দ্য গ্রেট ফায়ারওয়াল: চীন যেভাবে ইন্টারনেটজগত নিয়ন্ত্রণ করছে (শেষ পর্ব)

[১ম পর্ব পড়ুন]

চীনের ইন্টারনেটের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৮৭ সালে। আমেরিকায় প্রথম ই-মেইল আদান-প্রদানের ঘটনা ঘটে ১৯৭১ সালে। এর ঠিল ষোল বছর পর চীন প্রথমবারের মতো তাদের ইতিহাসে ই-মেইল আদানপ্রদান করে। চীনের একটি ল্যাবরেটরি থেকে প্রফেসর কিয়ান তিয়ানবাই জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ই-মেইল প্রেরণ করেন, যাতে তিনি লিখেছিলেন, “গ্রেট ওয়ালের মাধ্যমে আমরা পৌঁছে যেতে পারি পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে।” আমেরিকার বেশ পরে হলেও চীনের জন্য এই ঘটনা ছিল দারুণ অনুপ্রেরণামূলক, যেহেতু এই ঐতিহাসিক ঘটনার পরই চীন আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্টারনেটের যুগে প্রবেশ করে। তবে প্রথম কয়েক বছর শুধু চীনা কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের জন্য ইন্টারনেট সুবিধা সীমাবদ্ধ ছিল। তবে তখন ইন্টারনেটের ব্যবহার আজকের মতো এত ব্যাপক ছিল না। মূলত দ্রুতগতির যোগাযোগব্যবস্থার জন্য ইন্টারনেট সুবিধা কাজে লাগানো হতো।

জগগলনলন
ভার্চুয়াল নয়, চীনের আসল ‘গ্রেট ওয়াল’ বাইরের শত্রুদের হাত থেকে চীনকে রক্ষা করার জন্য নির্মিত হয়েছিল; image source: arkeonew.net

১৯৯৫ সালে চীনে প্রথমবারের মতো জনসাধারণের জন্য ইন্টারনেট সেবা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। চীনা জনগণের জন্য এটি ছিল বিশাল সুবিধা, তাই মাত্র এক বছরের মধ্যেই প্রায় দেড় লাখ চীনা নাগরিক ইন্টারনেট সুবিধা গ্রহণ করেছিল। চীনা সরকার ১৯৯৬ সালকে ‘ইয়ার অব দ্য ইন্টারনেট’ ঘোষণা করে। চীনের প্রায় প্রতিটি বড় শহরে অসংখ্য ইন্টারনেট ক্যাফে গড়ে উঠেছিল, যেগুলোতে সবসময় ভীড় লেগে থাকতো। ইন্টারনেট বিপ্লবের প্রথম বছরগুলোতে নিয়ন্ত্রণের জন্য চীনা সরকার খুব বেশি পদক্ষেপ নেয়নি। ১৯৯৭ সালে চীনা সরকার প্রথমবারের মতো চীনের ইন্টারনেট জগত নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন প্রণয়ন করে। ১৯৯৭ সালের সেই আইনে বলা হয়- ইন্টারনেটে যদি কোনো চীনা নাগরিক এমন কিছু প্রকাশ করে যেগুলো চীনের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর, তাহলে তার বিরুদ্ধে এই আইনানুযায়ী শাস্তির বিধান রাখা হয়।

জআজবকন
সময়ের ব্যবধানে চীনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা শুধুই বেড়েছে; image source: statista.com

