মিশর উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। দেশটি ইতিহাস-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতির জন্যও বেশ পরিচিত। মিশরে রয়েছে হাজার বছর পুরনো সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ, যেগুলো দেখলে সহজেই অনুমান করা যায় একসময় কতটা উন্নত নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেখানে।
নীল নদের তীরে অবস্থিত এই দেশটি যুগে যুগে তার অগ্রযাত্রার ধারা অব্যহত রেখেছে। অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় মধ্যম আয়ের দেশটির শিক্ষা ব্যবস্থাও বেশ উন্নত। মিশরে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ধর্মীয় জ্ঞানের চর্চা অব্যহত রয়েছে। কালের পরিক্রমায় মিশরের শাসক পরিবর্তিত হলেও প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রত্যেক শাসকগোষ্ঠীই আল-আজহারের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন বলেই সাধারণ একটি মসজিদ আজ বিশ্বের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে।
গোড়াপত্তন
হযরত মুহাম্মদ (সা) ইসলাম ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি একটি সুসংঠিত ইসলামী সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন, যা তাঁর পরবর্তী চার খলিফার সময়ে পারস্য ছাড়িয়ে জেরুজালেম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। এরপর বৃহৎ ইসলামি সাম্রাজ্যে বেশ কয়েকটি বিভাজন দেখা দেয়, যারা তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
এসবের মাঝে উল্লেখযোগ্য দুটি শাসন ব্যবস্থা ছিলো আব্বাসীয় খিলাফত ও ফাতেমি খিলাফত। ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খিলাফতের কাছ থেকে ফাতেমি খিলাফতের শাসক আল-মুইজ-লি-দ্বীন মিশর জয় করে নেন। এরপরই মিশরকে ফাতেমি খিলাফতের রাজধানী করা হয়।
ফাতেমি খিলাফতের রাজধানী হওয়ার পর পরই মিশরকে ঢেলে সাজানো হয়। নতুন রাজধানী নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় ফাতেমি সেনানায়ক জাওহর সিসিলিকে। তিনি আব্বাসীয় আমলের মিশরকে সংস্কার করে গড়ে তোলেন ফাতেমি খিলাফতের প্রশাসনিক কার্যালয়, নির্মাণ করেন নান্দনিক অট্টালিকা ও বিভিন্ন স্থাপত্য। শহরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় আল-কাইরো (Cairo)।
জাওহর সিসিলি নগর পরিকল্পনায় বিশেষভাবে একটি মসজিদের ডিজাইন যুক্ত করেন। তার পরিকল্পনানুসারেই গড়ে ওঠে ফাতেমি প্রশাসনের কেন্দ্রীয় মসজিদ জামিউল-কাইরো। পরবর্তীকালে জামিউল কাইরোর নতুন নামকরণ হয় আল-আজহার।
আল-আজহার শব্দটি এসেছে আল-জাহার থেকে, যার অর্থ দাঁড়ায় আলোকময় বা আলোকবর্তিকা। জামিউল-কাইরো থেকে আল-আজহার নামকরণ নিয়ে ইতিহাসে দুটি মতবাদ দেখা যায়। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মনে করেন, আল-আজহার মসজিদের পারিপার্শ্বিক নান্দনিকতার জন্যই এর নাম আল-আজহার। তবে অধিকাংশের মতে, আল-আজহার নামকরণ করা হয়েছে হযরত মুহাম্মদ (সা) এর মেয়ে ফাতিমা আল-জাহার (রা) এর নামানুসারে, তাঁর সম্মানার্থে। নামকরণ নিয়ে মতভেদ থাকলেও এটা ঠিক যে তৎকালে আল-আজহার মিশরকে সত্যিকার অর্থেই জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছিল।
