২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যেকার সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটেছে এবং রুশ–মার্কিন সম্পর্কে নানাবিধ নতুন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। তদুপরি, এই যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে বেশ কিছু প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্বের ক্ষেত্র সৃষ্টির সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে। এরকম একটি ক্ষেত্র হচ্ছে ভূখণ্ডগত বিরোধ। রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর পর মার্কিন প্রচারমাধ্যম আর্কটিক মহাসাগরে অবস্থিত একটি সুবৃহৎ রুশ দ্বীপকে ‘মার্কিন ভূখণ্ড’ হিসেবে দাবি করেছে। মার্কিনিরা রুশ ভূখণ্ডের ওপর মালিকানা দাবি করছে, এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিরাট ঘটনা। কিন্তু যে কারণেই হোক, ঘটনাটি বৈশ্বিক প্রচারমাধ্যমে সেরকম কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। উক্ত দ্বীপটির নাম হচ্ছে ‘ভ্রাঙ্গেল দ্বীপ’ (রুশ: Остров Врангеля, ‘অস্ত্রাভ ভ্রাঙ্গেলিয়া’) এবং এই দ্বীপের মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধ ভবিষ্যতে রুশ–মার্কিন সম্পর্কে গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের ভৌগোলিক পরিচিতি
ভ্রাঙ্গেল দ্বীপ আর্কটিক মহাসাগরে অবস্থিত এবং পূর্ব সাইবেরীয় সাগর ও চুকচি সাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত। দ্বীপটি পশ্চিম ও পূর্ব গোলার্ধের সীমান্ত বরাবর অবস্থিত এবং ১৮০° দ্রাঘিমারেখা দ্বীপটিকে প্রায় সমান দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। দ্বীপটির আয়তন ৭,৬৭০ বর্গ কিলোমিটার, কিন্তু দ্বীপটিতে একজনও স্থায়ী অধিবাসী নেই। প্রশাসনিকভাবে, দ্বীপটি রাশিয়ার চুকোৎকা স্বায়ত্তশাসিত জেলার অন্তর্ভুক্ত ইউলতিনস্কি জেলার অন্তর্গত। বাল্টিক জার্মান বংশোদ্ভূত রুশ রাষ্ট্রনায়ক, সমরনায়ক, নাবিক ও মেরু অভিযাত্রী অ্যাডমিরাল ব্যারন ফের্দিনান্দ ভ্রাঙ্গেলের নামানুসারে দ্বীপটির নামকরণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, অ্যাডমিরাল ভ্রাঙ্গেল ছিলেন ‘রাশান জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ‘রাশান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস’–এর সদস্য ও ‘রাশান–আমেরিকান কোম্পানি’র প্রধান ব্যবস্থাপক, এবং তিনি ‘রুশ আমেরিকা’র গভর্নর এবং রুশ নৌবাহিনী বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১৭০৭ সালে রুশ অভিযাত্রী ইভান লভোভ প্রথমবারের মতো দ্বীপটিকে মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করেন। পরবর্তীতে প্রখ্যাত রুশ লেখক ও বৈজ্ঞানিক মিখাইল লোমানোসাভ দ্বীপটির নামকরণ করেন ‘সামনিতেলনি’ (‘অনিশ্চিত’) এবং একে মেরু অঞ্চলের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৭৬৪ সালে কসাক সম্প্রদায়ভুক্ত রুশ সার্জেন্ট স্তেপান আন্দ্রেইয়েভ দূর থেকে দ্বীপটিকে পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি জানতে পারেন যে, দ্বীপটিতে বেশ কিছু মানুষ বসবাস করে, এবং তারা এর নামকরণ করেছে ‘তিকেগেন’।
১৮২০–এর দশকে অ্যাডমিরাল ভ্রাঙ্গেল দ্বীপটিতে পৌঁছানোর জন্য কয়েকটি অভিযান প্রেরণ করেন, কিন্তু সেগুলো ব্যর্থ হয়। অবশ্য উক্ত অভিযাত্রীরা দ্বীপটির অধিবাসীদের সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। তাদের বিবরণ অনুসারে, দ্বীপটির অধিবাসীরা দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। শারীরিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে, তাদের একাংশকে রুশ বংশোদ্ভূত এবং অপর অংশকে চুকচি বংশোদ্ভূত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ ‘এইচএমএস হেরাল্ড’–এর কাপ্তান হেনরি কেলেট ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের নিকটবর্তী একটি দ্বীপে অবতরণ করেন এবং দ্বীপটির নামকরণ করেন ‘হেরাল্ড দ্বীপ’ (রুশ ভাষায় ‘গেরালদ দ্বীপ’)। কেলেট দূর থেকে ভ্রাঙ্গেল দ্বীপ দেখতে পেয়েছিলেন, কিন্তু দ্বীপটিতে অবতরণ করেননি। ব্রিটিশ মানচিত্রে দ্বীপটিকে ‘কেলেট ল্যান্ড’ নামে চিহ্নিত করা হয়।
