১৯৯৯ সালের ২৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা উপকূলের অদূরে একটি যাত্রীবাহী নৌযান মারাত্মক দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়। সেই নৌযানে কিউবা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়প্রত্যাশী এলিজাবেথ রদ্রিগেজ, তার ছেলে এলিয়ন গঞ্জালেস এবং আরো দশ অভিযাত্রী ছিলেন। নৌযানটি ডুবে যাওয়ায় এলিজাবেথ এবং আরো আট আশ্রয়প্রত্যাশী মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। সেই নৌযানেরই দুই যাত্রী সাঁতরে উপকূলে পৌঁছাতে সক্ষম হন। আর মাত্র ছয় বছর বয়সী এলিয়ন গঞ্জালেসের জীবন অলৌকিকভাবে রক্ষা পায়। শিশুটিকে দুজন মৎস্যজীবী উদ্ধার করে যুক্তরাষ্ট্রের কোস্ট গার্ডের কাছে হস্তান্তর করে। পরে চিকিৎসার জন্য এলিয়নকে নিকটস্থ এক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধের সময় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিউবা থেকে আসা রাজনৈতিক আশ্রয়প্রত্যাশীদের জন্য ১৯৬৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। সেই আইনের সুবিধানুযায়ী কিউবা থেকে অনেক মানুষ আধুনিক জীবনধারণের প্রত্যাশা এবং রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে দমন-পীড়নের আশঙ্কায় পালিয়ে এসে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি লাভ করে। এভাবে অনেক আশ্রয়প্রত্যাশী কিউবান নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার মায়ামি শহরে বসবাস শুরু করেন।
মায়ামি শহরে বসবাসকারী যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রয়প্রত্যাশীদের মধ্যে সেই নৌযান দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া শিশু এলিয়ন গঞ্জালেসের আত্মীয়-স্বজনও ছিলেন। হাসপাতালে থেকে সুস্থ হওয়ার পর এলিয়নকে কিছুদিনের জন্য মায়ামিতে তার আত্মীয়দের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারা মায়ামিতে এলিয়নের আশ্রয় দেওয়ার দাবি তোলেন। কিন্তু কিউবায় বসবাসরত এলিয়নের বাবা হুয়ান মিগুয়েল গঞ্জালেস মার্কিন প্রশাসনের নিকট তার ছেলেকে কিউবায় ফেরত পাঠানোর দাবি জানান। তিনি দাবি করেন, সাবেক স্ত্রী এলিজাবেথ রদ্রিগেজ তার দ্বিতীয় স্বামীর সহায়তার অবৈধভাবে তার ছেলেকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য পাড়ি দেয়। তবে মায়ামিতে বসবাসরত এলিয়নের আত্মীয়েরা দাবি করেন, কিউবার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রো এলিয়নের বাবাকে প্রভাবিত করেছিলেন।
এমনকি কিউবার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এই ইস্যুতে পরস্পরের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্য রাখেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার মধ্যে তীব্র কূটনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়। কারণ এলিয়নকে কিউবাতে ফেরত নিয়ে আসাকে তৎকালীন ক্যাস্ট্রো সরকারের জন্য সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। ছেলেকে ফেরত পাওয়ার জন্য হুয়ান মিগুয়েল গঞ্জালেস মার্কিন আদালতের দ্বারস্থ হন। ফলে এলিয়নকে কিউবায় তার বাবার কাছে ফেরত পাঠানো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে কয়েক মাস দীর্ঘ আইনি লড়াই চলে, যা তৎকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়।
অবশেষে মার্কিন আদালতের সিদ্ধান্তের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন এলিয়নকে কিউবায় তার বৈধ অভিভাবক বাবার কাছে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ, তৎকালীন সংশোধিত আইনানুযায়ী রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার জন্য কোনো ব্যক্তিকে অন্ততপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের উপকূল পর্যন্ত পৌঁছাতে হত, কিন্তু এলিয়নকে উপকূলের নিকটবর্তী ডুবে যাওয়া একটি নৌযান থেকে উদ্ধার করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এমন সিদ্ধান্ত মায়ামিতে বসবাসরত ফিদেল ক্যাস্ত্রোর রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী কিউবার নাগরিকেরা মেনে নিতে পারেনি। ফলে তাদের সাথে পুলিশের কয়েক দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে এলিয়নকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে কিউবা জুড়ে প্রতিবাদ-সমাবেশ অব্যাহত থাকে। মায়ামিতে বসবাসরত এলিয়নের আত্মীয়রা আদালতের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে তাকে মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানালে এবং শিশুটির আত্মীয়দের সাথে কয়েক দফা সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর পর যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ২০০০ সালের ২২ এপ্রিল মায়ামি শহরে ফেডারেল এজেন্ট প্রেরণ করে একটি বিশেষ উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে আত্মীয়দের কাছ থেকে শিশুটিতে জোরপূর্বক নিয়ে এসে তার বাবার কাছে পাঠানোর পদক্ষেপ নেয়।
পরে এলিয়নকে একটি হেলিকপ্টারে করে ওয়াশিংটন ডিসির অ্যান্ড্রুজ এয়ার ফোর্স বেজে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তার বাবা ছেলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এরপর কিউবাতে ফিরে যাওয়ার বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে ২০০০ সালের ২৮ জুন সাত মাসেরও বেশি সময় পর এলিয়ন ও তার বাবা হাভানার হোসে মার্তি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর কিউবার সাধারণ মানুষ এলিয়ন এবং তার বাবাকে সাদরে গ্রহণ করে এবং কিউবা সরকার এই ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাদের কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে অভিহিত করে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সাথে শিশুটিকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।
এলিয়নের এই বিস্ময়কর ঘটনাকে উপজীব্য করে ২০০০ সালে “A Family In Crisis: The Elian Gonzales Story” নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, যেটির পরিচালক ক্রিস্টোফার লিচ। পরবর্তীতে এই রোমাঞ্চকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরও কয়েকটি ডকুমেন্টারি নির্মিত হয়। ১৯৯৩ সালের ৬ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করা এলিয়ন বর্তমানে শিল্প প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে কিউবার একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। তিনি সেসময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাকে কিউবায় ফিরিয়ে আনতে সেদেশের সরকার এবং তার বাবার ভূমিকা এখনও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন।