প্লাস্টিক ব্যাগের অতিরিক্ত ব্যবহারে পরিবেশ যে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, তা কারো কাছেই অজানা নয়। পরিবেশ দূষণের অতি পরিচিত একটি ধ্বংসাত্মক উপাদান হলো এই প্লাস্টিক। ১৯০৭ সালে প্লাস্টিকের আবিষ্কারকে বেশ সানন্দেই স্বাগত জানায় বিশ্ববাসী। ৫০ থেকে ৭০ এর দশকে সীমিত পরিমাণ প্লাস্টিক উৎপাদিত হতো, যা সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যেত। তাই এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে কারো মাথাব্যথা ছিলো না। কিন্তু ৯০-এর দশকে প্লাস্টিকের উৎপাদন এবং এর বর্জ্য উভয়ের পরিমাণ তিন গুণেরও বেশি বেড়ে যায়। আর ২০০০ সালের পর থেকে এই দূষণের পরিমাণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দৈনন্দিন কাজে প্লাস্টিকের ব্যবহার আমাদের কাজকে অবশ্যই সহজ করেছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে এর পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় এই আবিষ্কার আমাদের জন্যই অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে প্রতি বছর আমরা ৩০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সৃষ্টি করছি, যা পুরো মানবজাতির ওজনের প্রায় সমান। গবেষকদের মতে, ৫০-এর দশক থেকে আজ পর্যন্ত ৮.৩ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয় যার ৬০%-এর স্থান হয় বিভিন্ন জলাশয়ে কিংবা মাটির সাথে। অথবা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় এসব প্লাস্টিক বর্জ্য। এত ক্ষতির পরও প্রয়োজনের তাগিদে এর ব্যবহার একেবারে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আবার আমরা এমন এক সময়ে চলে এসেছি, যেখানে চাইলেও হঠাৎ করে এর উৎপাদনে বাঁধাধরা নিয়ম জুড়ে দিয়ে একেবারে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
তবে এর সমতুল্য, কিন্তু ক্ষতিকারক নয়- এমন কিছু আবিষ্কার করলে ক্ষতির মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। প্লাস্টিকের বিপরীতে পরিবেশ-বান্ধব প্লাস্টিক তৈরিতে বিশ্বজুড়েই কাজ চলছে। বিভিন্ন জৈব উপাদানের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হচ্ছে এমন প্লাস্টিক ব্যাগ, যা মাটিতে বা পানিতে সহজেই মিশে যেতে পারে। বাংলাদেশের পাট দিয়ে তৈরী সোনালি ব্যাগও এরকমই একটি জৈবিক প্লাস্টিক ব্যাগ। সম্প্রতি এমন এক প্লাস্টিক ব্যাগ প্রস্তুত করা হয়েছে, যা পানিতেই গলে মিশে যাবে তথা দ্রবীভূত হবে। তাছাড়া মিশে যাওয়ার পরও তা কোনো বিষাক্ত পদার্থের সৃষ্টি করবে না কিংবা কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। যুগান্তকারী এই প্লাস্টিক ব্যাগের নাম হলো ‘সল্যুব্যাগ’।
পরিবেশ দূষণ প্রতিহত করার তাগিদে চিলির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রাজধানী সান্তিয়াগোর দুইজন গবেষক এই সল্যুব্যাগ তৈরি করেন। এরা হলেন- রবার্টো অ্যাস্তেত এবং ক্রিশ্চিয়ান অলিভারস।
রবার্টো এবং ক্রিশ্চিয়ান হলেন শিল্প-প্রকৌশলী। এই প্রক্রিয়া সম্ভব হয়, যখন তারা এমন একটি দ্রব্য প্রস্তুত করেন যা বিরূপ কোনো প্রতিক্রিয়া ছাড়াই সহজে পানিতে মিশতে সক্ষম। দীর্ঘ চার বছরের গবেষণার পর তৈরিকৃত দ্রব্যটি প্লাস্টিক ব্যাগের জন্য মূলত প্রস্তুত করা না হলেও তা পরবর্তী সময়ে এই কাজে ব্যবহৃত হয়। কারণ এর মাধ্যমে তেল জাতীয় যৌগ ছাড়া প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরি করা সম্ভব। তেল জাতীয় উপাদান থাকার কারণেই প্রচলিত প্লাস্টিক ব্যাগ পানি বা মাটিতে বছরের পর বছর অক্ষত অবস্থায় থাকে।