১৮৬৬ সালে জার্মান তিমি শিকারী, ব্যবসায়ী ও অভিযাত্রী এডওয়ার্ড ডালম্যান ভ্রাঙ্গেল দ্বীপে অবতরণ করেন। তিনি ছিলেন দ্বীপটিতে অবতরণকারী প্রথম ইউরোপীয়। ১৮৬৭ সালে মার্কিন তিমি শিকারী ও অভিযাত্রী থমাস লং দূর থেকে দ্বীপটিকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং অ্যাডমিরাল ভ্রাঙ্গেলের সম্মানার্থে দ্বীপটির নামকরণ করেন ‘ভ্রাঙ্গেল দ্বীপ’। অবশ্য প্রতীয়মান হয় যে, ব্রিটিশরা যে ইতিপূর্বেই দ্বীপটিকে ‘কেলেট ল্যান্ড’ নামকরণ করেছে, এটি সেসময় লংয়ের জানা ছিল না, কিংবা তিনি দ্বীপটিকে ‘কেলেট ল্যান্ড’ নয়, বরং নতুন একটি দ্বীপ মনে করেছিলেন।
১৮৮১ সালের ১২ আগস্ট মার্কিন জাহাজ ‘করউইন’–এর কাপ্তান ও আলাস্কার তদানীন্তন শাসক কেলভিন হুপারের নেতৃত্বে একটি অভিযাত্রী দল দ্বীপটিতে অবতরণ করে, দ্বীপটিকে মার্কিন ভূখণ্ড ঘোষণা করে এবং এটিকে ‘নিউ কলম্বিয়া’ নামকরণ করে। উল্লেখ্য, সেসময় দ্বীপটিতে কোনো স্থায়ী অধিবাসী ছিল না। কিন্তু মার্কিন সরকার দ্বীপটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কোনো প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি এবং দ্বীপটিতে কোনো স্থায়ী বসতি স্থাপিত হয়নি। এদিকে ১৯১১ সালের সেপ্টেম্বরে রুশ হাইড্রোগ্রাফার ও জরিপকারী বারিস ভিলকিৎস্কির নেতৃত্বে রুশ আইসব্রেকার ‘ভায়গাচ’ ও ‘তায়মির’–এর ক্রুরা দ্বীপটিতে অবতরণ করে এবং সেখানে রুশ পতাকা উত্তোলন করে।
১৯১৪ সালে ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের সন্নিকটে কানাডীয় জাহাজ ‘কারলুক’ দুর্ঘটনা–কবলিত হয় এবং জাহাজটিতে থাকা একদল মেরু অভিযাত্রী দ্বীপটিতে আশ্রয় নেন। তারা প্রায় ৯ মাস ভ্রাঙ্গেল দ্বীপে আটকা থাকার পর মার্কিন জাহাজ ‘কিং অ্যান্ড উইঞ্জ’ তাদেরকে উদ্ধার করে। ইতোমধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায় এবং বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯১৬ সালে রুশ সরকার ভ্রাঙ্গেল দ্বীপকে আনুষ্ঠানিকভাবে রুশ ভূখণ্ড হিসেবে ঘোষণা করে। সেসময় যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডা রুশ সরকারের এই ঘোষণার প্রতি বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
১৯২১ সালের আগস্টে রুশ গৃহযুদ্ধ চলাকালে কানাডীয় মেরু অভিযাত্রী ও জাতিতাত্ত্বিক ভিলহেলমুর স্টেফানসন ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের ওপর কানাডার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন এবং এই উদ্দেশ্যে পাঁচজন অভিযাত্রীকে ভ্রাঙ্গেল দ্বীপে প্রেরণ করেন। উল্লেখ্য, রুশ গৃহযুদ্ধে কানাডা সোভিয়েত রুশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এবং গৃহযুদ্ধ নিয়ে সোভিয়েত রুশদের ব্যতিব্যস্ততার সুযোগকেই কানাডীয়রা কাজে লাগিয়েছিল। সেপ্টেম্বরে কানাডীয় অভিযাত্রীরা ভ্রাঙ্গেল দ্বীপে পৌঁছে সেখানে একটি ‘উপনিবেশ’ স্থাপন করে এবং কানাডীয় ও ব্রিটিশ পতাকা উত্তোলন করে। কিন্তু এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে, মার্কিনিরা দ্বীপটি আবিষ্কার করেছে এবং সেই সূত্রে এটি মার্কিন ভূখণ্ড। এদিকে দ্বীপটির প্রতিকূল পরিবেশে স্টেফানসন কর্তৃক প্রেরিত পাঁচজন অভিযাত্রীর মধ্যে চারজন মৃত্যুবরণ করে, কিন্তু এই সংবাদ দ্বীপটির বাইরে পৌঁছায়নি।
