কিছুদিন আগে তাইওয়ানের রাষ্ট্রপতি সাই ইং-ওয়েন ১০ দিনের মধ্য আমেরিকা সফরের যাত্রাবিরতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান, বৈঠকে মিলিত হন কংগ্রেস নেতাসহ হাউস স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থির সঙ্গে। চীন আগে থেকেই হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে- সাই ইং-ওয়েন যদি স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থির সঙ্গে বৈঠক করেন, তবে এর প্রতিশোধ হবে কঠোরতম। এদিকে গণতান্ত্রিকভাবে শাসিত তাইওয়ানকে চীন দেখে তার নিজ ভূখণ্ড হিসেবে, সাই ইং-ওয়েনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরও দেশটির কাছে বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড। প্রেসিডেন্ট সাই ইংয়ের সাথে ম্যাকার্থির বৈঠকের পরই চীনের সামরিক বাহিনী তাইওয়ানকে ঘিরে শুরু করে তিন দিনের রণপ্রস্তুতি মহড়া। তিন দিনের বেশি সামরিক মহড়ায় দেখা যায় ফাইটার জেট, নৌযান, এমনকি একটি বিমানবাহী রণতরী। মহড়া শেষে চীনা সামরিক বাহিনী দাবি করে- তারা ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতা’র নামে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ ও কোনো প্রকার বহিরাগত হস্তক্ষেপকে ধ্বংস করার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত।
গত বছর আগস্টে যখন মার্কিন হাউজ স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফর করেন, তখনও চীন তেমনই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। এরই জের ধরে শুরু হয় চীন-যুক্তরাষ্ট্র চিপ যুদ্ধ। বর্তমান বিশ্বে চীনের প্রভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনের অর্থনৈতিক শক্তি, মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে চীনের রাশিয়ার সাথে সংশ্লিষ্টতা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হেজিমন বিরোধিতা, মার্কিনীদের সাথে চিপ যুদ্ধ ইত্যাদি কারণে কি চীনের তাইওয়ান আক্রমণের সম্ভাব্যতা বাড়ছে? বিশ্লেষকরা মনে করছেন- চীনের তাইওয়ান আক্রমণ নিকটবর্তী তা বলা যাবে না। দীর্ঘমেয়াদে হয়তো চীন তাইওয়ানে আক্রমণ করতে পারে, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে চীনের কৌশলগত ও নীতিগত অবস্থান তাইওয়ানে আক্রমণের দিকে নিয়ে যেতে পারে, এমন ধারণার বিপরীত মত বিশ্লেষকদের। নিকট ভবিষ্যতে চীনের তাইওয়ান আক্রমণ না করার কারণগুলো চলুন জানা যাক।
বিশ্বব্যাপী চীনা সফট পাওয়ার
বৃহৎ শক্তিগুলোর বিশ্বে প্রভাব ধরে রাখার অন্যতম উপায় হচ্ছে সফট পাওয়ার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি হয়ে ওঠার পর থেকে বিশ্বব্যাপী সফট পাওয়ারের প্রসার ঘটাতে থাকে। বর্তমানে চীন একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি ও বিশ্বব্যাপী উদীয়মান পরাশক্তি হিসেবে তার সফট পাওয়ার বৃদ্ধি করে চলছে। বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে চীন পৃথিবীর তিন মহাদেশের ৬০টি দেশেকে একই রোডের আওতায় নিয়ে আসছে। যার মাধ্যমে চীন তার অর্থনৈতিক সাহায্য ও সহযোগিতা দ্বারা সেসব দেশে তার সফট পাওয়ারের প্রসার ঘটাচ্ছে।
চীন এমন একটি বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে যেখানে শুধু উন্নত দেশের নেতৃত্ব থাকবে না, বরং থাকবে উন্নয়নশীল দেশের নেতৃত্বও। শিক্ষাখাতেও চীন ব্যাপক সফট পাওয়ার প্রসার করছে তার কনফুসিয়াস ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। পৃথিবীব্যাপী ৫০০টির মতো কনফুসিয়াস ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি চীনা স্কলারশিপও শিক্ষাখাতে তার সফট পাওয়ার বৃদ্ধি করছে। উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নে চীনের বন্ধুরূপে আবির্ভাব, করোনা মহামারীর সময়ে চীনের মাস্ক ডিপ্লোম্যাসির দ্বারা দেশগুলোর পাশে দাঁড়ানো ইত্যাদি চীনের শক্ত সফট পাওয়ার কৌশল নির্দেশ করে।
তাছাড়া চীন বোঝাতে চায় যে তার নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থায় বন্ধু দেশের সরকারব্যবস্থায় চীন নাক গলাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন গণতন্ত্র চাপিয়ে দিতে চায়, চীনের ভাষ্যমতে তারা এটি করবে না। রাশিয়া যেমন ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগ দেয়ায় নিরাপত্তা হুমকি মনে করে আক্রমণ করে, সেদিক থেকে চীন একটু ভিন্ন। বরং চীন মনে করে- তাইওয়ান তাদের অংশ, বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড তারা রহিত করবে।
তাইওয়ান পৃথিবীর ৯০ শতাংশ সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন করে। চীনের তাইওয়ান আক্রমণ সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করলে তা ক্রেতা দেশে চীনের সুনাম নষ্ট করবে। চীনকে ভাবতে পারে নতুন উপনিবেশবাদী শক্তি, হারাবে কনফুসিয়াস ইন্সটিটিউটের সুনাম। সর্বোপরি চীনের এতদিনের সফট পাওয়ার নিমিষেই ধুলোয় মিশে যেতে পারে, যা চীন চাইবে না।
শান্তির দূত
চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন- তিনি যেকোনো মূল্যে তাইওয়ান কে পুনঃএকত্রীকরণ করবেন। কিন্তু বিশ্বব্যাপী শি নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে শি ১২ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন, যা রাশিয়া কর্তৃক সাদরে গৃহীত হয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কিও শি জিনপিংয়ের সাথে ফোনালাপে আলোচনাকে যুদ্ধ বন্ধে প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করেন। মধ্যপ্রাচ্যে দুই চরম বিরোধী শক্তি সৌদি আরব ও ইরান চীনের মধ্যস্থতায় নতুন করে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। মধ্যপ্রাচ্যে চীন উন্নয়ন ও শান্তির বার্তা নিয়ে যাচ্ছে। শি জিনপিং বিশ্বে নিজেকে এখন শান্তির দূত হিসেবে উপস্থাপন করতে চাচ্ছেন। তিনি চীনকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে, তাইওয়ান আক্রমণ যেখানে বাধা হয়ে উঠবে।
সামরিক অভিজ্ঞতা
ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে চীনের সামরিক বাহিনী কোনো রকমের সরাসরি সামরিক যুদ্ধে জড়ায়নি। এই দীর্ঘ সময় পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সরাসরি সংঘাত পর্যবেক্ষণ করে চীনা সামরিক বাহিনী। যার সর্বশেষ অভিজ্ঞতা হচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে চীনের জড়ানোর ক্ষতিকর দিক ভালোভাবেই পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাছাড়া সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে , যুদ্ধের ফলে উভয়পক্ষের সামরিক সক্ষমতা ও অস্ত্র সম্পর্কে প্রতিপক্ষ যেমন জানতে পারে, তেমনি অন্য দেশও ধারণা পেয়ে যায়। ফলে ভবিষ্যতে সেই দেশসমূহ হয়ে ওঠে বেশি শক্তিশালী। চীন সচরাচর চাইবে না এখনই তার সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে জানান দিতে।
অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা
চীনের সাথে তাইওয়ানের বাণিজ্যিক সম্পর্কও রয়েছে। তাইওয়ানের মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ২৬ শতাংশ হয় চীনের সাথে। চীনের পণ্যের একটি বড় ক্রেতা তাইওয়ান। যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীনও তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টরের অন্যতম ক্রেতা রাষ্ট্র। চীনের বর্তমানে সেমিকন্ডাক্টর ক্রয়ের পরিমাণ তেল ক্রয়ের পরিমাণকেও ছাড়িয়ে গেছে। ২০২১ সালে চীন সর্বমোট ৪৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সেমিকন্ডাক্টর ক্রয় করে যার ৩৬ শতাংশ আসছে তাইওয়ান থেকে। চীন তাইওয়ানের উপর এক্ষেত্রে অনেকটা নির্ভরশীল। তাছাড়া তাইওয়ানে রয়েছে চীনের উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ।
পেলোসির তাইওয়ান সফরের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া সহ অন্যান্য দেশগুলোকে সেমিকন্ডাক্টর বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে চীন নিজেদের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে বিনিয়োগ বাড়িয়ে নিজেদের তাইওয়ান বা অন্য দেশের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে চেষ্টা করছে।
চীনা বিশ্বব্যবস্থা
বর্তমানে চীনের অন্যতম প্রচারণা হচ্ছে একটি চীনা বিশ্বব্যবস্থা। চীন তার আচরণের দ্বারা বোঝাতে চায় যে তার নেতৃত্বে বিশ্বব্যবস্থায় প্রতিটি দেশের প্রতি চীন হবে উদার ও পাশে থাকা বন্ধু মতো। যেখানে উন্নত দেশের পাশাপাশি থাকবে উন্নয়নশীল দেশের নেতৃত্ব। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনা বিশ্বব্যবস্থায় কোনো দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা হবে সুপারপাওয়ারের প্রভাবমুক্ত, অর্থাৎ দেশটি হতে পারে রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আবার গণতন্ত্র। আবার চীনের নেতৃত্বের বিশ্বে এশিয়ায় মার্কিন প্রভাব থাকবে না। এখন চীন যদি তাইওয়ান আক্রমণ করে, তাহলে তার জন্য ভুল সিদ্ধান্ত হবে এই কারণে, তাইওয়ান একটি গণতান্ত্রিক দেশ, মার্কিন প্রভাব বলয়ের একটি দেশ।
সুতরাং বলা যায়, অদূর ভবিষ্যতে চীন তাইওয়ান আক্রমণ করবে না। কিন্তু ভবিষ্যতে চীনের তাইওয়ান আক্রমণের সম্ভাব্যতা বাড়ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।