মরীচিকা সম্পর্কে ধারণা আছে নিশ্চয়ই? মরুভূমির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে একসময় আপনার শরীরে ক্লান্তি এসে ভর করবে, আর সেসময়ই হয়তো দেখতে পাবেন সামনে পানির নহর বয়ে চলেছে। আপনি সুমিষ্ট ঠান্ডা পানির আশায় খানিকটা এগিয়ে যাবেন, কিন্তু কিছুদূর গিয়ে মনে হবে আপনার হাঁটার সঙ্গে পানির নহরও কিছুটা পিছিয়ে যাচ্ছে। এভাবে অনেকক্ষণ হাঁটার পর শেষ পর্যন্ত আপনি আর সেই পানির উৎসের খোঁজ পাবেন না। মনে হবে যেন আপনাকে ধোঁকা দেয়া হয়েছে। পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের জন্য এমনটা হয়ে থাকে, যেটা একজন বিজ্ঞানের ছাত্র হলে আপনার ভালোমতোই জানা থাকার কথা।
কিন্তু যদি এমন হয় যে, আপনি পানির নহর দেখতে পেলেন, সেই অনুযায়ী এগিয়েও গেলেন এবং দেখলেন আসলেই পানির নহর সেখানে? বিজ্ঞানকে ভুল প্রমাণ করার উপাদান পেয়ে খুশি হয়ে যেতে পারেন হয়তো। পেরুর মরুভূমিতে গিয়ে আপনি মরীচিকার বদলে বাস্তবেই এমন কিছুর সন্ধান পেতে পারেন, যেটি দেখলে আপনার চোখ কপালে উঠে যাবে।
পেরুর নাম শুনলেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে ইনকা সভ্যতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন মাচু পিচ্চুর কথা। ১৯১১ সালে আমেরিকান ইতিহাসবিদ হিরাম বিংহামের মাধ্যমে আবিষ্কার করার আগপর্যন্ত আন্দিজ পর্বতমালার উপর অবস্থিত এই স্থাপত্যের কথা পৃথিবীবাসীর কাছে অজানা ছিল। শুধু মাচু পিচ্চুই নয়, রংধনু পাহাড় কিংবা নাজকা লাইন দেখার জন্যও প্রতিবছর লাখ লাখ পর্যটক ভীড় জমান লাতিন আমেরিকার এই দেশে।
সেই হিসেবে হুয়াকাচিনা যেন পাদপ্রদীপের আলোয় না থাকা কোনো স্বল্পপরিচিত ঐতিহাসিক গুরুত্বহীন স্থান। মরুভূমির মাঝখানে এতে চমৎকার একটি গ্রাম, অথচ এর তেমন পরিচিতি নেই– এসব পর্যবেক্ষণ করলেই বিস্ময় জাগে। মরুভূমিপ্রেমী মানুষেরা পৃথিবীর যেসকল স্থানে অন্তত জীবনে একবার হলেও ভ্রমণ করতে চান, সেই স্থানগুলোর তালিকায় উপরের দিকে থাকার যোগ্য দাবিদার পেরুর হুয়াকাচিনা। মরুভূমিপ্রেমী না হলেও সমস্যা নেই, এই স্থানটির অপার্থিব সৌন্দর্য আপনাকে বিমোহিত করতে করবে– এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
হুয়াকাচিনা হচ্ছে পেরুর উপকূলীয় সেচুরা মরুভূমির মাঝখানে অবস্থিত একটি গ্রাম, যেখানে অনায়াসে কয়েকদিন সময় কাটিয়ে দিতে পারবেন আপনি। এই গ্রামে মাত্র একশো পঞ্চাশজনেরও কম সংখ্যক অধিবাসী বসবাস করে, যারা প্রায় সবাই পর্যটনব্যবসার সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত। মরুভূমির মাঝখানে হলেও আবাসন নিয়ে কোন চিন্তা করতে হবে না আপনাকে, কারণ পর্যটকদের থাকার জন্য চমৎকার কিছু হোটেল ও রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে। তবে মরুভূমিতে অবস্থানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে পানি, আর হুয়াকাচিনা গড়ে উঠেছে মূলত একটি ছোট প্রাকৃতিক জলাধারকে কেন্দ্র করে। তাই এখানে পানিজনিত কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে না আপনাকে।
আপনি চাইলে এখানে অবস্থিত জলাধারে সাঁতার কাটতে পারবেন কিংবা নৌকা নিয়েও বেরোতে পারবেন। সেচুরা মরুভূমির তপ্ত বালুপথ পাড়ি দিয়ে আসার পর যখন বিভিন্ন গাছের ছায়াঘেরা এই লেগুনা চোখের সামনে দৃশ্যমান হবে, তখন নিশ্চিতভাবেই আপনি এর সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে যাবেন। আসলে সেই ছোট্ট লেগুনাই হুয়াকাচিনা গ্রামের প্রাণ, এটিই পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ।
