প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, বিশাল অংকের সামরিক বাজেট, অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের সমাহার কিংবা বিভিন্ন পৃথিবীর যেকোনো পরিবেশে সফল অপারেশন চালানোর মতো দুধর্ষ সামরিক বাহিনীর বিশেষজ্ঞ মার্কিন সামরিক বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্বের কথা একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। দুটো বিশ্বযুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর মার্কিন সেনাবাহিনী স্নায়ুযুদ্ধের সময়েও নিজেদের সগর্ব উপস্থিতি জানান দেয় বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে মার্কিন সামরিক কৌশল কিংবা প্রযুক্তির উন্নয়ন দুরন্ত গতিতে এগিয়েছে, সামরিক দিক থেকে নিজেদের অনন্য করে তুলেছে তারা। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিনীদের সাথে সমানে সমানে পাল্লা দেয়ার মতো আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, আমেরিকা একক পরাশক্তি হিসেবে পৃথিবীবাসীর সামনে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে।
শুধু অপারেশন পরিচালনার জন্যই মার্কিন সামরিক বাহিনীতে অসংখ্য ইউনিট রয়েছে, যারা প্রযুক্তি ও দক্ষতার সম্মিলন ঘটিয়ে বিশ্বজুড়ে অসাধারণ সব অপারেশন পরিচালনা করে। তবে পুরো বাহিনী মিলিয়ে যতগুলো অপারেশনাল ইউনিট রয়েছে, সবগুলো ইউনিটের সক্ষমতা কিন্তু একরকম নয়। মার্কিন সামরিক বাহিনীতে যে ইউনিটগুলো সবচেয়ে দুধর্ষ হিসেবে খ্যাত, তাদেরকে ‘টায়ার-১’ (Tier-1) স্পেশাল মিশন ইউনিট হিসেবে শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। বিমান বাহিনী, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী মিলিয়ে মোট চারটি ইউনিটকে এই শ্রেণীতে ফেলা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনগুলোতে শতভাগ সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য এই ইউনিটগুলো বছরের পর বছর ধরে নিজেদের প্রমাণ করে এসেছে। অন্যান্য ইউনিটের তুলনায় এসব ইউনিটের পেছনে মার্কিন সরকার বাজেটে বেশি বরাদ্দ রাখে।
সিল টিম সিক্স (SEAL Team 6) মার্কিন সামরিক বাহিনীর টায়ার-১ এ থাকা একটি অপারেশনাল ইউনিট। পুরো পৃথিবীর যেকোনো জায়গায়, যেকোনো পরিবেশে শত্রুর বিপক্ষে দুঃসাহসিক সব অপারেশন পরিচালনা করার মতো সক্ষমতা রয়েছে এই অপারেশনাল ইউনিটের। সিল (SEAL) শব্দটির মাধ্যমে জলে, স্থলে ও আকাশে (SEa, Air and Land) অর্থাৎ সবদিক থেকেই সামরিক অপারেশন পরিচালনা করতে পারার সামর্থ্য থাকা কোনো সৈন্যকে বা পুরো ইউনিটকে বোঝায়। যদিও সামরিক দিক থেকে সিল অপারেশনাল ইউনিট মার্কিন নৌবাহিনীর অন্তর্গত, তারপরেও এই ইউনিটের সদস্যরা আকাশে কিংবা স্থলে তথা সবদিক থেকেই শত্রুপক্ষের উপর হামলা চালাতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ১৯৪৩ সালের নভেম্বরে তারাওয়া-র যুদ্ধে মার্কিন নৌবাহিনীর প্রায় ৩,০০০ সেনা মারা যায়। মার্কিন সরকার তখন থেকেই একটি কার্যকর ইউনিটের কথা ভাবতে থাকে, যেটি গোয়েন্দা কার্যক্রম চালিয়ে যেকোনো আক্রমণের আগে যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারবে। এতে যেকোনো সামরিক অপারেশনে ক্ষয়ক্ষতির হার কমে যাবে, মিশন সফল হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে। এই ধরনের চিন্তার বাস্তবায়ন হিসেবে মার্কিন নৌবাহিনীর একটি কার্যকর ইউনিট হিসেবে আন্ডারওয়াটার ডেমোলিশন টিম (UDT) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই টিমকেই মূলত সিল টিম সিক্সের পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১৯৫০ সালে দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেলে দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে মার্কিন সামরিক বাহিনী অংশ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্ডারওয়াটার ডেমোলিশন টিম মোটামুটি অকার্যকর হয়ে পড়লেও কোরিয়া যুদ্ধের সময় মার্কিন সামরিক বাহিনী তাদের উপরেই ভরসা রেখেছিল। কিন্তু কোরিয়া যুদ্ধের ফলাফল মার্কিনীদের হতাশ করে। এদিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধও দানা বেঁধে উঠতে শুরু করে। ১৯৬২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির নির্দেশে আন্ডারওয়াটার ডেমোলিশন টিমের সদস্যদের নিয়ে মার্কিন সামরিক বাহিনীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দুটি সিল (SEAL) টিম গঠন করা হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মোট আট প্লাটুন মার্কিন সিল (SEAL) সদস্যকে চক্রাকারে দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে নামানো হয়। উত্তর ভিয়েতনামের ভিয়েত কংদের গেরিলা সামরিক কৌশলের বিপক্ষে মার্কিন সামরিক বাহিনী সুবিধা করে উঠতে পারেনি। ১৯৬৫-৭২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন সিল সদস্য ভিয়েত কংদের হাতে প্রাণ হারায়। পুরো মার্কিন সামরিক বাহিনীর ধারাবাহিক ব্যর্থতার বিপরীতে এটি বিশেষ কোনো ব্যর্থতা ছিল না।
১৯৮০ সালের দিকে ইরানের তেহরানে যখন ৫২ জন মার্কিন নাগরিককে ইরানি ছাত্ররা জিম্মি করে, তখন মার্কিন সামরিক বাহিনী অপারেশন ইগল ক্ল (Operation Eagle Claw) পরিচালনা করে, যেটি পুরোপুরি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। স্নায়ুযুদ্ধের সেই সময়ে আমেরিকান সেনাবাহিনীর এই ব্যর্থতা পুরো বিশ্বে মার্কিন ভাবমূর্তি নষ্ট করতে জোরালো ভূমিকা পালন করে। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েই মার্কিন সরকার একটি দুধর্ষ ইউনিট গঠনের চিন্তা-ভাবনা শুরু করে, যেটি বৈশ্বিক যেকোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম বা সংকটের সময় মোকাবিলায় দ্রুত অপারেশন চালাতে সামর্থ্য রাখবে। মার্কিন নৌবাহিনীর সিল (SEAL) কমান্ডার রিচার্ড মার্সিনকোকে ছয় মাসের মধ্যে এরকম একটি ইউনিট গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়।
১৯৫৮ সালে মার্কিন নৌবাহিনীতে যোগ দেয়া রিচার্ড মাসিনকো ছিলেন একজন অভিজ্ঞ নৌ-কমান্ডার। ভিয়েতনাম যুদ্ধে সিল (SEAL) কমান্ডার হিসেবে দুর্দান্ত দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। তার বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ মার্কিন সরকার তাকে বেশ কিছু পদক দেয়। ১৯৮১ সালের প্রথমদিকে কমান্ডার রিচার্ড মার্সিনকোর হাত ধরে ৭৫ জন সদস্যকে নিয়ে সিল টিম সিক্স (SEAL Team Six) নামে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সবচেয়ে দুধর্ষ অপারেশনাল ইউনিট প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
‘সিল টিম সিক্স’ নাম দেয়ার পেছনেও মজার ইতিহাস রয়েছে। ১৯৮১ সালের দিকে যখন সিল টিম সিক্স আত্মপ্রকাশ করে, তখন আগে থেকেই মার্কিন নৌবাহিনীতে দুটি সিল (SEAL) টিম ছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সেই উত্তাল সময়ে মার্কিন সামরিক বাহিনীর গোপন ফাইল হাতে পাওয়ার জন্য সোভিয়েত ইন্টেলিজেন্স অফিসারেরা হন্য হয়ে খুঁজছিল। বলে রাখা ভালো, সিল টিম সিক্স গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় একদম গোপনে। মার্কিন সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও প্রশাসনের গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া কেউই এই ইউনিট সম্পর্কে জানতো না। সোভিয়েত ইন্টেলিজেন্স অফিসারদের দ্বিধায় ফেলে দিতেই কমান্ডার রিচার্ড মার্সিনকো এই ইউনিটের নাম দেন সিল টিম সিক্স, যাতে করে মার্কিন সামরিক বাহিনীতে বিদ্যমান অপারেশনাল সিল টিমের প্রকৃত সংখ্যা সোভিয়েতরা জানতে না পারে।