প্রচলিত ধারণা অনুসারে, যেসব রাষ্ট্রের সীমান্তে সমুদ্র রয়েছে, কেবল সেসব রাষ্ট্রেরই নৌবাহিনী রয়েছে এবং যেসব রাষ্ট্রের সীমান্তে সমুদ্র নেই, অর্থাৎ যেসব রাষ্ট্র স্থলবেষ্টিত (landlocked), সেসব রাষ্ট্রের নৌবাহিনী নেই। বস্তুত আপাতদৃষ্টিতে স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্রগুলোর নৌবাহিনী রাখার কোনো প্রয়োজনও নেই। নৌবাহিনীর প্রধান কাজ হচ্ছে কোনো রাষ্ট্রের উপকূল রক্ষা করা। এখন কোনো রাষ্ট্রের যদি উপকূলই না থাকে, তাহলে সেই রাষ্ট্রের নৌবাহিনী রাখার কী দরকার? আর যদিও বা সেই রাষ্ট্রের নৌবাহিনী থাকে, সেটির জাহাজগুলো কোথায় রাখা হবে?
বাস্তবিকতা হচ্ছে, বিশ্বের এমন অনেক রাষ্ট্রের নৌবাহিনী রয়েছে, যাদের সীমান্তে কোনো খোলা সমুদ্র নেই। কারণ বহু রাষ্ট্রের জাতীয় সীমানার মধ্যে হ্রদ ও নদী রয়েছে এবং সেগুলোর নিরাপত্তা রক্ষার জন্য তাদের অনেকেই নৌবাহিনী রাখে। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্র প্যারাগুয়ের সীমান্তে কোনো সমুদ্র নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্যারাগুয়ের একটি নৌবাহিনী রয়েছে। কারণ আর্জেন্টিনা থেকে প্যারাগুয়ের প্রধান নদীগুলোর মধ্য দিয়ে প্যারাগুয়ের অভ্যন্তরে পৌঁছানো সম্ভব এবং কোনো শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্র এই পথ ব্যবহার করে প্যারাগুয়ের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। এজন্য প্যারাগুয়ের প্রধান নদীগুলোতে প্রহরা দেয়ার জন্য সশস্ত্র প্যাট্রোল বোট মোতায়েন করা থাকে।
অনুরূপভাবে, মধ্য ইউরোপের রাষ্ট্র সুইজারল্যান্ড ঐতিহাসিকভাবে একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র এবং তাদের সীমান্তে কোনো সমুদ্র নেই। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের অভ্যন্তরে অনেকগুলো হ্রদ রয়েছে এবং এগুলোর নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সুইজারল্যান্ডের একটি নৌবাহিনী রয়েছে। সুইস নৌবাহিনীর সশস্ত্র প্যাট্রোল বোটগুলো এই হ্রদগুলোতে পাহারা দেয়। একইভাবে মধ্য ইউরোপের আরেকটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র হাঙ্গেরিরও নৌবাহিনী রয়েছে। হাঙ্গেরির সীমান্তে কোনো সমুদ্র নেই, কিন্তু তারপরেও হাঙ্গেরির যুদ্ধজাহাজ ও মাইন অপসারণকারী জাহাজসমেত একটি পূর্ণাঙ্গ নৌবহর রয়েছে।
মধ্য এশিয়ার স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র কাজাখস্তান ও তুর্কমেনিস্তান এবং দক্ষিণ ককেশাসের স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র আজারবাইজানেরও নিজস্ব নৌবাহিনী রয়েছে এবং এগুলোর শক্তিসামর্থ্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ এই রাষ্ট্র তিনটির সঙ্গে বৃহৎ কাস্পিয়ান সাগরের সীমান্ত রয়েছে। উল্লেখ্য, কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী রাষ্ট্রগুলো এটিকে একটি ‘সাগর’ হিসেবে বিবেচনা করে বটে, কিন্তু ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি হ্রদ, কারণ এটির মধ্য দিয়ে খোলা সমুদ্রে পৌঁছানো যায় না। এজন্য কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী এই রাষ্ট্র তিনটিকে স্থলবেষ্টিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু স্থলবেষ্টিত হওয়ার পরেও এই রাষ্ট্রগুলোর নৌবাহিনী বিদ্যমান।
এই রাষ্ট্রগুলোর নৌবাহিনী থাকার যৌক্তিক কারণ রয়েছে, কারণ এই রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে তাদের নৌবাহিনীগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু বিশ্বে এমন একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র রয়েছে, যেটির নৌবাহিনী থাকার কোনো সামরিক বা কৌশলগত যৌক্তিকতা নেই, তবুও তাদের একটি নৌবাহিনী রয়েছে। এই স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্রটি হচ্ছে পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত আয়তনে বৃহৎ কিন্তু জনবিরল রাষ্ট্র মঙ্গোলিয়া।
‘মোঙ্গল রাষ্ট্র’ (মঙ্গোলীয়: Монгол Улс, ‘মোঙ্গল উলস’) বা মঙ্গোলিয়া জাতিগত মোঙ্গলদের দ্বারা অধ্যুষিত একটি বৃহদাকৃতির রাষ্ট্র। রাষ্ট্রটির আয়তন ১৫,৬৪,১১৬ বর্গ কি.মি. এবং আয়তনের দিক থেকে এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র (কাজাখস্তানকে যদি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা না করা হয়, সেক্ষেত্রে মঙ্গোলিয়া বিশ্বের বৃহত্তম স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র)। মঙ্গোলিয়ার উত্তরে রাশিয়া এবং দক্ষিণে চীন অবস্থিত। মঙ্গোলিয়ার সীমান্তে কোনো সমুদ্র নেই এবং মঙ্গোলিয়ার সীমান্ত থেকে সবচেয়ে কাছের সমুদ্রটি মঙ্গোলিয়া থেকে ৬০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে অবস্থিত। বিশ্বের অন্য কোনো রাষ্ট্রই সমুদ্র থেকে এত দূরে অবস্থিত নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মঙ্গোলিয়ার একটি নৌবাহিনী রয়েছে।
অবশ্য রুশ–মঙ্গোলীয় সীমান্তে ১০ কি.মি. দীর্ঘ উভস হ্রদ অবস্থিত এবং এই হ্রদটির একটি ক্ষুদ্র অংশ রুশ ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। এটি মঙ্গোলিয়ার একমাত্র আন্তর্জাতিক জলসীমা। কার্যত রুশ–মঙ্গোলীয় সীমান্ত অত্যন্ত বিস্তৃত এবং রাশিয়া যদি কখনো মঙ্গোলিয়ার ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে, সেক্ষেত্রে তারা সীমান্তের এই ক্ষুদ্র জলপথটি ব্যবহার করবে বলে প্রতীয়মান হয় না। কিন্তু তারপরেও মঙ্গোলিয়া চাইলে নিজেদের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য উভস হ্রদে একটি নৌবাহিনী রাখতে পারে এবং সামরিক দিক থেকে এর অন্তত কিছুটা যৌক্তিকতা রয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, উভস হ্রদে মঙ্গোলীয় নৌবাহিনীর কোনো উপস্থিতি নেই।