হুয়াকাচিনা যেতে হলে লাতিন আমেরিকার দেশ পেরুতে পা রাখতে হবে আপনাকে। এরপর পেরুর রাজধানী লিমা থেকে ইকা অঞ্চলে যেতে হবে বাসযোগে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইকায় বিমানবন্দর না থাকায় স্থলপথই একমাত্র ভরসা। রাজধানী লিমা থেকে বাসের মাধ্যমে ইকায় পৌছাতে আপনার পাঁচ-ছয় ঘন্টা লাগবে, খুব বেশি সময় নয়। ইকা থেকে হুয়াকাচিনা মাত্র চার কিলোমিটারের পথ, বাসে করে যেতে সর্বোচ্চ দশ মিনিট সময় লাগবে। স্থানীয় বাসসার্ভিসের সাথে আগে থেকেই অনলাইনে যোগাযোগ করে রাখলে ঝামেলা কম হবে। লিমা থেকে একেবারে হুয়াকাচিনা পৌঁছাতে সর্বমোট চল্লিশ পেরুভিয়ান সোল (পেরুর মুদ্রার নাম) খরচ হতে পারে। হুয়াকাচিনা গ্রামেই উন্নতমানের হোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে, যেখানে অনায়াসেই ঐতিহ্যবাহী স্থানীয় খাবারগুলো পেয়ে যাবেন, তাই খাবার নিয়েও কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না আপনাকে।
কীভাবে মরুভূমির মাঝখানে এমন অনিন্দ্যসুন্দর জলাধার গড়ে উঠল, সেটি নিয়ে বিভিন্ন লোকশ্রুতি প্রচলিত আছে। ‘হুয়াকাচিনা’ (Huacachina) শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘ক্রন্দনরত তরুণী’। পেরুর বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন, বহু বছর আগে একজন ইনকা রাজকন্যা মরুভূমির মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। ঘটনাক্রমে সেই রাজকন্যা একজন শিকারির হাতে ধরা পড়েন। শিকারি তার দিকে খারাপ নজরে তাকালে রাজকন্যা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং তার হাতে থাকা আয়না মাটিতে পড়ে যায়। স্থানীয় লােকশ্রুতি অনুযায়ী, আয়না মাটিতে পড়ে ভেঙে যায় এবং কাঁচের টুকরো থেকেই পরবর্তীতে সৃষ্টি হয় এই জলাধার। আবার অনেকের মতো, এক ইনকা রাজকন্যা একজন সুদর্শন যুবককে প্রচন্ড ভালোবাসত, কিন্তু পরবর্তীতে হঠাৎ করে সেই যুবক মারা যান। রাজকন্যা তার ভালোবাসার মানুষের মৃত্যুতে এত বেশি কাঁদেন যে তার চোখের পানি থেকেই পরবর্তীতে সেই জলাধার সৃষ্টি হয়। এগুলো ছাড়াও আরও বেশ কিছু জনশ্রুতি রয়েছে, সবগুলোতেই ইনকা রাজকন্যার কথা বলা হয়েছে।
হুয়াকাচিনাতে আপনি চমৎকার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উপভোগ করতে পারবেন। বালির সাগর থেকে সূর্য উঠছে কিংবা বালির সাগরে সূর্য ডুবে যাচ্ছে, দূর থেকে বালুকারাশি চকচক করতে শুরু করেছে– এসব দৃশ্য আপনার চোখে প্রশান্তি এনে দেবে। তবে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মতো বিষয়গুলো পরিপূর্ণরূপে উপভোগের জন্য কোনো বালুর ঢিবির উপর উঠতে হবে আপনাকে। এছাড়া এখানকার প্রধান উপভোগ্য বিষয় হলো স্যান্ডবোর্ডিং। বাতাসের কারণে মরুভূমিতে বালু সরে গিয়ে কোনো কোনো স্থানে উঁচু ঢিবি তৈরি হয়। এই ঢিবিগুলোতে ওঠার পর কাঠ বা অন্যান্য কিছু দিয়ে তৈরি বোর্ডের মাধ্যমে নিচে নেমে আসা যায়। যদি ব্যাপারটি অনেকটি স্নোবোর্ডিংয়ের মতোই। বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলে স্নোবোর্ডিংয়ের ক্ষেত্রে পায়ের নিচে যেমন স্নোবোর্ড থাকে, স্যান্ডবোর্ডিংয়ের ক্ষেত্রে মরুভূমিতে আপনাদের পায়ের নিচে তেমনি একটি স্যান্ডবোর্ড থাকবে। এছাড়াও হুয়াকাচিনা গ্রামের আশেপাশে মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ‘ডিউন বাগি গাড়ি’ রয়েছে, যেগুলোতে চড়ে চমৎকার রাইড উপভোগ করা যায়।
মরুভূমির মাঝে এরকম একটি গ্রাম আসলে আশ্চর্যের বিষয়। প্রকৃতি আমাদের সামনে এতসব অনিন্দ্যসুন্দর সৃষ্টি তৈরি করে রেখেছে যে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। আগেই বলা হয়েছে, পেরু বলতেই আমাদের সামনে মাচু পিচ্চু, নাজকা লাইন কিংবা রংধনু পাহাড়ের চিত্র ভেসে উঠলেও হুয়াকাচিনার কথা কখনোই মনে আসে না। আস্ত মরুভূমির মাঝখানে জলাধারসমেত একটি গ্রাম, যেখানে স্থানীয় খাবারের স্বাদ নেয়ার পাশাপাশি চাইলে স্যান্ডবোর্ডিং কিংবা বাগি গাড়ির মাধ্যমে মরুভূমিতে চষে বেড়ানো– হুয়াকাচিনায় আসলে উপভোগের মতো আছে অনেক কিছুই।