আর এজন্যই সল্যুব্যাগ পরিবেশ-বান্ধব। মূলত একটি বায়োডিগ্রেডেবল ডিটারজেন্ট তৈরি করতে গিয়ে তারা লক্ষ করেন যে, এর কাঁচামাল বা মূল উপাদানটি প্লাস্টিকের বর্জ্য নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক হতে পারে। অর্থাৎ কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই উদ্ভাবিত হয়ে যায় পানিতে সহজেই দ্রবীভূত হতে পারে এমন প্লাস্টিকের প্রধান কাঁচামাল। এই মূল উপাদানটির নাম হলো পলিভিনাইল অ্যালকোহল (পিভিএ)। মূলত প্লাস্টিকের তেল জাতীয় উপাদানকে সরিয়ে দিয়ে পানিতে দ্রবণীয় উপাদানের সংযোগ ঘটানো হয় এই ক্ষেত্রে।
সল্যুব্যাগ তৈরি হয় পলিভিনাইল অ্যালকোহল (পিভিএ) দিয়ে। এটা এমন একটি উপাদান, যা পানিতে দ্রবণীয়। এটি মোটেও বিষাক্ত নয় এবং পরিবেশ দূষণ করার মতো কোনো পদার্থও নয়। পিভিএ সাধারণত ঔষধশিল্পে এবং খাদ্যশিল্পে কোটিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়। এই পলিভিনাইল অ্যালকোহল পরিবেশ এবং প্রাণীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর না হওয়ার কারণ হলো এটি দ্রবীভূত হওয়ার পর শুধুমাত্র কার্বন থাকে, যা কোনোপ্রকার নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না।
রবার্টোর মতে, “এটি হলো রুটি বানানোর মতো। রুটি বানাতে আটা এবং সাথে আরো কিছু উপাদান লাগে। আর আমাদের আটা (মূল উপাদান) হলো পলিভিনাইল অ্যালকোহল। তাছাড়া আরো কিছু উপাদান ব্যবহৃত হয়। আর এসকল উপাদান ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) দ্বারা স্বীকৃত”। অতএব উপাদানগুলো স্বাস্থ্যসম্মত। সাধারণত প্রচলিত প্লাস্টিক ব্যাগগুলোকে পেট্রোলিয়ামের বিভিন্ন যৌগ দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। যা মাটি বা পানি মাধ্যমে যাওয়ার পরও অক্ষত অবস্থায় থাকে। হিসাব করে দেখা গেছে যে, প্রচলিত প্লাস্টিক পরিবেশে মিশে যেতে সময় লাগে ৫০০ বছরেরও বেশি। মিশে গেলে আবার নতুন করে সমস্যা সৃষ্টি করে এই প্লাস্টিক। আর তা হলো বিষাক্ত পদার্থের বিস্তার।
এর ফলে আমাদেরকে যেমন বিভিন্ন জটিল রোগের স্বীকার হতে হয়, তেমন অন্যান্য প্রাণিও ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সল্যুব্যাগ সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট সময় নেয় পানির সাথে মিশে যাওয়ার ক্ষেত্রে। এটি এর বিশেষ একটি সুবিধা। আর এই পদার্থ পানিতে মিশলেও ঐ পানি পান করার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে না। রবার্টোর মতে, তাদের উদ্দেশ্যই ছিল এমন কোনো জিনিস তৈরি করা, যা পরিবেশকে দূষিত করবে না। তাই তারা এই ব্যাগ তৈরিতে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট এবং প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করেন।
অলিভারস বলেন যে, সল্যুব্যাগ ব্যবহার করলে কাউকে প্রাকৃতিক নিয়মে প্লাস্টিক দ্রবীভূত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। এই সল্যুব্যাগ যেকোনো সময় পানিতে মিশিয়ে ফেলা সম্ভব। ব্যাপারটা এরকম না যে এসব ব্যাগ সংগ্রহ করে খুব বেশি প্রস্তুতি নিয়ে কিংবা টাকা খরচ করে এই কাজ করতে হবে। খুব সহজেই এবং কম সময়ে এই কাজ শেষ করা সম্ভব। সহজে দ্রবণীয় হলেও এটি এমনভাবে তৈরী, যাতে করে এটি বৃষ্টি এবং ৪০-৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রায়ও টিকে থাকতে পারে।