ফাতেমিরা যখন মিশর জয় করে নেয়, তখন সেখানকার অধিকাংশই ছিল সুন্নি মুসলিম। এদিকে ফাতেমিরা ছিল শিয়া মুসলিম। সেসময়ে শিয়া মতবাদ সম্পর্কে মিশরের সুন্নি মুসলিমদের তেমন ধারণা ছিল না। ফলে মুইজ-লি-দ্বীন শীঘ্রই একটি হালকা (শিক্ষাকেন্দ্র) নির্মাণের আদেশ দেন, যেন সেখানে শিয়া মতবাদ চর্চা করা যায়।
৯৭৫ সাল, আল-আজহারের প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রথম শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন মুইজ-লি-দ্বীনের বিশ্বস্ত বন্ধু আলী ইবনে আল-নোমান, যিনি সেখানে আল-ইখতিসার নামের একটি বই দিয়ে শিক্ষা-কার্যক্রম শুরু করেন। আল-ইখতিসার ইসমাইল-ই শিয়া মতবাদের প্রসিদ্ধ একটি গ্রন্থ। আল-আজহার মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে শিয়া মতাদর্শিক শিক্ষাকেন্দ্র।
বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠা
৯৯৮ সাল, মিশরে ফাতেমি খিলাফতের ২৯ বছর পেরিয়ে গেছে। মুইজ-লি-দ্বীন আল-আজহার মসজিদে যে ইসমাঈল-ই শিয়া শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন, তা এখন মিশরের বেশ পরিচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মতো জনপ্রিয় নয়।
ইয়াকুব ইবনে কিলিস, ফাতেমি সাম্রাজ্যের একজন বিচক্ষণ মন্ত্রী। তিনি বুঝতে পারলেন, আল-আজহারের জনপ্রিয়তা বাড়াতে হলে শিক্ষা পদ্ধতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি। কারণ তখন পর্যন্ত আজহারে কেবল ইসমাইল-ই শিয়া মতবাদই শিক্ষা দেওয়া হত। ইয়াকুব তার পরিকল্পনা খলিফা আজিজ বিল্লাহকে জানালে খলিফাও অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ইয়াকুবের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আদেশ দেন।
৯৯৮ সালের পর আল-আজহারকে তাই নতুন করে সাজানো হয়। ইসমাইল-ই শিয়া মতবাদের পাশাপাশি যোগ হয় আরবি সাহিত্য, আরবি ব্যাকরণ, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি বিষয়সমূহ। নির্দিষ্ট করে শিক্ষাব্যবস্থার নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রক্রিয়ার যা যা থাকা প্রয়োজন মোটামুটি তার সবই যুক্ত করা হয়। খলিফা মুইজ-লি-দ্বীনের প্রতিষ্ঠিত আল-আজহারের ছোট খানকা রূপান্তরিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পরিবর্তন
মিশরে ৯৬৯ সালের পর যে ফাতেমি খিলাফত শুরু হয়, তার অবসান ঘটে ১১৭১ সালে। সালাউদ্দিন আইয়ুবি ফাতেমিদের ক্ষমতাচ্যুত করে মিশরে পুনরায় সুন্নি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এসময় তিনি আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত করেন। কেননা আজহারে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ভীষণ গুরুত্বের সাথে শিয়া মতবাদ শিক্ষা দেওয়া হত। কিছুদিন পরেই শিয়া মতবাদের বিষয়গুলোকে বাদ দিয়ে নতুন করে আল-আজাহার বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা হয়।
পুরো আরব বিশ্ব জুড়ে অধিকাংশ মুসলিমই ছিল সুন্নি মতাদর্শে বিশ্বাসী, অন্যদিকে শিয়ারা ছিল সংখ্যালঘু। মূলত এ কারণেই আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়কে ফাতেমি শাসকরা ঢেলে সাজালেও এর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়নি। মিশরে আইয়ুবি শাসন শুরু হলে সুন্নি মুসলিমদের কাছে আল-আজহারের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। তবে আল-আজহার এখন যতটা বিখ্যাত বা গুরুত্বপূর্ণ তা অর্জন করতে আরো অনেক সময় লেগেছিল।
বিখ্যাত হয়ে ওঠা
