মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর বঙ্গভূমির প্রতি কবিতায় বলেছেন,
জন্মিলে মরিতে হবে,
অমর কে কোথা কবে,
চিরস্থির কবে নীর, হায় রে, জীবন-নদে?
মৃত্যুর মতো এত অমোঘ সত্য পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। মৃত্যু নিয়ে পৃথিবীর সবারই কম বেশি দুঃখ-কষ্ট বোধ হয়। প্রিয়জনের মৃত্যুতে তো বটেই, চরম শত্রুর বিদেহী আত্মাও মানুষকে ব্যথিত করে। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করেও সৈন্যরা কাঁদে, চরম প্রতিশোধপরায়ণ মানুষও কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির মৃত্যুর শোকে নীরব হয়ে যায়। দুঃখবিলাসী মানুষগুলোও প্রিয়জনের প্রস্থানে ভেঙে পড়েন। অর্থাৎ মানুষের যাপিত জীবনে, মৃত্যু চিরকালই এক অতি সংবেদনশীল অনুভূতির জন্মদাতা।
এতটা স্পর্শকাতর যে অভিজ্ঞতা সেটাকে যদি বলা হয় ব্যবসার উপজীব্য করতে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিক্রিয়াশীল মানব হৃদয় মেনে নিতে চাইবে না। তবে ধীরে ধীরে এই সৃজনশীল চিন্তার পালে হাওয়া লাগছে। যত দিন যাচ্ছে মানুষের মৃত্যুও ঘটে চলেছে বিরামহীন গতিতে। অর্থাৎ মানুষের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে ব্যবসার নতুন ক্ষেত্র। ফ্রান্সের একটি স্টার্ট আপ দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদের এই ব্যবসাকে।
৩২ বছর বয়সী ম্যাক্সিম নোরি। ফ্রান্সের লিয়নে একটি বিজনেস স্কুলে শিক্ষানবিস থাকাকালে নোরি, তার বন্ধুদেরকে নিয়ে একটি নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরুর চিন্তা করেন। দেশে চলমান বিভিন্ন খাত পর্যবেক্ষণপূর্বক তারা আপাতদৃষ্টিতে একটি অপ্রচলিত অথচ চমকপ্রদ আইডিয়া নিয়ে কাজ করা শুরু করেন: মৃত্যু। এই বিষয়ে নোরির বক্তব্য ছিল,
আমরা অনেক ভেবে দেখলাম যে এটি এমন একটি শিল্পখাত যেখানে কেউ বিনিয়োগ করার কথা ভাবেন না, নতুন কোনো ভাবনা প্রয়োগ করতেও ইচ্ছুক নন। যেহেতু এই খাতটি এখন পর্যন্ত সেই অর্থে উদ্যোক্তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি, আমাদের সুযোগ রয়েছে এখানে নতুনত্ব এনে দেওয়ার। সম্ভাবনার শুরু এখানেই।
নোরির চিন্তা অবশ্যই যৌক্তিক ছিল। কেননা ব্যবসার এই খাতটি ক্রমবর্ধমান। আর দশটা দেশের মতো ফ্রান্সের জনগণ প্রৌঢ়ত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং এই সংখ্যাটি ক্রমশই বেড়ে চলেছে। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অভ স্ট্যাটিস্টিক্স অ্যান্ড ইকোনমিক স্টাডিজের তথ্যানুসারে, ২০০০ সালে ফ্রান্সে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫,৩১,০০০। প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্যমতে, ২০৫০ সাল নাগাদ এই সংখ্যাটি পৌঁছবে ৭,৭০,০০০ বা ততোধিকে। ২০১৮ সালে একটি ফ্রেঞ্চ কন্সাল্টেন্সি গ্রুপের চালানো গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলানুসারে, ২০০৬ ও ২০১৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ে শেষকৃত্যানুষ্ঠান ব্যবসা খাত থেকে মোট রাজস্বের প্রবৃদ্ধি ছিল ২৫%! ২০১৮ সালে এই অভূতপূর্ব ব্যবসাখাতের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ২.৫ বিলিয়ন ইউরো।
আট বছর হতে চলল, নোরি একটি ফিউনারেল সার্ভিস স্টার্ট আপে, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। ২২ জন স্টাফ নিয়ে কাজ করে যাওয়া এই কোম্পানিটির নাম সিমপ্লিফিয়া। শেষকৃত্যানুষ্ঠানের সাথে জড়িত বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে সফটওয়্যার সরবরাহ করাই তাদের কাজ। এর মাধ্যমে তাদের মূল কাজ হচ্ছে মৃত ব্যক্তির অন্ত্যেষ্টক্রিয়া সম্পন্ন করা। এছাড়াও পরবর্তীতে মৃত ব্যক্তির শোকসন্তপ্ত পরিবারের পক্ষ থেকে তার পেনশনের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা কিংবা অন্যান্য আর্থিক লেনদেনের যথাথথ সুরাহা করে দেওয়াও তাদের সেবাসমূহের অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে ৭০০ এরও অধিক ফিউনারেল বিজনেস সার্ভিসের সাথে সিমপ্লিফিয়া চুক্তিবদ্ধ।
ম্যাক্সিম নোরিকে জানা হলো, জানা হলো তার চমৎকার স্টার্ট আপ সিমপ্লিফিয়ার কথাও। পাঠক, এবার চলুন জেনে নেওয়া যাক অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের কথা। বলা বাহুল্য, এটিও একটি স্টার্ট আপ: অ্যাডভিটাম। প্রচলিত ফিউনারেল সার্ভিস প্রোভাইডারদের মতো অ্যাডভিটামের কোনো শরীরী অস্তিত্ব নেই, অর্থাৎ ইট-পাথরের কোনো দোকান বা প্রতিষ্ঠান তারা নয়। এটি একটি অনলাইন প্রতিষ্ঠান, যেটি মৃতের পরিবারের হয়ে মরণোত্তর কাজগুলো করে থাকে। পূর্বের প্রচলিত ফিউনারেল প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব ছিল পুরোটাই অফলাইন। অর্থাৎ কারও পরিচিত বা আত্মীয়স্বজন মারা গেলে পরিবারের কাউকে সেই অব্যাখ্যনীয় কষ্ট নিয়েই তাদের অফিসে যেতে হত, কফিন ও আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্রের দরদাম করতে হত এবং কাঁধে অপরিসীম দায়িত্ব নিয়ে পুরো শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হত। এতে যেমন একদিকে সময় নষ্ট হত প্রচুর তেমনি অন্যদিকে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের অবস্থার সুযোগ নিয়ে প্রতিটি পণ্যের বেজায় দাম হাঁকাত। ঠিক এই জায়গাটাতেই অ্যাডভিটামের সূক্ষ্ম অনুপ্রবেশ।
অ্যাডভিটামের সাথে ফোন বা ইমেইলের মাধ্যমে একজন গ্রাহক যোগাযোগ করবেন। অ্যাডভিটামই তার হয়ে কফিন কেনা, একজন ফিউনারেল কাউন্সিলরের ব্যবস্থা করা এবং মৃতের শোকে মুহ্যমান পরিবারের হয়ে মৃত্যু পরবর্তী সমুদয় কার্যাদি যথোপযুক্ত উপায়ে সম্পন্ন করবে। পুরো কাজ সুষ্ঠুভাবে তদারক করার জন্য অ্যাডভিটামের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকবেন একজন প্রতিনিধিত্বকারী। এখানেই শেষ নয়, মৃত ব্যক্তির যাবতীয় প্রশাসনিক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিবন্ধনকৃত অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও অ্যাডভিটাম গ্রহণ করে থাকে।
ফিলিপ মেরাল্বে, বয়স ৩৮ বছর। তার পরিচয় হচ্ছে তিনি এই অ্যাডভিটামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ঠিক কোন বিষয়টি বা ঘটনাটি তাকে এমন চমকপ্রদ স্টার্ট আপ গড়ে তুলতে উৎসাহ যুগিয়েছিল? প্রথাগত শেষকৃত্যানুষ্ঠানকে তিনি বর্ণনা করেন মৃত ব্যক্তির পরিবারের জন্য অমানবিক ও পীড়াদায়ক বলে। খুব প্রিয়জন হারানোর বেদনায় মানুষ স্বাভাবিকভাবেই বেশ ভেঙে পড়েন। তখন যে কারও জন্যই মৃত্যু পরবর্তী কার্যাদি সম্পন্ন করাটা পাহাড়সম চাপ। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নিজেকে ও নিজের পরিবারকে সামলে এসব দায়িত্ব সামলানো যথেষ্ট হৃদয়বিদারক। নিজ বাবার শ্রাদ্ধ করার যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন তাকে হতে হয়েছিল, সেটিই তাকে এই কাজটিতে আসার প্রেরণা দান করে।