মূলত দু’ ধরনের সল্যুব্যাগ রয়েছে। একটি হলো- সুপারমার্কেটের প্রচলিত প্লাস্টিক ব্যাগের সমতুল্য ব্যাগ, যা ঠাণ্ডা পানিতে দ্রবণীয়। এই ধরণের প্লাস্টিক ব্যাগকে ঠাণ্ডা পানিতে কিছুক্ষণ নাড়লে পাঁচ মিনিটও সময় লাগে না পানিতে গলে যেতে। আর অন্যটি হলো গরম পানিতে দ্রবণীয়। এ ধরনের সল্যুব্যাগ পুনর্ব্যবহারযোগ্য ক্যানভাস ব্যাগের মতোই এবং এসব ব্যাগ ক্যানভাস ব্যাগের মতো মজবুত এবং টেকসই বটে। তাই একে দ্রবীভূত করতে গরম পানির প্রয়োজন হয়। তাছাড়া এই ব্যাগ ঠাণ্ডা পানিতে দ্রবণীয় ব্যাগের তুলনায় বেশি সময় নেয়।
দু’ ধরনের ব্যাগই আমজনতার ব্যবহারের উপযোগী। অবশ্য এখনো এসব ব্যাগ সকলের কাছে উন্মুক্ত করা হয়নি। সল্যুব্যাগ প্রস্তুতকারী চিলির কোম্পানিটি এখনো চিলি, ভারত এবং চীনের বাজারে এটি পরীক্ষা করে দেখছে। তবে এ বছরের মধ্যেই চিলি, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এই ব্যাগ প্রচলনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সম্ভাব্য মাস হলো অক্টোবর। বর্তমানে কোম্পানিটি সল্যুব্যাগের কাঁচামাল আরো নির্ভরযোগ্য এবং উন্নত করতে ব্যস্ত। শুধু বায়োপ্লাস্টিক ব্যাগ তৈরিতেই সীমাবদ্ধ না থেকে কোম্পানিটি বায়োপ্লাস্টিক বোতল এবং স্ট্র তৈরির চেষ্টাও চালাচ্ছে।
ব্যাগগুলো যেহেতু প্রথমবার চিলিতে ডিজাইন এবং উৎপাদন করা হয়, সেহেতু এই অনন্য প্রযুক্তিকে পেটেন্ট করে নেওয়া হয়েছে। অবশ্য ব্যাগ তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদানটি দিয়ে অন্য কিছু তৈরি করার ক্ষেত্রে কোনো পেটেন্ট করা হয়নি। শুরুর দিকে সল্যুব্যাগের মূল্য বেশি হলেও তা বর্তমানে প্রাথমিক মূল্যের পাঁচভাগের একভাগ। এতে করে এসব ব্যাগ সাধারণ জনগণের সামর্থ্যের আওতায় চলে এসেছে। উৎপাদন প্রক্রিয়ার উন্নতির ফলেই তা সম্ভব হয়েছে।
সল্যুব্যাগ ইতোমধ্যে ‘সিঙ্গুলারিটি ইউ অ্যাওয়ার্ড অব চিলি সামিট ২০১৮’ পেয়েছে। কারণ এই সল্যুব্যাগ প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে, বিশেষ করে চিলির ক্ষেত্রে। আবিষ্কারের কাজটা সেরে ফেলা হয়ে গেলেও এখন মূল চ্যালেঞ্জ হলো বাজারে এর প্রচলন সঠিকভাবে পরিচালনা করা এবং ভোক্তাদের সল্যুব্যাগ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা। অবশ্য এই যাত্রা চিলি ভালোমতোই চালিয়ে যাবে বলে আশা করা যায়। লাতিন আমেরিকার মধ্যে চিলির অর্থনীতি বেশ শক্তিশালী এবং এই দেশ পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান আরো দৃঢ় করার লক্ষ্যে কাজ করছে।
দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে এটিই প্রথম দেশ, যা নিজের দেশে প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। পরিবেশ দূষণ রোধে বেশকিছু সমাধানের ব্যবস্থাও রয়েছে, যেমন- কম্পোস্ট্যাবল ব্যাগ। তবে সমস্যা হলো এসব ব্যাগ কম্পোস্ট করার জন্য চিলিতে কোনো বিন বা পাত্র নেই। অবশ্য আরো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন এই দেশটি। তবে সল্যুব্যাগ যে সবচাইতে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।