মঙ্গোলীয় নৌবাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে খোভসগোল হ্রদে। খোভসগোল হ্রদটি রুশ–মঙ্গোলীয় বা চীনা–মঙ্গোলীয় সীমান্তে অবস্থিত নয়। এই হ্রদটি সম্পূর্ণভাবে মঙ্গোলীয় ভূমি দ্বারা পরিবেষ্টিত। রুশ–মঙ্গোলীয় সীমান্ত থেকে এই হ্রদটি ১৩ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে এবং এই হ্রদ ও রুশ–মঙ্গোলীয় সীমান্তের মধ্যবর্তী স্থানে একটি পর্বতমালা অবস্থিত। সুতরাং রাশিয়া যদি কখনো মঙ্গোলিয়ার ওপর আক্রমণ চালায়, সেক্ষেত্রে রুশ নৌবাহিনী খোভসগোল হ্রদের মাধ্যমে মঙ্গোলীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়বে, এরকম কোনো আশঙ্কা নেই। কার্যত এই হ্রদটির চারপাশে একটি মনোরম জাতীয় পার্ক অবস্থিত। আর এই হ্রদেই মঙ্গোলীয় নৌবাহিনীর একমাত্র অবস্থান।
এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, মঙ্গোলিয়ার নৌবাহিনী থাকার সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই, কারণ জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা করাই যদি মঙ্গোলীয় নৌবাহিনীর উদ্দেশ্য হতো, সেক্ষেত্রে খোভসগোল হ্রদের পরিবর্তে উভস হ্রদে নৌবাহিনীকে মোতায়েন করাই ছিল যৌক্তিক পদক্ষেপ। কিন্তু সেরকম কিছু করা হয়নি। সেক্ষেত্রে স্থলবেষ্টিত মঙ্গোলিয়া কেন অনর্থক একটি নৌবাহিনী রেখেছে? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আট শতাব্দী আগে ফিরে যেতে হবে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মোঙ্গল ইউয়ান সাম্রাজ্যের সম্রাট কুবলাই খানের ছিল তদানীন্তন বিশ্বের বৃহত্তম নৌবাহিনী। সেসময় মঙ্গোলিয়া স্থলবেষ্টিত ছিল না এবং জাপান সাগর, পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগর, আরব সাগর ও পারস্য উপসাগরের সঙ্গে সুবৃহৎ মোঙ্গল সাম্রাজ্যের সীমান্ত ছিল। কুবলাই খানের শাসনামলে মোঙ্গলরা দুবার জাপান আক্রমণের জন্য বিরাট নৌবহর প্রেরণ করেছিল, কিন্তু প্রত্যেকবারই ভয়াবহ টাইফুনের আঘাতে আক্রমণকারী মোঙ্গল নৌবহর ধ্বংস হয়ে যায়। এই টাইফুনকে জাপানিরা ‘কামিকাজে’ বা ‘পবিত্র বাতাস’ নামে অভিহিত করত। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে যেসব আত্মঘাতী জাপানি বৈমানিক নিজেদের বিমানসহ মিত্রশক্তির জাহাজগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত, তাদেরকেও ‘কামিকাজে’ হিসেবে অভিহিত করা হতো এবং এর মধ্য দিয়ে এই শব্দটি পরিচিতি লাভ করেছে।
পরবর্তীতে মোঙ্গল সাম্রাজ্য টুকরো টুকরো হয়ে যায় এবং মোঙ্গল রাষ্ট্র তাদের সমুদ্রসীমা ও বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড হারিয়ে তাদের বর্তমান সীমানায় আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সঙ্কুচিত ও স্থলবেষ্টিত মোঙ্গল রাষ্ট্রের নৌবাহিনীর কোনো প্রয়োজন ছিল না, সুতরাং এসময় আর মঙ্গোলিয়ার কোনো নৌবাহিনী ছিল না। সপ্তদশ শতাব্দী নাগাদ মঙ্গোলিয়া চীনভিত্তিক চিং সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে চলে যায় এবং সেসময়ও মঙ্গোলিয়ায় চীনারা কোনো নৌবাহিনী রাখেনি। কিন্তু ১৯৩০–এর দশকে এই পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসে।