১৯২৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রাঙ্গেল দ্বীপে কানাডীয় অভিযাত্রীদের অবতরণকে ‘বেআইনি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং ব্রিটেন ও কানাডার নিকট এর প্রতিবাদ জানায়, কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। ১৯২৩ সালের আগস্টে আরেকটি কানাডীয় জাহাজ দ্বীপটিতে পৌঁছে এবং জীবিত অভিযাত্রীকে উদ্ধার করে। একই সময়ে দ্বীপটিতে ১৩ জন নতুন ‘উপনিবেশ স্থাপনকারী’কে রেখে যাওয়া হয়। এদের মধ্যে একজন ছিলেন মার্কিন শিকারী চার্লস ওয়েলস এবং বাকিরা ছিলেন এস্কিমো জাতিভুক্ত। তারা দ্বীপটিতে থাকা অবস্থায় একটি শিশুর জন্ম হয়, সুতরাং ১৯২৪ সাল নাগাদ দ্বীপটির অধিবাসী ছিল ১৪ জন।
১৯২৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং কর্নেল বারিস দাভিদাভের নেতৃত্বাধীনে সোভিয়েত গানবোট ‘ক্রাসনি অক্তিয়াবর’কে (‘রেড অক্টোবর’) দ্বীপটি পুনর্দখলের জন্য প্রেরণ করে। আগস্টে সোভিয়েতরা দ্বীপটিতে পৌঁছে সেখানে সোভিয়েত পতাকা উত্তোলন করে এবং দ্বীপটিতে অবস্থানরত ‘কানাডীয়’দেরকে দ্বীপটি থেকে অপসারণ করে ভ্লাদিভাস্তকে প্রেরণ করে। বস্তুত এই ‘কানাডীয়’ দলটিতে একজনও কানাডীয় নাগরিক ছিল না। ‘কানাডীয়’ দলটির নেতা ওয়েলস ছিলেন মার্কিন নাগরিক এবং দলটির বাকিরা ছিল জাতিগত এস্কিমো, যাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র ‘নাগরিক’ হিসেবে বিবেচনা করত না।
সেসময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক বলপূর্বক ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি মার্কিন–সোভিয়েত সম্পর্কে নতুন করে তিক্ততার সৃষ্টি করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের উদ্দেশ্যে ‘ক্রাসনি অক্তিয়াবর’কে প্রেরণ করার পর পরই যুক্তরাষ্ট্র দ্বীপটিতে মার্কিন পতাকা উত্তোলন ও দ্বীপটির ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করার উদ্দেশ্যে একটি জাহাজ প্রেরণ করে, কিন্তু জাহাজটি সমুদ্রের বরফ ভেঙে ভ্রাঙ্গেল দ্বীপ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। এদিকে ভ্লাদিভাস্তকে অবস্থানকালে ওয়েলস ও একটি এস্কিমো শিশুর মৃত্যু হয় এবং এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অবশিষ্ট এস্কিমোদেরকে চীনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত পাঠানো হয়।
ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের ওপর সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হওয়ার অব্যবহিত পরে ব্রিটেন সোভিয়েত ইউনিয়নকে জানিয়ে দেয় যে, ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের ওপর তাদের কোনো দাবি নেই। ১৯২৬ সালে সোভিয়েত সরকার দ্বীপটির ওপর স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সেখানে একটি গ্রাম ও একটি আবহাওয়া কেন্দ্র স্থাপন করে। পরবর্তীতে সোভিয়েতরা দ্বীপটিতে মানব বসতি আরো বিস্তৃত করে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রাক্কালে দ্বীপটির অধিবাসীর সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থেকে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দ্বীপটি সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত হয়।
