নোবেল পুরস্কার জিতলে আপনি পাবেন ১০ ট্রিলিয়ন ডলার! পুরস্কারের অঙ্ক শুনে চোখ কপালে উঠে যেতে পারে। অবশ্য আপনার মাথা ঠাণ্ডা হবে যখন জানবেন, নোবেল পুরস্কার মানে ইগ নোবেল, আর পুরস্কার দেওয়া হবে জিম্বাবুয়ের ডলারে! যদি জানা থাকে জিম্বাবুয়ের ডলারের মুদ্রামান, তবে আপনার ইগ নোবেল কমিটির রসিকতায় হাসি পাবেই। এ মাসে ঘোষণা করা হয়েছে সত্যিকার নোবেল পুরস্কার ২০২০। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার আগের মাসে ঘোষণা করা হয় ইগ নোবেল। নোবেলের বিপরীতমুখী পুরস্কার এটি। একে নোবেল পুরস্কারের প্যারোডি বলা যায়। এই পুরস্কার পাওয়ার শর্ত হলো এমন কোনো আবিষ্কার বা গবেষণা করতে হবে, যেটি প্রথমে মানুষকে হাসাবে, পরে ভাবাবে। উদ্ভট আর হাসির কোনো আবিষ্কার বা গবেষণা করলে আপনার কপালেও জুটে যেতে পারে ইগ নোবেল এবং দশ ট্রিলিয়ন ডলার!
এবারের ইগ নোবেলের থিম ছিল পোকা। পোকা নিয়ে গবেষণা করে ইগ নোবেল জিতেছেন একজন বিজ্ঞানী। তিনি দাবি করেন, মাকড়সা কোনো পোকা নয়। যে পোকাবিদরা মাকড়সা ভয় পান তাদেরকে সাহস দিতেই এই তথ্য তিনি আবিষ্কার করেন। পোকাদের ছয়টা পা থাকে। মাকড়সার আটটা। বিজ্ঞানী দাবি করেন, বাড়তি দুটো পা অনেক পার্থক্য গড়ে দেয়। তিনি মানুষের দুই পায়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন কি না কে জানেন!
অ্যানালস অব ইমপ্রোবাবল রিসার্চ নামের এক পত্রিকা ইগ নোবেল পুরস্কারের আয়োজক। ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিবছর বেশ ঘটা করে এই পুরস্কার বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এ বছর এটি অনলাইনে ঘোষণা করা হয়েছে। এবারের ইগ নোবেল কোন কোন উদ্ভট আবিষ্কারের জন্য দেওয়া হলো দেখে নেওয়া যাক।
ধ্বনিবিজ্ঞান
হিলিয়াম মেশানো বায়ু শ্বাসের সঙ্গে নিলে গলার স্বর চিকন হয়ে যায়। স্বাভাবিক গলার আওয়াজ থেকে হঠাৎ এমন চিকন আর ফ্যাসফ্যাসে শব্দ বের হলে হাস্যকর শোনায়। এই হিলিয়াম কুমিরের গলার আওয়াজে কেমন প্রভাব ফেলে সেটি পরীক্ষা করে দেখেছেন জাপানের কয়েকজন বিজ্ঞানী। তারা একটা কুমিরকে হিলিয়াম মেশানো বায়ুর মধ্যে রেখেছিলেন। হিলিয়াম শ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে কুমিরের স্বর তীক্ষ্ণ হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে কুমির অন্য কুমিরের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য যখন ডাকাডাকি করেছে, তখন মনে হয়েছে কুমিরটি ব্যঙ্গ করে ডাকছে! হিলিয়াম গ্যাসের প্রভাবে কুমিরের ডাক চিকন এবং মজার হয়ে গেছে! কুমিরটি যেন গলার ভেতর থেকে ডাকছে। জাপানের গবেষকরা এটি করেছিলেন মানুষের আওয়াজের সঙ্গে কুমিরের মিল আছে কি না দেখতে, আর এটিই তাদেরকে এনে দিয়েছে ইগ নোবেল।
মনোবিজ্ঞান
কিছু মানুষ আছে ভীষণ আত্মপ্রেমী। নিজের সব কিছুই যাদের ভালো লাগে। এরা সবসময় নিজের প্রতি মুগ্ধ থাকে। এদের চেনার উপায় কী? ভ্রু দেখে এদেরকে চেনা সম্ভব? মিরান্ডা জ্যাকোমিন ও নিকোলাস রুল নামে দুজন বিজ্ঞানী এই চেষ্টাই করেছেন। মানুষের ভ্রুর আকার, ঘনত্ব নিয়ে গবেষণা করেছেন। এ থেকে নতুন একটা পদ্ধতি বের করেছেন। যে পদ্ধতি আত্মপ্রেমী মানুষকে চিনতে সাহায্য করবে। প্রথমে তারা ভ্রুর ঘনত্ব আর আকার দিয়ে আত্মপ্রেমী কি না বুঝতে চেয়েছেন । পরে তারা একজনের ভ্রু আরেকজনের ছবিতে লাগিয়েও দেখেছেন। এমন আজব কাজের জন্য তো ইগ নোবেল পাবেনই।
শান্তি
ছোটবেলায় কারো বাসার কলিংবেল টিপে পালিয়ে যাওয়া একরম আনন্দ ছিল। দরজা খুলে সেই বাসার মানুষ দেখবে কেউ নেই। হাওয়া হয়ে গেছে। এমন মজা কিন্তু বড়রাও করে। ভারত আর পাকিস্তানে নিযুক্ত কূটনীতিবিদদের এমন মজার শিকার হতে হয়েছে। তারা দাবি করেছেন, গভীর রাতে তাদের বাসার কলিং বেল বেজে উঠতো। দরজা খুলে দেখতেন কেউ নেই! তারা অন্যান্য মজার শিকারও হয়েছেন। যেমন- কেউ একদিন তাদের বিদ্যুতের লাইন তো আরেকদিন গ্যাসের লাইন কেটে দিয়েছে। একে অপরের বিরুদ্ধে দুই দেশই এমন অভিযোগ করেছে। তাই তাদের দেশের সরকারকে শান্তিতে ইগ নোবেল দেওয়া হয়েছে।
পদার্থবিদ্যা
কেঁচোর নাচানাচি নিয়ে গবেষণা করেছেন মেলবোর্নের সুইনবার্ন ইউনিভার্সিটির দুই গবেষক। ইভান মাকসিমভ ও আন্দ্রেই পটটস্কি উচ্চমাত্রার শব্দ তরঙ্গের মধ্যে কেঁচো ছেড়ে দিয়েছেন। উচ্চমাত্রার শব্দ তরঙ্গ পানিতে যে ঢেউ তোলে, কেঁচোকে অমন শব্দের মধ্যে রাখলে একইরকম ঢেউ পাওয়া যায়! কেঁচো শব্দের তালে তালে নাচে মনে হয়। ইগ নোবেল পাওয়ার মতোই একটা কাজ করেছেন তারা।
অর্থনীতি
জাতীয় আয় হলো কোনো দেশে এক বছরে উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবার মূল্যমান। যে দেশে বেশি দ্রব্য আর সেবা তৈরি হয়েছে সেই দেশের জাতীয় আয় বেশি। তাই বিভিন্ন দেশে জাতীয় আয়ের পার্থক্য রয়েছে। কোনো দেশের জাতীয় আয় বেশি কোনো দেশের কম। জাতীয় আয়ের এই কম-বেশি হওয়ার সঙ্গে চুমুর সম্পর্ক আছে কি না, সেটি নিয়ে গবেষণা করেন একদল গবেষক। এতেই তারা জিতে নিয়েছেন ইগ নোবেল!
ব্যবস্থাপনা
কয়েকমাস আগে চীনের একদল ভাড়াটে খুনীর গল্প ছড়িয়ে পড়ে। পাঁচজন ভাড়াটে খুনী পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। তারা কেউ খুনটা করেননি। শুধু একজন আরেকজনকে কাজ করে দেওয়ার জন্য ভাড়া করেছেন। এতেই তারা ব্যবস্থাপনায় ইগ নোবেল জিতেছেন।
একজন লোক খুন করার জন্য একজন ভাড়াটে খুনিকে অর্থ দিয়েছিল। সেই খুনি নিজে খুনটা করতে চায়নি। একইসাথে সে কম খরচে কাজটি করার জন্য আরেকজনকে ভাড়া করেছে। যাকে ভাড়া করেছে, সে-ও নিজে কাজ করতে চায়নি। কম খরচে আরেকজনকে দিয়ে কাজ করাবে ভেবে ভাড়া করেছে আরেকজনকে। এভাবে পাঁচজন নিজে কিছু অর্থ হাতে রেখে অন্য আরেকজনকে দায়িত্ব দিয়েছে খুন করার জন্য। শেষপর্যন্ত সবাই পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে।
কীটবিজ্ঞান
যারা কীট নিয়ে গবেষণা করেন তাদেরকে বলে কীটতত্ত্ববিদ। কীটতত্ত্ববিদদের অভয় দিয়েছেন এক বিজ্ঞানী। যেসব কীটতত্ত্ববিদ মাকড়শা ভয় পান, তাদেরকে অভয় দিতে বিজ্ঞানী রিচার্ড ভেটার বের করেছেন, মাকড়সা কোনো কীট নয়। মাকড়সার পায়ের সংখ্যা থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। কীটের ছয়টি পা থাকে। মাকড়সার আটটি। এখন থেকে কীটপতঙ্গ নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানীরা যেন মাকড়শাকে ভয় না পান!
চিকিৎসাবিজ্ঞান
অনেকে খাবার শব্দ করে চিবিয়ে খায়। খাবার চিবোনোর শব্দে কারো কারো গা শিরশির করতে পারে। অনেকের এমন শব্দে খুব অস্বস্তি হয়। এই সমস্যাকে বলে মিসোফোনিয়া। অনেকে বলেন এটি একরকম মানসিক সমস্যা। কিছু বিজ্ঞানী একে স্বীকৃতি দিতে চান না। কারো মধ্যে এ সমস্যা আছে কি না, সেটি গবেষণা করেছেন তিন গবেষক। এতেই কপালে জুটেছে ইগ নোবেল।
চিকিৎসাশিক্ষা
কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন নিয়ে খুব হইচই হয়। খবর বের হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল দেওয়ার জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এবারে ট্রাম্প নোবেলটা পেয়েই গেলেন। তবে ইগ নোবেল। দলবল নিয়ে ইগ নোবেল পেয়েছেন তিনি। তার সঙ্গে আছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জায়ার বলসোনারো, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস লোপেজ অব্রাদর, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার লুকাশেঙ্কো, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও তুর্কমেনিস্তানের প্রেসিডেন্ট গুরবাঙ্গুলি বারদিমুহামেদো।
তারা সকলেই রাজনীতিবিদ। তারা বিশ্ববাসীকে বোঝাতে পেরেছেন, করোনা মহামারিতে মানুষের জীবন ও মৃত্যুর উপরে রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের চেয়ে অনেক বেশি। সাধারণ মানুষের কপালে এটি লেখা ছিল। আর তাদের কপালে জুটেছে ইগ নোবেল।
বস্তুবিজ্ঞান
একদল বিজ্ঞানী মানুষের জমাট মল দিয়ে ছুরি তৈরি করেছেন। সেটা কতটা ধারালো, ছুরি কাজ করে কি না সেটি পরীক্ষা করে দেখেছেন। এমন ছুরি পরীক্ষা করে তারা আবিষ্কার করেছেন, জমাট মলের ছুরি তেমন কাজ করে না! তারা সারা দুনিয়ার মানুষকে কষ্টের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। ভালো ছুরি বানানোর জন্য আর কাউকে কোনোদিন মল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে না!