১৯১১ সালে মঙ্গোলিয়া চিং সাম্রাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১৯২১ সালে সংঘটিত ‘মঙ্গোলীয় বিপ্লবে’র ফলে মঙ্গোলিয়ায় বলশেভিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এসময় মঙ্গোলিয়ার বৃহৎ উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশী বলশেভিক–শাসিত সোভিয়েত ইউনিয়ন মঙ্গোলিয়ার প্রধান সামরিক ও রাজনৈতিক মিত্ররাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৩০–এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন মঙ্গোলিয়াকে একটি টাগবোট উপহার হিসেবে প্রদান করে এবং এর মধ্য দিয়ে মঙ্গোলীয় নৌবাহিনীর পুনর্জন্ম হয়। এই টাগবোটটির নামকরণ করা হয় ‘সুখবাতার’। মঙ্গোলিয়ার প্রথম যুদ্ধমন্ত্রী এবং ‘মঙ্গোলীয় গণফৌজে’র প্রথম সর্বাধিনায়ক দামদিন সুখবাতারের নামে এই নৌযানটির নামকরণ করা হয়েছিল। এভাবে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম নৌবাহিনী হিসেবে মঙ্গোলীয় নৌবাহিনীর পুনরাবির্ভাব ঘটে। অবশ্য মঙ্গোলীয় নৌবাহিনীকে ঠিক যুদ্ধের উদ্দেশ্যে স্থাপন করা হয়নি।
কমিউনিস্ট শাসনামলে মঙ্গোলীয় নৌবাহিনীর টাগবোটটি খোভসগোল হ্রদের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত তেল পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হতো। এই অঞ্চলে মোটরগাড়ি চলাচলের উপযোগী কোনো সড়ক নেই এবং স্থলপথে ঘোড়ার মাধ্যমে এই তেল পরিবহন করতে ৪ দিন সময় লাগত। অন্যদিকে, খোভসগোল হ্রদের মাধ্যমে তেল পরিবহনে সময় লাগত মাত্র ৮ ঘণ্টা। স্বাভাবিকভাবেই এই পথটি ছিল মঙ্গোলীয় কর্তৃপক্ষের জন্য বেশি আকর্ষণীয় এবং ক্ষুদ্র মঙ্গোলীয় নৌবাহিনীর অস্তিত্বের একটা উদ্দেশ্য ছিল। এছাড়া একটি প্রতীকী নৌবাহিনী রাখার মধ্য দিয়ে মঙ্গোলীয়রা তাদের অতীতের নৌ ঐতিহ্যের প্রতি একটি সম্মানসূচক নিদর্শন রাখতে ইচ্ছুক ছিল।
কিন্তু মঙ্গোলিয়ায় কমিউনিজমের পতনের পর রাষ্ট্রটির তেলশিল্পের কেন্দ্র অন্যত্র স্থানান্তরিত হয় এবং এর ফলে খোভসগোল হ্রদের মাধ্যমে তেল পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মঙ্গোলীয় সরকারের জন্য নৌবাহিনীর আর কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল না। তারা নৌবাহিনীর জন্য বরাদ্দ বাজেট হ্রাস করতে শুরু করে এবং অবশেষে একে বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মঙ্গোলীয় নৌবাহিনী বিলুপ্ত হয়ে যায়।
কিন্তু বেসরকারিকরণের পরেও এই অতি ক্ষুদ্র নৌবাহিনীটি তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। বর্তমানে বেসরকারিকৃত মঙ্গোলীয় নৌবাহিনীতে একটি মাত্র নৌযান রয়েছে এবং সেটি হচ্ছে ‘সুখবাতার–৩’ নামক একটি টাগবোট। মাত্র সাতজন নাবিক নিয়ে মঙ্গোলিয়ার ক্ষুদ্র নৌবাহিনী গঠিত। মঙ্গোলীয় নৌবাহিনীর ওপর নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্রে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, উক্ত টাগবোটটির সাত জন নাবিকের মধ্যে মাত্র একজন সাঁতার কাটতে পারে। বর্তমানে তারা এই টাগবোটে করে খোভসগোল হ্রদের একপাশ থেকে অন্যপাশে মালামাল পরিবহন করে এবং পর্যটকদের পৌঁছে দেয়। এভাবে বিশ্বের এককালীন বৃহত্তম নৌবাহিনী বর্তমানে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম নৌবাহিনীতে পরিণত হয়েছে।