চলমান রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে ইউক্রেনীয়রা রাশিয়ার অভ্যন্তরে এমন বেশ কয়েকটি আক্রমণ পরিচালনা করেছে, যেগুলো বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি ক্রিমিয়ান সেতুর ওপর পরিচালিত আক্রমণ ছিল এরকমই একটি আক্রমণ।
‘ক্রিমিয়ান সেতু’ রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড ও ক্রিমিয়ান উপদ্বীপের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী একটি বৃহৎ সেতু। ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া অধিকার করে নেয়, কিন্তু সেসময় রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড ও ক্রিমিয়ান উপদ্বীপের মধ্যে কোনো স্থল সংযোগ ছিল না। এমতাবস্থায় রুশ সরকার কের্চ প্রণালীর ওপর দিয়ে ক্রিমিয়ার কের্চ উপদ্বীপ এবং রাশিয়ার ক্রাসনোদার সীমান্ত প্রদেশের তামান উপদ্বীপের মধ্যে একটি সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে রুশ মূল ভূখণ্ড ও ক্রিমিয়ার মধ্যে স্থল সংযোগ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬-১৯ সালের মধ্যে ৩৭০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘ক্রিমিয়ান সেতু’ স্থাপিত হয়।
ক্রিমিয়ান সেতু রাশিয়া কর্তৃক নির্মিত সবচেয়ে বড় সেতু এবং ইউরোপের দীর্ঘতম সেতু। ক্রিমিয়ার রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্তি রুশ জনসাধারণের নিকট অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল এবং রুশ সরকার অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে সেতুটি উদ্বোধন করেছিল। এজন্য ক্রিমিয়ান সেতুকে কার্যত ক্রিমিয়ার ওপর রুশ নিয়ন্ত্রণের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তদুপরি, এই সেতুর মাধ্যমে রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে ক্রিমিয়ায় জ্বালানি ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম প্রেরণ সহজতর হয়ে ওঠে। সেজন্য সেতুটি কৌশলগত ও সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ইউক্রেনীয় সরকারি কর্মকর্তারা বার বার হুমকি দিয়ে আসছিল যে, তারা ক্রিমিয়ান সেতুর ওপর আক্রমণ চালাবে। ২০২২ সালের ৮ অক্টোবর হুমকিটি বাস্তবে রূপ নেয়। রুশ ‘জাতীয় সন্ত্রাসবাদবিরোধী কমিটি’র ভাষ্য অনুসারে, সেদিন সকাল ৬টায় ক্রাসনোদার থেকে আগত একটি ট্রাক ক্রিমিয়ান সেতুর ওপরে বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের ফলে ট্রাকের চালক ও কাছাকাছি থাকা দুই বেসামরিক মানুষ (একজন পুরুষ ও একজন নারী) নিহত হন, সেতুটির সড়কপথের অংশবিশেষ সমুদ্রে ধসে পড়ে, এবং সেতুর রেলপথে থাকা সাতটি ফুয়েল ট্যাঙ্কে আগুন ধরে যায়। এর ফলে সেতুর ওপর যান চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়, এবং রুশদের ৩২-৮০ লক্ষ মার্কিন ডলার সমমূল্যের ক্ষয়ক্ষতি হয়।
আক্রমণটির সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউক্রেনীয় সরকারি কর্মকর্তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উল্লাস প্রকাশ করতে থাকেন এবং ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কির কার্যালয় প্রধানের উপদেষ্টা মিহাইলো পোদোলিয়াক তার অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে ইঙ্গিত করেন যে, ইউক্রেনীয়রা এই আক্রমণ পরিচালনা করেছে। ইউক্রেনীয় অনলাইন পত্রিকা ‘উক্রাইনস্কা প্রাভদা’ এবং মার্কিন পত্রিকা ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’–এর ভাষ্য অনুসারে, ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘এসবিইউ’ উক্ত আক্রমণ পরিচালনা করেছে। অবশ্য একই দিনে পোদোলিয়াক তার অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে দাবি করেন, রুশরা নিজেরাই ক্রিমিয়ান সেতুর ওপর আক্রমণ চালিয়েছে।
রুশ প্রচারমাধ্যমের ভাষ্যমতে, যে ট্রাকের বিস্ফোরণের ফলে ক্রিমিয়ান সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটির মালিক ২৬ বছর বয়সী সামির ইউসুবভ। রুশ টেলিগ্রাম চ্যানেল ‘বাজা’য় প্রকাশিত একটি ভিডিওতে তিনি দাবি করেছেন, ক্রিমিয়ান সেতুর ওপরে সংঘটিত বিস্ফোরণের সঙ্গে তার কোনো সংশ্রব নেই, এবং কার্যত এখন তিনি রাশিয়াতেই নেই। তার আত্মীয়স্বজনের ভাষ্যমতে, ট্রাকটি চালাতেন সামিরের চাচা মাহির ইউসুবভ। তাদের ভাষ্যমতে, তিনি অনলাইন থেকে তার ট্রাকে করে সার পরিবহনের কাজ পেয়েছিলেন। সুতরাং এক্ষেত্রে দুটো সম্ভাবনা রয়েছে– হয় মাহির ইউক্রেনীয় গোয়েন্দাদের হয়ে কাজ করছিলেন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ক্রিমিয়ান সেতুর ওপর আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছেন, নয়তো ইউক্রেনীয় গোয়েন্দারা মাহিরের অজান্তেই তার ট্রাকে বিস্ফোরক রেখে দিয়েছিল এবং তিনি ক্রিমিয়ান সেতুর ওপর পৌঁছানোর পর তারা বিস্ফোরণ ঘটায়। অবশ্য রুশ তদন্তকারীরা এখনও এই বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি।
ক্রিমিয়ান সেতুর ওপর পরিচালিত আক্রমণের ফলে পশ্চিমা বিশ্ব অত্যন্ত উল্লসিত হয় এবং রুশরা মারাত্মকভাবে ক্ষিপ্ত হয়। একজন রুশ আইনপ্রণেতা এই আক্রমণের জন্য মার্কিন ও ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করেন, এবং রুশ জাতীয়তাবাদীরা উক্ত আক্রমণের প্রতিবাদে রাশিয়ার মস্কোয় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করে। অবশ্য আক্রমণের ফলে ক্রিমিয়ান সেতুর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি ছিল না। রুশরা ৮ অক্টোবরের মধ্যেই সেতুটির ক্ষতিগ্রস্ত অংশের সিংহভাগ মেরামত করে ফেলে, এবং ইতোমধ্যেই সেতুটি দিয়ে পুনরায় যান চলাচল শুরু হয়েছে।