স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে কিছু কিছু মার্কিন সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক কর্মী ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের ওপর মার্কিন মালিকানা দাবি করার জন্য মার্কিন সরকারকে আহ্বান জানায়, কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে মার্কিন সরকার এরকম ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিল না। ১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে তাদের পারস্পরিক সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, এবং এই চুক্তি অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের ওপর সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণকে পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেয়। কিন্তু এই চুক্তিটি নিয়ে রাশিয়ায় ও যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় নানা ধরনের বিতর্ক রয়েছে এবং রুশ আইনসভা এখন পর্যন্ত চুক্তিটি অনুমোদন করেনি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে একটি সমঝোতা অনুসারে উভয়েই এখন পর্যন্ত চুক্তিটির শর্তাবলি মেনে চলছে।
ভ্রাঙ্গেল দ্বীপ সংক্রান্ত নতুন রুশ–মার্কিন বিরোধ
মার্কিন সরকার এখন পর্যন্ত ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের ওপর মার্কিন মালিকানা দাবি করেনি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা প্রদেশের বেশকিছু রাজনৈতিক কর্মী ও প্রচারমাধ্যম বহুদিন থেকেই দাবি করে আসছে যে, দ্বীপটির ওপর আলাস্কান (অর্থাৎ মার্কিন) মালিকানা থাকা উচিত। রাশিয়া সাধারণভাবে এই ধরনের বক্তব্যগুলোর সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে বিরত থেকেছে। কিন্তু রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সালের ৪ নভেম্বর প্রভাবশালী মার্কিন পত্রিকা ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে’ মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন কর্মকর্তা ও ‘ইউনাইটেড স্টেটস আর্কটিক রিসার্চ কমিশনে’র একজন প্রাক্তন কমিশনার থমাস ইমানুয়েল ডান্স কর্তৃক লিখিত একটি ‘বিস্ফোরক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। উক্ত নিবন্ধে তিনি দাবি করেন যে, ভ্রাঙ্গেল দ্বীপ প্রকৃতপক্ষে মার্কিন ভূখণ্ড এবং ১৯২৪ সালে সোভিয়েতরা বলপূর্বক দ্বীপটি দখল করে নিয়েছিল। ডান্সের মতে, এটি হচ্ছে মার্কিন ইতিহাসের একমাত্র ঘটনা যখন যুক্তরাষ্ট্র কোনো ‘শত্রুভাবাপন্ন’ রাষ্ট্রের কাছে নিজস্ব ভূখণ্ড সমর্পণ করেছিল এবং এখন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত দ্বীপটি রাশিয়ার কাছ থেকে অধিকার করে নেয়া। পরবর্তীতে অন্যান্য মার্কিন প্রচারমাধ্যম ডান্সের বক্তব্যের সমর্থনে প্রচারণা চালায়।
মার্কিন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ডান্সের বক্তব্যকে সমর্থন করেনি। কিন্তু ডান্স মার্কিন সরকারের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা ছিলেন এবং তার নিবন্ধটি একটি প্রভাবশালী মার্কিন পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার রুশ সরকার ধরে নেয় যে, মার্কিন সরকার ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের মালিকানা নিয়ে একটি নতুন সমস্যা সৃষ্টি করতে চাচ্ছে এবং ডান্সের কার্যক্রমের পশ্চাতে মার্কিন সরকারের মৌন সমর্থন রয়েছে। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য অনুসারে, ডান্সের বক্তব্য ইতিহাসকে বিকৃত করার একটি প্রচেষ্টা এবং এর পরিণতি ভালো হবে না। রুশ আইনসভার নিম্নকক্ষ ‘রাষ্ট্রীয় দুমা’র সদস্য ফিদোত তুমুসাভের ভাষ্যমতে, ভ্রাঙ্গেল দ্বীপ রুশ ভূখণ্ড এবং রুশ সংবিধান অনুসারে রুশ সরকার রাশিয়ার এক বর্গমিটার ভূখণ্ডও অন্য কোনো রাষ্ট্রের নিকট হস্তান্তর করতে পারবে না, সুতরাং ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের ওপর মার্কিন মালিকানার দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। শুধু তা-ই নয়, তুমুসাভ পাল্টা দাবি করেন যে, আলাস্কা প্রকৃতপক্ষে রুশ ভূখণ্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সেটি রাশিয়াকে ফিরিয়ে দেয়া!
অর্থাৎ, এটি স্পষ্ট যে, ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের ওপর মার্কিন মালিকানা দাবির সম্ভাবনাটিকে রুশ সরকার মোটেই ভালোভাবে নেয়নি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বা কেন হঠাৎ করে এই সময়ে এসে ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের মালিকানা দাবির জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে? এর পশ্চাতে রয়েছে রুশ–মার্কিন দ্বন্দ্বের বর্তমান অবস্থা এবং আর্কটিক অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের জন্য বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে বিরোধ।
প্রথমত, রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর পর মার্কিন–নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার দ্বন্দ্বের মাত্রা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র খোলাখুলিভাবে রাশিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো টুকরো টুকরো করে ফেলার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছে। মার্কিন ও পশ্চিমা বিশ্লেষকরা বর্তমান রাশিয়াকে ভেঙে প্রাক্তন রুশ ভূখণ্ডে কী কী নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হতে পারে সে বিষয়ক নানাবিধ জল্পনাকল্পনা করছেন। এমতাবস্থায় ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের ওপর মার্কিন মালিকানা দাবির প্রসঙ্গটি রাশিয়াকে খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলার পশ্চিমা পরিকল্পনারই একটি অংশ হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে উত্তর মেরুর বরফ গলে যাচ্ছে এবং এর ফলে আর্কটিক মহাসাগর দিয়ে জাহাজ চলাচল, উত্তর মেরুর ভূগর্ভস্থ খনিজ সম্পদ উত্তোলন ও এতদঞ্চলে সামরিক–কৌশলগত স্থাপনা নির্মাণের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় উত্তর মেরুতে প্রভাব বিস্তারের জন্য বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয়েই আর্কটিক রাষ্ট্র এবং অবশিষ্ট আর্কটিক রাষ্ট্রগুলোর সিংহভাগ (যেমন: কানাডা, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড প্রভৃতি) যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র। এমতাবস্থায় আর্কটিক অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য মূল প্রতিযোগিতাটি সংঘটিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো এবং রাশিয়ার মধ্যে।
রাশিয়া আর্কটিক মহাসাগরে ‘উত্তরাঞ্চলীয় সমুদ্রপথ’ (Northern Sea Route) সৃষ্টির প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবং এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে জলপথে যোগাযোগের জন্য সুয়েজ খালের একটি বিকল্প সৃষ্টি হবে। এর ফলে রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হবে এবং রাশিয়ার কৌশলগত গুরুত্ব উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে এই ভূরাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করতে দিতে মোটেই আগ্রহী নয়। আর্কটিক অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং আর্কটিকে রুশ প্রভাব খর্ব করে নিজস্ব প্রভাব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের ওপর নিজস্ব কর্তৃত্ব স্থাপন করতে ইচ্ছুক।
তৃতীয়ত, চীন আর্কটিক রাষ্ট্র নয়, কিন্তু রুশ–চীনা সুসম্পর্ক ও চীনের বিপুল অর্থনৈতিক–প্রযুক্তিগত সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে আর্কটিকে রুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে চীনা প্রভাব বিস্তারের বড় ধরনের সুযোগ থাকবে। চীনা–মার্কিন ভূরাজনৈতিক ও ভূ–অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র আর্কটিক অঞ্চলে চীনা প্রভাব বিস্তার প্রতিহত করতে ইচ্ছুক এবং এজন্য আর্কটিকে রুশ প্রভাব সীমিত রাখার উদ্দেশ্যে ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের ওপর তারা নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে আগ্রহী।
সর্বোপরি, ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া উপদ্বীপ অধিকার করেছে এবং রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ চলাকালে রাশিয়া লুগানস্ক, দনেৎস্ক, জাপোরোঝিয়ে ও খেরসন অঞ্চলকে নিজস্ব ভূখণ্ড হিসেবে ঘোষণা করেছে। উক্ত ভূখণ্ডগুলো আন্তর্জাতিকভাবে ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃত। সুতরাং এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে রাশিয়া রাষ্ট্রগুলোর ভৌগোলিক অখণ্ডতা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার এই পদক্ষেপগুলোকে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পূর্ণ ভূখণ্ড পুনর্দখলের রুশ প্রচেষ্টার একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। সুতরাং ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের ওপর মার্কিন মালিকানা দাবির বিষয়টি তুলে ধরে মার্কিনিরা রাশিয়াকে এই ইঙ্গিত দিতে চাচ্ছে যে, রুশ সম্প্রসারণের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রুশ ভূখণ্ডে নিজেরা সম্প্রসারণ করার পাল্টা উদ্যোগ নিতে পারে।
সামগ্রিকভাবে, ভ্রাঙ্গেল দ্বীপের ওপর মার্কিন মালিকানা দাবির বিষয়টি আলোচনায় আনার মধ্য দিয়ে মার্কিনিরা একটি ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ উন্মুক্ত করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম দুইটি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে ভূখণ্ডগত বিরোধ নিকট ভবিষ্যতে রাষ্ট্র দুইটির নিজস্ব জাতীয় নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার প্রতি মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করতে পারে, এই সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।