তবে ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে দুটো ঘটনা চীন সরকারকে আরও অধিকতর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করে। ১৯৯৮ সালে ত্রিশ বছর বয়সী এক চীনা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার প্রায় ত্রিশ হাজার ই-মেইল আমেরিকাভিত্তিক এক ম্যাগাজিনের কাছে হস্তান্তর করেন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার লিন হাইকে গ্রেফতার করা হয় এবং আইনানুযায়ী সাজা প্রদান করা হয়। চীনের ইতিহাসে এটি ছিল প্রথম ঘটনা, যে ঘটনায় একজন ব্যক্তি ভার্চুয়াল কোনো অপরাধের জন্য শাস্তি লাভ করেন। পরের বছর, ১৯৯৯ সালে ‘ফালুন গং’ নামের একটি আধ্যাত্মিক সংগঠন প্রায় দশ হাজার সদস্য নিয়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মৌন মিছিল করে। তারা এই মৌন মিছিল আয়োজনের ক্ষেত্রে সদস্যদের সংগঠিত করার জন্য ই-মেইল ও মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। ফালুন গং সংগঠনটির নেতারা বলেন- তাদেরকে প্রকাশ্যে ধর্মীয় লোকাচার পালন করতে বাধা দেয়ায় তারা মৌন মিছিলের আয়োজন করেছেন। তৎকালীন চীনা সরকার কাছে এই মৌন মিছিল সম্পর্কে ন্যূনতম আভাস আসেনি। সরকার শঙ্কায় পড়ে যায়, হয়তো প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে হয়তো আরও বড় ধরনের আন্দোলন সংঘটিত হতে পারে। তাদের কাছে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি গুরুত্ব নতুন করে অনুভূত হয়।

চীনা সরকার পরিকল্পনা করে- তারা এমন কিছু সফটওয়্যার তৈরি করবে, যেগুলোর মাধ্যমে চীনের পুরো ইন্টারনেট জগতের সমস্ত তথ্যের উপর নজরদারি চালানো যাবে। এই সফটওয়্যারগুলোর সমন্বিত ব্যবস্থার যে প্রকল্প, তার নাম দেয়া হয়েছিল ‘গোল্ডেন শিল্ড’। গোল্ডেন শিল্ড প্রকল্পের পেছনে যে ব্যক্তি প্রধান ভূমিকা পালন করেন, তার নাম ছিল ফ্যাং বিনশিং। গোল্ডেন শিল্ড প্রকল্পের পেছনে তার এই অবদানের জন্য পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টিতে তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করা হয়। ২০০০ সালের পর থেকে তাকে আখ্যায়িত করা হতো ‘ফাদার অব দ্য গ্রেট ফায়ারওয়াল’ হিসেবে। ২০০০ সালের দিকে চীনা সরকার দেশটির ইন্টারনেটের বিশাল জগত নিয়ন্ত্রণ করত প্রযুক্তিবিদ ফ্যাং বিনশিংয়ের গোল্ডেন শিল্ডের মাধ্যমে। সেই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে চীনের স্টেট কাউন্সিল ‘অর্ডার নাম্বার ২৯২’ চালু করে। এই অর্ডারের মাধ্যমে চীনে সক্রিয় সকল ইন্টারনেট সরবরাহ প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় যে- তাদের নেটওয়ার্কের অধীনে যত তথ্য আদান-প্রদান করা হবে, তা যেন চীনের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়, অন্যথায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রাখা হয়।

জবওগপকন
ভিপিএন চিহ্নিত করে সেগুলো নিষিদ্ধ করা হয়েছে চীনে; image source: kaspersky.com

চীনের গোল্ডেন শিল্ড তথা ‘দ্য গ্রেট ফায়ারওয়াল’-এর পরিবর্তন হয়েছে বেশ কয়েকটি ধাপে। প্রথম ধাপের দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে দেখা যাবে চীনের অধিবাসীরা ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করতো। ১৯৯৫ সালের পর থেকে যখন ইন্টারনেট চীনের জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, তখন মোটামুটি কোনো সরকারি নীতিমালা না থাকায় ইচ্ছামতো মতপ্রকাশ করতে পারতেন। চীনের তৎকালীন সরকার কমিউনিস্ট মতাদর্শের বিরোধী যেকোনো তথ্য ইন্টারনেট থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য আইপি অ্যাড্রেস এবং ডোমেইন নেমগুলো ব্লক করতে শুরু করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে দ্য গ্রেট ফায়ারওয়াল তথা গোল্ডেন শিল্ড ‘কি-ওয়ার্ড সেন্সরশিপ’ পদ্ধতি অবলম্বন করতে শুরু করে। এই পদ্ধতিতে চীনের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা যদি এমন কোনো ওয়েবসাইটের প্রবেশ করতো যেটি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চোখে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি, তবে সেই ওয়েবসাইটের স্পর্শকাতর কনটেন্টগুলো নিস্ক্রিয় করে দেয়া হতো, এবং ওয়েবসাইট প্রবেশকারীর কাছে একটি সতর্কবার্তা পাঠানো হতো।

তৃতীয় পর্যায়ে দ্য গ্রেট ফায়ারওয়ালের মাধ্যমে ভিপিএনগুলো (ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) চিহ্নিত করা ও সেগুলোর জন্য যথাযথ আইন প্রণয়ন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে যখন কি-ওয়ার্ড সেন্সরশিপ পদ্ধতির মাধ্যমে স্পর্শকাতর কনটেন্টগুলো সরিয়ে নেয়া হচ্ছিল, তখন চীনা ইন্টারনেটসেবা ব্যবহারকারীরা ভিপিএন ব্যবহার করে সেগুলোতে প্রবেশ করছিলেন। প্রথমদিকে চীনা সরকারের জন্য ভিপিএন ব্যবহার করা ঠেকানো কষ্টসাধ্য হলেও অল্প কয়েক বছরের মধ্যে দ্য গ্রেট ফায়ারওয়ালের ডেভেলপাররা ভিপিএনের দুর্বলতা বের করে ফেলেন। চতুর্থ পর্যায়ে দ্য গ্রেট ফায়ারওয়ালের ডেভেলপাররা সুপারিশ করেন- এমন কিছু আইন প্রণয়ন করা হোক, যার মাধ্যমে যেকোনো ভিপিএন ব্যবহারকারী ও সরবরাহকারীকে যথাযথ শাস্তি দেয়া হবে। ২০১৭ সালের পর থেকে চীনা সরকার বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করে, যার মাধ্যমে ভিপিএন ব্যবহারকারীদের চিহ্নিত করার পর শাস্তি প্রদানের বিধান রাখা হয়েছিল। এছাড়া এই আইনের মাধ্যমে চীনের যত স্মার্টফোন ডিভাইসনির্মাতা প্রতিষ্ঠান আছে, তার সবগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয় তারা যেন তাদের অ্যাপ স্টোর থেকে ভিপিএনের অ্যাপ্লিকেশনগুলো সরিয়ে ফেলে।

জগপগকনলন
দ্য গ্রেট ফায়ারওয়ালের মাধ্যমে নিবিড় নজরদারি চালানো হয়; image source: china-briefing.com

বর্তমানে অসংখ্য ওয়েবসাইট রয়েছে, যেগুলোতে চীনা ইন্টারনেটসেবা ব্যবহারকারীরা প্রবেশ করতে পারেন না। শুধু তা-ই নয়, চীনের বিশাল ইন্টারনেট জগতের উপর প্রতিনিয়ত নজরদারি চালানো হয়। দ্য গ্রেট ফায়ারওয়ালের মাধ্যমে চীনা ইন্টারনেটসেবা ব্যবহারকারীরা কী দেখবেন আর কী দেখবেন না, সেগুলোও নির্ধারণ করে দেয়া হয়। চীনের সরকার মনে করে- জনগণের সামনে পুরো ইন্টারনেট উন্মুক্ত করে দিলে হয়তো তারা পশ্চিমা উদারনীতিবাদের ধারণায় প্রভাবিত হয়ে গণতন্ত্রের দাবিতে একসময় রাস্তায় নেমে আসবে, এবং পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে চীনের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে কমিউনিস্ট পার্টিকে সরিয়ে দিতে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করবে। পৃথিবীর অনেক কমিউনিস্ট দেশেই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা গোপন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সেসব দেশের নাগরিকদের রাজপথে নামিয়ে কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাত করতে সফল হয়েছে। চীনা সরকার মনে করে, বৈশ্বিক পরিমন্ডলে চীনের যে উত্থান, তার পুরো কৃতিত্ব চীনের কমিউনিস্ট পার্টির, এবং গণতন্ত্র থাকলে হয়তো সেটি সম্ভব হতো না। যদি চীনের দিক থেকে দেখা হয়, তাহলে ইন্টারনেট জগত নিয়ন্ত্রণ করা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্বের জন্যই জরুরি।

Related Articles

Exit mobile version