ধুত্ব একদিকে যেমন শান্তি প্রক্রিয়ায় ফিলিস্তিনিদের অংশগ্রহণের সুযোগকে বিনষ্ট করে এই অঞ্চলে নেতানিয়াহুর অগ্রাধিকারকে নিশ্চিত করেছে তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে কয়েক দশক ধরে চলা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতেও বিরাট পরিবর্তন এনেছে। উদাহরণস্বরূপ- ২০১৯ সালে সিরিয়ার গোলান মালভূমিকে ইসরায়েলের বলে স্বীকৃতি, ২০১৭ সালে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান এবং ২০১৮ সালে মার্কিন দূতাবাস ইসরায়েলের তেল আভিভ থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরিত হওয়া- তিনটি পদক্ষেপই ইসরায়েল নিয়ে এযাবতকালে গৃহীত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন পদক্ষেপ।
দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নেতানিয়াহুর অবস্থান অনেকটাই নড়বড়ে। তিনি ঘুষ, জালিয়াতিসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। তাই এমন টালমাটাল অবস্থায় এরকম একটি পরিকল্পনার মাধ্যমে নেতানিয়াহুকে রক্ষা করাও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অন্যতম উদ্দেশ্য।
তৃতীয়ত, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইহুদি জামাতা জ্যারেড কুশনারও এমন পক্ষপাতিত্বের অন্যতম নিয়ামক।
চতুর্থত, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। কেননা রিপাবলিকানরা চায় ট্রাম্প ইসরায়েলের স্বার্থই রক্ষা করুক। তাই এই পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে নিজেকে আরো বেশি ইসরায়েল-পন্থী প্রমাণ করে আসন্ন নির্বাচনে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করাও ট্রাম্পের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য।
শেষকথা
এই তথাকথিত ‘Deal of the Century’ তে এটি সুস্পষ্ট যে, ফিলিস্তিনিরা মেনে নিক বা না নিক, এই রূপরেখা অনুসারেই এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ হবে। তাতে করে এই সমাধান কতটুকু বাস্তবসম্মত হবে বা আদৌ এটি ‘সমাধান’ বলে বিবেচিত হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়।
অপরদিকে, বর্তমানে যেখানে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লিবারেল জায়োনিস্টরা পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর উপস্থিতির মতো বাস্তবতাকে স্বীকার করে ‘ইহুদি এবং ফিলিস্তিনি, সবার জন্য সমান সুবিধা’ নিশ্চিত করে এমন একটি এক রাষ্ট্রিক সমাধানের পক্ষে মতামত দিতে শুরু করেছে সেখানে ট্রাম্প প্রশাসনের ১৮১ পাতার এমন ‘অন্তঃসারশূন্য’ পরিকল্পনা প্রণয়ন এই সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার নৈতিক যোগ্যতাকে সত্যিকার অর্থেই চ্যালেঞ্জ করে। আগামী দিনগুলোতে সেই চ্যালেঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে মোকাবেলা করে কিংবা আদৌ সেটিকে পাত্তা দেয় কিনা সেটিই এখন দেখার বিষয়।