উন্নয়নশীল দেশগুলো কেন উন্নত দেশে উন্নীত হয় না?

লাতিন আমেরিকা দেশগুলো একটা দীর্ঘ সময় ছিল ইউরোপীয় উপনিবেশ শাসনে। সেই দেশগুলো ইউরোপের শিল্পগুলোতে সরবরাহ করতো বিভিন্ন রকমের কাঁচামাল। ইউরোপে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের উত্থান আর আটলান্টিক রেভল্যুশনের ফলাফলকে কেন্দ্র করে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো স্বাধীনতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় আর তৃতীয় দশকেই স্বাধীনতা অর্জন করে বেশিরভাগ লাতিন দেশ। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক বিচ্ছেদ ঘটলেও ইউরোপের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটেনি লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর। সেই দেশগুলো কাঁচামাল সরবরাহ অব্যাহত রাখে ইউরোপীয় দেশগুলোতে।

লাতিন আমেরিকার দেশগুলো স্বাধীনতার দু’শো বছর পরও নিজেদের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি, পারেনি নিজেদের শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করতে; Image Source: Yale News

কফি ও চিনির মতো প্রাচুর্য থাকা পণ্যগুলো সরবরাহের জন্য লাতিন আমেরিকার দেশগুলো কাঁচামাল রপ্তানির মাধ্যমেই নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা খুঁজে পায়। রপ্তানির পথ সহজ করতে লাতিন আমেরিকান দেশগুলো ঋণ নেয় ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে, ঋণের অর্থে শুরু হয় অবকাঠামো উন্নয়ন। নতুন তৈরি করা রাস্তাঘাট, বন্দর আর রেলপথ যোগাযোগ সহজ করে, বদল আনে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে। কিন্তু, রপ্তানি বৃদ্ধির ফলে আয় দিয়ে ইউরোপীয়দের ঋণ পরিশোধের যে পরিকল্পনা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর ছিল, সেটি বাস্তবায়িত হয়নি।

আবার, অর্থনৈতিক পরিবর্তনের যে স্বপ্ন লাতিন আমেরিকার দেশগুলো দেখেছিল, সেটিও পূরণ হয়নি। বরং, শহরতলিতে তৈরি হতে থাকে বস্তি, তৈরি হয় নতুন শহুরে দরিদ্রশ্রেণী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন ইউরোপের দেশগুলো লাতিন আমেরিকা থেকে আমদানি কমিয়ে দেয়, লাতিন আমেরিকার দেশগুলো অনুধাবন করে নতুন অর্থনৈতিক সংকট। দেশগুলো স্বাধীনতার দু’শো বছর পরেও নিজেদের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি, পারেনি নিজেদের শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করতে। জনগণের জীবনযাত্রার মানও আহামরি বাড়েনি, বাড়েনি সার্বিক ক্রয়ক্ষমতা। বরং, নতুন নতুন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হচ্ছে এই দেশগুলোকে।

নতুন নতুন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হচ্ছে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে; Image Source: Forbes.

মডার্নাইজেশন থিওরির ব্যাখ্যা

লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে রয়েছে দুর্বল সরকারব্যবস্থা, সেখানে ঘন ঘন হয়েছে সামরিক অভ্যুত্থান। এসব দেশে জনগণের হাতে পুঁজির পরিমাণ একবারেই কম, কম থাকে সঞ্চয়ও। ফলে, এসব দেশে উদ্যোক্তা কম, অর্থের বাইরেও উদ্যোক্তা তৈরিতে সংকট রয়েছে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক পরিবেশেরও। আবার, কার্যকর অবকাঠামোরও সংকট রয়েছে এসব দেশে, সংকট রয়েছে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রেও। কৌশলগত জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি সীমাবদ্ধতা রয়েছে কারিগরি জ্ঞানেও।

লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মতো প্রায় একই ধরনের পরিস্থিতি রয়েছে আফ্রিকা আর এশিয়ার দেশগুলোতেও। এসব দেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করে শিল্পের কাঁচামাল সরবারহকারী হিসেবে। দেশগুলো গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বার বার হয়েছে সামরিক অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক সহিংসহতা আর সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে নিয়মিত। এসব দেশেও শাসকেরা জনগণকে স্বপ্ন দেখান উন্নত বিশ্বের মতো প্রবৃদ্ধি আর অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের। কিন্তু, এসব দেশ সাধারণত কখনোই উন্নত দেশের তালিকায় যেতে পারে না।

মডার্নাইজেশন থিওরি অনুযায়ী, এসব দেশ উন্নত দেশের তালিকায় স্থান করে নিতে পারে না, কারণ এরা দেশের অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যগুলো বদল করতে পারে না। এসব দেশে শাসনতন্ত্র থাকে দুর্বল, প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে না, চলে ব্যক্তির অবতারবাদ। জনগণের মধ্যে সঞ্চয়ের সামঞ্জস্য না থাকায় উদ্যোক্তা সংস্কৃতিও গড়ে ওঠে না। শিক্ষা আর গবেষণায়ও অত্যন্ত কম বরাদ্দ দেয় এসব দেশ, ফলে দক্ষ মানবসম্পদও গড়ে ওঠে না। অর্থাৎ, দেশের অভ্যন্তরীণ কারণেই এসব দেশ উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে পরিণত হতে পারে না।

শাসকেরা জনগণকে স্বপ্ন দেখান, উন্নত বিশ্বের মতো প্রবৃদ্ধি আর অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের। কিন্তু, এসব দেশ সাধারণত কখনোই উন্নত দেশের তালিকায় যেতে পারে না; Image Source: Nature.

মডার্নাইজেশন থিওরির ব্যাখ্যানুযায়ী, উন্নয়নশীল এসব দেশের উন্নত দেশে পরিণত হতে হলে উন্নত দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলো অনুকরণ করতে হবে। অনুকরণ করে উন্নত দেশগুলোর মতো শাসনতন্ত্রের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াগুলোকে গতিশীল করা, শাসনতন্ত্রে ব্যক্তির প্রভাবের চেয়ে সাংবিধানিক কাঠামোগুলোকে শক্তিশালী করা, দুর্নীতি কমিয়ে আনা, স্বচ্ছতা নিয়ে আসা- এভাবেই একটি দুর্বল অর্থনীতির দেশ উন্নত দেশে পরিণত হতে পারবে।

ডিপেন্ডেন্সি থিওরি

ডিপেন্ডেন্সি থিওরির উত্থান ঘটেছে মূলত মডার্নাইজেশন থিওরির বিকল্প হিসেবে। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে উত্থান ঘটে ডিপেন্ডেন্সি থিওরির। এই থিওরির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন রাউল প্রেসবিশ, ফার্নান্দো কারডোজো আর আন্দ্রে গান্ডার ফ্রাঙ্কের মতো রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদরা।

ডিপেন্ডেন্সি থিওরির তাত্ত্বিকদের মতে, একটি রাষ্ট্র উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে পরিণত হতে না পারার জন্য অভ্যন্তরীণ কারণগুলোর চেয়ে বাইরের কারণগুলো বেশি দায়ী। ডিপেন্ডেন্সি থিওরিতে দেখানো হয়েছে কীভাবে বাইরের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাবকগুলো একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক গতিপ্রকৃতি ঠিক করে দেয়। ডিপেন্ডেন্সি থিওরি অনুসারে, একটি উন্নয়নশীল দেশ উন্নত হতে পারে না আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণের কারণেই।

ডিপেন্ডেন্সি থিওরির তাত্ত্বিকদের মতে, একটি রাষ্ট্র উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে পরিণত হতে না পারার জন্য অভ্যন্তরীণ কারণগুলোর চেয়ে বাইরের কারণগুলো বেশি দায়ী; Image Source: Gallup News

ডিপেন্ডেন্সি থিওরির তাত্ত্বিকেরা পৃথিবীর দেশগুলোতে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করেছেন, কেন্দ্রীয় ও প্রান্তিক রাষ্ট্রসমূহ। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রসমূহ বৈশ্বিক উত্তরের, যেখানে অর্থনীতির ভিত্তি অনেক মজবুত, শিল্পের বিকাশ ঘটেছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিকশিত হয়েছে শিল্পকে কেন্দ্র করে। বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলো থেকে এরা কাঁচামাল আমদানি করে পণ্য তৈরি করে, এবং পরবর্তীতে সেগুলো আবার বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোতে রপ্তানি করে।

আবার, প্রান্তিক রাষ্ট্রসমূহ বৈশ্বিক দক্ষিণের, যেখানে শিক্ষার হার কম, অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এসব দেশ অংশগ্রহণ করে কাঁচামালের রপ্তানিকারক হিসেবে, প্রাথমিক পণ্য রপ্তানি করে আয় থেকেই দাঁড়ায় এদের অর্থনীতির ভিত্তি। রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিকশিত না হওয়ায় এসব দেশে আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই। এসব দেশের জনগণের স্বপ্ন থাকে, একদিন তাদের দেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে, হবে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ, অর্থনীতির চাকা ঘুরবে শিল্পায়নের মাধ্যমে। সাধারণত, কেন্দ্রে থাকা রাষ্ট্রগুলো প্রান্তিক রাষ্ট্রগুলোকে অর্থনৈতিক পলিসি ও ট্যারিফের মাধ্যমে পরোক্ষ শোষণ করে। তবে, গত শতাব্দীতে প্রত্যক্ষ শোষণেরও উদাহরণ ছিল, বিশেষ করে, সাবেক কলোনিয়াল রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে। অর্থাৎ, উপনিবেশের শাসকেরা শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করলেও একধরনের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ করে গেছে সাবেক উপনিবেশ দেশগুলোতে, যাতে কলোনিয়াল শক্তিগুলো লাভবান হয়েছে।

উপনিবেশের শাসকেরা শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করলেও, একধরনের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ করে গেছে সাবেক উপনিবেশ দেশগুলোতে, যাতে কলোনিয়াল শক্তিগুলো লাভবান হয়েছে; Image Source: UNCTAD

ডিপেন্ডেন্সি থিওরি অনুসারে, এসব প্রান্তিক দেশ কখনোই উন্নত দেশ হতে পারবে না। কারণ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ফ্রেমওয়ার্ক এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রগুলো প্রান্তিক দেশগুলোকে শোষণ করতে পারে। আলোচনার সুবিধার্থে রাষ্ট্রগুলোকে ফ্রাঙ্ক ভাগ করেছেন চার ভাগে। এগুলো হলো- সেন্টার অব সেন্টার, পেরিফেরি অব সেন্টার, সেন্টার অব পেরিফেরি, পেরিফেরি অব পেরিফেরি। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো হলো সেন্টার অব সেন্টার; কানাডা, চীন, ইতালি, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো হলো পেরিফেরি অব সেন্টার; ভারত, ব্রাজিলের মতো দেশগুলো হলো সেন্টার অব পেরিফেরি, আর বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কার মতো বৈশ্বিক দক্ষিণের অধিকাংশ দেশ আছে পেরিফেরি অব পেরিফেরিতে।

পেরিফেরি অব পেরিফেরিতে থাকা দেশগুলোকে বাকি দেশগুলো শোষণ করে, শোষণ করে নিজেদের অর্থনৈতিক ভিত্তি ঠিক রাখে। এই দেশগুলো উন্নত হয়ে গেলে সেন্টার অব সেন্টারের স্টেটগুলো আর কর্তৃত্বে থাকবে না। আবার, প্রত্যেক অংশের দেশে কিছু ধনী ব্যক্তি থাকে, এরা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখে।

অনেক দিক থেকেই ডিপেন্ডেন্সি থিওরি গুরুত্বপূর্ণ। ডিপেন্ডেন্সি থিওরির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে কীভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলো শোষিত হচ্ছে তার একটি চিত্র উঠে আসে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র আর প্রান্তিক রাষ্ট্রের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কীভাবে টিকিয়ে রাখা হয়, সেটাও উঠে এসেছে। ডিপেন্ডেন্সি থিওরির মাধ্যমে বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার একটি চিত্রও ফুটে ওঠে, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কাঠামোগুলোকে নতুনভাবে দেখার সুযোগ করে দেয়। কেন্দ্রীয় আর প্রান্তিক রাষ্ট্রের একটি নতুন বিভাজনের ধারণাও উত্থান ঘটেছে এর মাধ্যমে।

কেন্দ্রীয় আর প্রান্তিক রাষ্ট্রের একটি নতুন বিভাজনের ধারণাও উত্থান ঘটেছে; Image Source: BRINK News

ডিপেন্ডেন্সি থিওরির একাডেমিক গুরুত্ব থাকলেও এটি অনেকটাই হাইপোথিসিসভিত্তিক ধারণা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ানের মতো অনেক প্রান্তিক রাষ্ট্রই নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে, নিজেদের অবস্থান পোক্ত করেছে শিল্পোন্নত রাষ্ট্র হিসেবে।

আবার, ডিপেন্ডেন্সি থিওরির প্রবক্তাদের অনেকেই মার্ক্সিস্ট ধারণায় উদ্ধুদ্ধ ছিলেন, শোষণ এড়ানোর জন্য তারা প্রান্তিক রাষ্ট্রগুলোকে পরামর্শ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ না করতে। কিন্তু, এর মাধ্যমে কীভাবে একটি দেশ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারবে, তার কোনো ব্যাখ্যা এই অর্থনৈতিক মডেল দিতে পারে না।

This article is written in Bangla about the dependency theory and modernization theory. All the necessary links are hyperlinked inside.
Feature Image: World Food Program USA

Related Articles

Exit mobile version