মধ্যযুগে পুরো পৃথিবীর ইতিহাসে চোখ বুলালেই দেখা যাবে, মৌসুমি বৃষ্টির মতো ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ফাতেমিদের পতন ঘটান, কিন্তু কিছুকাল পরেই মামলুকদের উত্থানে মিশরে আইয়ুবি শাসনেরও অবসান হয়। আল-আজহার প্রতিষ্ঠার পর মিশরের শাসন ব্যবস্থা যতবার পরিবর্তিত হয়েছে, ঠিক ততবারই আজহার বিশ্ববিদ্যালয়েরও আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক পরিবর্তন আসে মামলুক শাসনামলে। অনেক ঐতিহাসিক মামলুক শাসনামলকে আল-আজহারের পুনর্জাগরণ বলে উল্লেখ করেছেন।
মিশরে যখন মামলুক সুলতান বাইবার্সের শাসন চলছে, তখন মোঙ্গল তাণ্ডবে জ্বলছে অর্ধেক পৃথিবী। সেসময়টায় মোঙ্গল আক্রমণে পতন হয় আব্বাসীয় খিলাফতের। সেই সাথে আব্বাসীয়দের রাজধানী বাগদাদ নগরীকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয় মোঙ্গল বাহিনী। শুধু বাগদাদ নয়, পুরো মধ্য-পৃথিবী ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় মোঙ্গল আক্রমণে।
কিন্তু মোঙ্গলদের উত্থানের সাথে আল-আজহারের পরিবর্তনের সম্পর্ক কোথায়? সম্পর্ক আছে। কারণ মোঙ্গল বাহিনী তখন পুরো মধ্য-পৃথিবী ধ্বংস করে দিলেও মিশরে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে বাগদাদভিত্তিক মুসলিমদের যে শিক্ষিত শ্রেণী গড়ে উঠেছিল, তারা সকলেই মিশরে আশ্রয় গ্রহণ করে। আসলে আশ্রয় নয় ঠিক, বাগদাদসহ মোঙ্গল রোষানলে বেঁচে যাওয়া অধিকাংশ মানুষই মিশরে স্থানান্তরিত হয়।
এতে করে তৎকালের অধিকাংশ জ্ঞানী ব্যক্তি ও বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সমন্বয়ে মিশর যেমন বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে, তেমনই আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ও পৌঁছে যায় এক অনন্য উচ্চতায়। সেই সাথে সুন্নি মুসলিমদের প্রধান শিক্ষাকেন্দ্রের খেতাবটাও জুটে যায় তখন থেকেই।
মামলুকদের পর মিশরের ক্ষমতা চলে আসে ওসমানীয় শাসনের অধীনে। মামলুক আমলে যে আভিজাত্যের ছোঁয়া আল-আজহার পেয়েছিল, এই আমলেও তা বজায় থাকে। তৎকালের বিখ্যাত মুসলিম আলেমরা আজহারে শিক্ষকতা করেছেন। সেখান থেকে পড়াশোনা শেষ করে মুসলিম বিশ্বে বিখ্যাত হয়েছেন এমন গুণীজনের সংখ্যাও অনেক।
আধুনিক যুগে আল-আজহার
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিরাষ্ট্রের মতবাদ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করলে ১৯২২ সালে মিশরও একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৬২ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। সেই সাথে ধর্মীয় বিষয়ের সাথে ইতিহাস, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, মেডিসিন, চিকিৎসা, প্রকৌশল ইত্যাদি বিষয় সংযোজন করেন।
বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রায় ৫৪ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৮১টি পৃথক অনুষদে রয়েছে ৩৫৯টি বিভাগ, যেখানে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে আলাদা ৮টি অনুষদ। এতগুলো বিভাগের জন্য শিক্ষকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। প্রায় ৫ হাজার শিক্ষক যুক্ত আছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমান আরব বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি। এছাড়াও সারা বিশ্বে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় বেশ সুনামের সাথেই তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে।