দক্ষিণ চীন সাগরের পার্ল রিভার ডেল্টার কাছে অবস্থিত এশিয়া মহাদেশের সর্বশেষ ইউরোপীয় উপনিবেশ ম্যাকাও, যা প্রায় ৪৪২ বছর ধরে পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। ১৫১৩ সালে পর্তুগিজ অভিযাত্রী জর্জ আলভরিস সর্বপ্রথম এই ক্ষুদ্র দ্বীপে পৌঁছেন। ১৫৫৩ সালে সেখানে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের অস্থায়ী ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়। পর্তুগাল ১৫৫৭ সালে উপদ্বীপটি চীনের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে সেখানে এশিয়ার প্রথম ইউরোপীয় বাণিজ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে এবং ১৮৮৮ সালে ম্যাকাও এর ওপর সার্বভৌম ক্ষমতার চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়।
১৯৫১ সাল থেকে ম্যাকাও পর্তুগাল এর একটি প্রদেশ হিসেবে বিবেচিত হত। এরপর ১৯৮৭ সালের ১৩ এপ্রিল চীন এবং পর্তুগাল একটি যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করে এবং সেই ঘোষণার রূপরেখা অনুযায়ী “এক দেশ, দুই নীতি” বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ম্যাকাও ১৯৯৯ সালের ২০ ডিসেম্বর চীনের অধীনস্থ হয়।
চীনের অধীনে ম্যাকাও হস্তান্তরের প্রায় দুই বছর পূর্বে প্রায় ১৫৬ বছরের ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই হংকং চীনা শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। চীনের শাসনাধীনে হংকং এবং ম্যাকাও চীনের দুটো বিশেষ প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে। হংকং এবং ম্যাকাওয়ের নেতা হিসেবে একজন প্রধান নির্বাহী দায়িত্ব পালন করেন এবং দুটো এলাকা কিছুটা স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে থাকে। চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে এই দুটো এলাকায় “এক দেশ, দুই নীতি” বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সীমিত পরিসরে গণতন্ত্র এবং পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
১৯৯৭ সালে চীনা শাসন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন দাবিতে হংকংয়ে চীন সরকারের কর্তৃত্ববাদী আচরণের প্রতিবাদে ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০০৩ সালে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্কার বিলের প্রতিবাদে পুরো হংকং বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। ২০১২ সালে চীনা কর্তৃপক্ষ হংকংয়ের বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি পরিবর্তন করে সেখানে চীনা ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালালে তীব্র প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়। হংকংয়ের নির্বাচনে গণতন্ত্রপন্থী নেতাদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার দাবিতে ২০১৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আন্দোলনকারীরা ছাতা হাতে প্রতিবাদ করতে রাজপথে নেমে আসে। এরপর অপরাধী প্রত্যর্পণ বিল বাতিলের দাবিতে ২০১৯ সালের ১২ জুন থেকে হংকংয়ে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে এই বিতর্কিত বিলটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। বর্তমানে নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইনের প্রতিবাদে হংকং আবারও বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, হংকং থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত চীনের আরেক বিশেষ প্রশাসনিক এলাকা ম্যাকাওয়ের বেশিরভাগ জনগণের মধ্যে এখনও চীনা কর্তৃপক্ষ প্রণীত বিভিন্ন নীতির প্রতি সমর্থন অব্যাহত রয়েছে। তাই ম্যাকাওয়ে চীনা শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে না বললেই চলে। গত বছরের ১ অক্টোবর পালিত হওয়া চীনের বিপ্লবের সত্তর বছর অনেকটা আড়ম্বরপূর্ণভাবে ম্যাকাওয়ে উদযাপিত হয়। অন্যদিকে, এই দিনে হংকংয়ে গণতন্ত্র এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবিতে মানুষ প্রতিবাদে সামিল হয়। ম্যাকাওয়ে বিতর্কিত নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন এবং চীনা জাতীয় সঙ্গীত অবমাননা আইন অনেকটা বাধাহীনভাবে পাস হয়। কিন্তু এই দুটো বিতর্কিত আইন উপস্থাপনের প্রতিবাদে কয়েক লক্ষ লোক হংকংয়ের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে এবং আন্দোলনকারীরা পুলিশের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
সম্প্রতি চীনপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী ক্যারি লামের পদত্যাগের দাবিতে সেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। অন্যদিকে চীনের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পরিষদ জাতীয় গণ কংগ্রেসের স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য এবং ম্যাকাওয়ের বর্তমান প্রধান নির্বাহী হো লাট সেং জনগণকে সাথে নিয়ে চীন সরকারের সাথে যৌথভাবে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছেন। চীনের সাথে অন্তর্ভুক্তির ২০ বছর পূর্তিতে ২০১৭ সালের ১ জুলাই পুরো হংকং জুড়ে ব্যাপক চীনবিরোধী বিক্ষোভ হলেও, ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর ম্যাকাওয়ে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে চীনের সাথে অন্তর্ভুক্তির ২০ বছর পূর্তি পালন করা হয়। এছাড়াও ১৯৮৯ সালে বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনে মৃত্যুবরণকারী ছাত্রদের স্মরণে প্রতি বছর ৪ জুন হংকংয়ে অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়, যা চীনের অন্য কোথাও অনুষ্ঠিত হয় না।
ম্যাকাওয়ের জনগণের চীনপন্থী মনোভাবের জন্য পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শাসনকে অনেকটা দায়ী করা হয়। মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে সংগঠিত চীনা সাংস্কৃতিক বিপ্লব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ম্যাকাওয়ের জনগণ পর্তুগালের অপশাসন, দুর্নীতি এবং বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালের ৩ ডিসেম্বর রাজপথে নেমে আসে এবং সেই ঘটনায় পুলিশের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনায় পুলিশের নির্মমতায় ৮ জন বিক্ষোভকারী নিহত এবং প্রায় দুই শতাধিক বিক্ষোভকারী আহত হন। পরে অবশ্য এই ঘটনায় কর্তৃপক্ষ নতি স্বীকার করে পুলিশের শক্তি প্রয়োগের জন্য ম্যাকাওয়ের জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, কিন্তু এই ঘটনার পর পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শক্তি কার্যত ম্যাকাওয়ের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
অন্যদিকে ১৯৬৭ সালের মে মাসে চীনপন্থী বিক্ষোভকারীদের সাথে তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশ হংকংয়ের পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। মূলত শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা থেকে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এই বিক্ষোভে চীনের ক্ষমতাসীন দল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পরোক্ষ সমর্থন ছিল। সেই সময় সহিংসতায় ১০ জন পুলিশ সদস্যসহ মোট ৫১ জন নিহত এবং আট শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। পুলিশ প্রায় দুই হাজার বিক্ষোভকারীকে আটক করে।
বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চীনপন্থী বিক্ষোভকারীদের এই আন্দোলন হংকং কর্তৃপক্ষ ধীরে ধীরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। ফলে চীনপন্থীদের এই আন্দোলন কার্যত সুফল বয়ে আনতে পারেনি। এরপর থেকে হংকংয়ে চীনপন্থীদের কার্যক্রম হ্রাস পেতে শুরু করে এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে হংকংয়ের মানুষ পুঁজিবাদে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, ফলে তাদের মানসিকতার অনেকটা পরিবর্তন ঘটেছে। এরপর ব্রিটিশ শাসনের পতনের পর চীনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরও হংকংয়ের জনগণ চীনের “বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সমাজতন্ত্র”-এর প্রতি খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করেনি।
বর্তমানে ম্যাকাওয়ের জনগণের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশের জন্ম হয়েছিল চীনের মূল ভূখণ্ডে; অন্যদিকে হংকংয়ের ক্ষেত্রে এর হার মাত্র বিশ শতাংশ। ম্যাকাওয়ের প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষ মান্দারিন চীনা ভাষাভাষী হলেও বর্তমানে হংকংয়ের প্রায় সকল সরকারি কার্যক্রমে ইংরেজি ভাষার বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় এবং সেখানকার জনগণের মধ্যে ইংরেজি ভাষা তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। হংকংয়ের প্রায় সত্তর শতাংশ মানুষ ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে থাকে।
হংকংয়ের অধিকাংশ বাসিন্দা নিজেদের চীনা হিসেবে পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত বোধ করলেও ম্যাকাওয়ের অধিবাসীরা চীনা পরিচয়ে এখনও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বিশ্বে ক্যাসিনোর রাজধানী হিসেবে পরিচিত ম্যাকাওয়ের অর্থনৈতিক অবস্থা হংকংয়ের চেয়ে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাথাপিছু জিডিপির বিবেচনায় ম্যাকাওয়ের অবস্থান বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি দেশ অথবা অঞ্চলের মধ্যে একটি। পর্তুগিজ শাসনাধীন থাকা অবস্থায় ভেঙে পড়া সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য এর সুষ্ঠু পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার করার জন্য ম্যাকাওয়ের জনগণের কাছে চীনা কর্তৃপক্ষের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
অধিকতর গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় হংকংয়ের জনগণের আকাঙ্ক্ষা ম্যাকাওয়ের তরুণ প্রজন্মের বাসিন্দাদের কিছুটা হলেও প্রভাবিত করছে। তবে ম্যাকাওয়ের সাথে চীনের মূল ভূখণ্ডের একধরনের আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে এবং সেখানকার অধিকাংশ অধিবাসীর মধ্যে এখনও চীনা সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থা রয়েছে। তাই ভবিষ্যতে ম্যকাওয়ের জনগণের অভিমত ও মানসিকতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করা সম্ভব না হলেও, ম্যাকাওয়ে ঠিক এই মুহূর্তে হংকংয়ের মতো গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই বলেই অনুমান করা যায়।