এছাড়াও আরও কিছু চমকপ্রদ আইডিয়া নিয়ে অন্যান্য স্টার্ট আপগুলো কাজ করছে। যেমন: পরলোকগত ব্যক্তির গায়ের গন্ধের উপর ভিত্তি করে সুগন্ধি প্রস্তুত করা, মৃত ব্যক্তির সমাধিফলকে কিউআর (QR Code) স্থাপন করা যেটি স্ক্যান করলেই নিয়ে যাওয়া হবে ব্যক্তির সব ছবি ও পছন্দের গানগুলোর সংকলনে। ফেসবুকে নিজের উত্তরাধিকার ঘোষণা করে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া সেটিও করে দিচ্ছে কেউ কেউ।
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে ফ্রান্সের সাধারণ জনগণ কতটা সাধুবাদ জানাচ্ছে এই উদ্যোগকে। এতগুলো স্টার্ট আপের প্রতিটিই কি সফলতার মুখ দেখছে? দারুণ সফলতার পাশাপাশি মুখ থুবড়ে পড়ারও নজির রয়েছে। একটি কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি- তরুণদের শরীরে প্রবাহিত হয় উষ্ণ রক্ত। নতুন কিছু করার উন্মাদনা তাদেরকে এতটাই পেয়ে বসে যে তারা তাদের সময়টাকে সবসময় ঠিকঠাক ধরতে পারে না। আজকের তরুণ পৃথিবীকে দেখে তার নিজস্ব চোখ দিয়ে। কিন্তু এ কথা সে ভুলে যায় যে, পৃথিবীটা তার নিজস্ব চিন্তাধারার সাথে কতটা তাল মিলিয়ে চলছে? মৃত্যুকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বেশ কিছু স্টার্ট আপ অচিরেই ধ্বংস হয়ে গেছে অতিমাত্রায় সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনার কারণে। ব্যবসার এই খাতটি যতই লাভজনক হোক না কেন এই কথা অনস্বীকার্য যে পুরো বিষয়টির প্রতি আমরা এখনও অতিমাত্রায় অনুভূতিশীল। মৃত্যুকে ঘিরে যেকোনো কিছুই আমরা প্রথমেই চট করে সহজভাবে গ্রহণ করার মতো অবস্থায় সবসময় থাকি না। নিজের সময়টাকে, চলমান পৃথিবীর গতি বা ট্রেন্ডটাকে ধরতে না পারা এবং অতি সুদূরপ্রসারী চিন্তা ভাবনাও কখনও কখনও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার কারণ হতে পারে।
৬২ বছর বয়সী প্রবীণ রিচার্ড ফেরেট, সিপিএফএম ফ্রেঞ্চ ফিউনারেল ইন্ডাস্ট্রি বডির সভাপতি। তার অভিজ্ঞতায় তিনি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া হয়ে যেতে দেখেছেন অতি আগ্রাসী মনোভাবের দরুন। তার অভিজ্ঞতার আলোকে, শিল্পের এই খাতটিতে ডিজিটাইজেশন আসছে এবং আসবেও, তবে গতি হবে ধী,র কারণ এর গ্রাহকরা এখনও অনেক ক্ষেত্রেই রক্ষণশীল।
তবে নোরি, ফিলিপের মতো ব্যবসায়ীরা যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। এরই মধ্যে ফিলিপের প্রতিষ্ঠানটি রিসাইকেলড কার্ডবোর্ড কফিন নিয়ে এসেছে পরিবেশবান্ধব শেষকৃত্যানুষ্ঠান প্রজেক্টের অংশ হিসেবে। পাশাপাশি নোরিও শোনাচ্ছেন আশার বাণী,
শুরুতেই সবাই আমাদের বলেছিল শিশুসুলভ এই আচরণ দিয়ে ব্যবসা হবে না। কয়দিন বাদেই তারা তাদের বাজার হারাবে। এই কথা আমি স্বীকার করতে বাধ্য যে আমি শুরুর দিকে অতি উচ্চাভিলাষী ছিলাম এবং বেশ কিছু আইডিয়া ছিল যেগুলো সময় ও বাস্তবতার চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে। তবে আমরা ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছি আর এটিই আমাদের গ্রাহকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা অর্জনের পাথেয়।
বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
স্টার্ট আপ সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইটিঃ