উইঘুরের জন্য লড়াই করে যাওয়া ইলহাম তোহতি

চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসকারী মুসলিম সম্প্রদায় উইঘুরের অন্তর্ভুক্ত মানুষদের যুগ যুগ ধরে তাদের ধর্ম এবং সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। মধ্য এশিয়া, বিশেষ করে তুর্কির সাথে উইঘুরের জাতিগত সামঞ্জস্য রয়েছে। এই সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ও জাতিগত ভিন্নতা চীনের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় বিধায় উইঘুর সম্প্রদায়ের এই স্বাতন্ত্র্য ও অস্তিত্ব মুছে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে চীন। আর এজন্য তারা একটি ভয়ংকর পরিকল্পনার আশ্রয় নিয়েছে। উইঘুর মুসলিমদেরকে চীনের সাধারণ জনগণের সাথে থাকার এবং চীনের সংস্কৃতি বোঝার উপযোগী করে তোলার নামে জোরপূর্বক পাঠানো হচ্ছে ডিটেনশন ক্যাম্পে।

চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের ডিটেনশন ক্যাম্প; Image source: bbc.com

চীন সরকারের দাবি- এসব ক্যাম্পে উইঘুর সম্প্রদায়ের মুসলিমেরা স্বেচ্ছায় শিক্ষাপ্রাপ্তির জন্য যাচ্ছেন। তবে সেই ক্যাম্পে যাওয়ার ব্যাপারে এবং সেখান থেকে ফিরে আসা উইঘুরদের বক্তব্য ভিন্ন। তাদেরকে শুধু আত্মপরিচয় ভুলে হান চীনাদের সাথে মিশে যাওয়ার মতোই শিক্ষাই নয়, বরং শারীরিকভাবে নির্যাতন করার মতো অমানবিক পদক্ষেপের আশ্রয়ও নিয়েছে চীন। এ নিয়ে সরকারের সমালোচনারও কোনো অন্ত নেই।

 উইঘুরদেরকে শুধু আত্মপরিচয় ভুলে হান চীনাদের সাথে মিশে যাওয়ার মতোই শিক্ষাই নয়, বরং শারীরিকভাবে নির্যাতন করার মতো অমানবিক পদক্ষেপের আশ্রয়ও নিয়েছে চীন; Image source: teespring.com

উইঘুর সম্প্রদায়ভুক্ত ইলহাম তোহতিও এই সমালোচনা কোনো অংশেই কম করেননি। চীনের সেন্ট্রাল মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক তোহতি চীনের সাথে উইঘুরের সম্পর্কের উপর গবেষণা এবং উইঘুরের উপর অত্যাচারের সকল খবরাখবর বিশ্ববাসীর নিকট পৌঁছে দেওয়ার সুবাদে সকলের নিকট পরিচিত হয়ে ওঠেন। তার স্বাধীনচেতা মনোভাবই একসময় তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৪ সালে চীন সরকার তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। চীনের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সময়ের চক্রে নিজ দেশেই সন্ত্রাসী ও অপরাধী হিসেবে গণ্য হতে শুরু করেন। সকল প্রকার মিডিয়ার উপর কড়া নজরদারিতে চীন সর্বদাই এগিয়ে। আর এতে করে অনেক সত্য ও অত্যাচারের কথা চাপা পড়ে যায়। তবে চীনের এত ষড়যন্ত্রেও কোনো লাভ হয়নি। তোহতির আত্মত্যাগ এবং উইঘুর সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের খবর ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র বিশ্বে। গত বছর তোহতিকে তার কাজের জন্য সম্মান প্রদর্শনের তাগিদে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাকে শাখারভ পুরস্কারে ভূষিত করে।

ইলহাম তোহতি; Image source: time.com

কে এই ইলহাম তোহতি?

১৯৬৯ সালে জিনজিয়াং প্রদেশের আরতুশ শহরের একটি উইঘুর পরিবারে জন্ম ইলহাম তোহতির। ১৯৮৫ সালে তার শিক্ষা জীবনের যাত্রা শুরু হয়। নিজ প্রচেষ্টায় চীনের সেন্ট্রাল মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপকও হতে সক্ষম হন। উইঘুর সম্প্রদায়ের মানুষেরা সাধারণত এত উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার কিংবা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পান না। এর পেছনে দায়ী উইঘুরদের উপর চীনের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়ন। এসব প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করার মতো সুযোগ ও মনোবল তোহতি পান। আর ইলহাম তোহতি এই সুযোগকে ভালোমতোই কাজে লাগিয়েছেন।

সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে তিনি তার গবেষণার ক্ষেত্রে জিনজিয়াং এবং চীনের মধ্যকার সম্পর্ক, জিনজিয়াং এবং মধ্য এশিয়ার সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর উপরই বেশি গুরুত্বারোপ করেন। প্রায় দুই যুগ ধরে তিনি উইঘুর ও হান চীনাদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু এই চেষ্টাই তার জীবনের জন্য ধ্বংস ডেকে আনে। জিনজিয়াংয়ে মুসলিমদের উপর যেসব অত্যাচার করা হত তা সবকিছুই তিনি স্পষ্টভাবে সকলের নিকট তুলে ধরার চেষ্টা করতেন। ফলে ১৯৯৪ সালে থেকে তার উপর সরকারি নজরদারি শুরু হয়। বিভিন্ন সময়ে তাকে হয়রানির শিকারও হতে হয়। ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তাকে পাঠদান থেকেও জোরপূর্বক বিরত রাখা হয়। ১৯৯৯ সালের পর থেকে সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে তোহতির জন্য সাধারণ স্থানগুলোতেও যখন-তখন আসা-যাওয়া করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে।

প্রায় দুই যুগ ধরে তিনি উইঘুর ও হান চীনাদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন; Image source: foreignpolicy.com

ইন্টারনেটে তোহতির আন্দোলন ও এর পরিণতি

বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেও তোহতিকে থামাতে পারেনি চীনের সরকার। নজরদারির মাঝেই বহির্বিশ্বে উইঘুরদের অবস্থা তুলে ধরতে সহায়তা নেন ইন্টারনেটের। উইঘুরদের হয়ে কাজ করতে থাকেন, তাদের অধিকারের জন্য কাজ করতে থাকেন তিনি।

২০০৬ সালে তোহতি ‘উইঘুরবিজ.নেট’ নামক ওয়েবসাইট তৈরি করেন। ওয়েবসাইটের ভাষা ছিলো চীনা। উইঘুরের সকল সমস্যা ও তাদের উপর নিপীড়নের ঘটনাগুলো বর্ণিত হয় এই ‘উইঘুরবিজ.নেট’-এ। বিভিন্ন সময়ে ওয়েবসাইটটি বিভিন্ন মেয়াদে বন্ধও করে দেওয়া হয়। যারা ওয়েবসাইটটির জন্য লেখালেখি করতেন তারাও চীনা সরকারের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। তাদেরকেও বিচ্ছিন্নতাবাদের অপবাদে নির্যাতন করা হয়। পুরোপুরি না হলেও ওয়েবসাইটটির আংশিক অস্তিত্ব এখনও টিকে আছে।

ইলহাম তোহতি চীনের যেসকল নিয়ম-কানুন উইঘুরের স্বার্থবিরোধী এবং তাদের শোষণ করার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে সেসকল নিয়মের কথা প্রকাশ করে দেন। এসব তথ্য চীনের সরকার বিশ্বের মানুষদের কাছে অপ্রকাশ্যই রাখতে চেয়েছিল। তবে ইলহাম ও তার ওয়েবসাইট সেটা হতে দেয়নি। সরকারের তত্ত্বাবধানে উইঘুর মুসলিমদের গ্রেফতার, হত্যা এবং গায়েব করার তথ্যও প্রকাশিত হয় এই ওয়েবসাইটে।

চীনে সব রকমের মিডিয়ার উপর কড়া নিয়ন্ত্রণ থাকায় এসব খবর সম্পর্কে জানতে পারে না অন্যান্য দেশের মিডিয়া। সেসব মিডিয়া বা সাংবাদিক মূলত তোহতির কাছ থেকে কিংবা তার ওয়েবসাইটের মাধ্যমেই তথ্য সংগ্রহের কাজটা করছিল। যার ফলে চীনের সংরক্ষিত এলাকার গোপন তথ্য ক্রমাগত প্রকাশ পেতে থাকে। এর ফলে তোহতির সাথে সরকারের মনোমালিন্য শুরু হয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তথ্য প্রকাশের দায়ে তোহতিকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। ফলশ্রুতিতে, বিভিন্ন মেয়াদে গৃহবন্দীও হন তিনি।

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তথ্য প্রকাশের দায়ে তোহতিকে রিমান্ডে নেওয়া হয়; Image source: tibetexpress.net

২০১৩ সালে তোহতি অর্থনীতির অধ্যাপক হওয়ার সুবাদে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির সেন্ট্রাল ইউরেশিয়ান স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টে পরিদর্শনে যাওয়ার সুযোগ পান। সকল আনুষ্ঠানিকতাও সম্পন্ন করা হয়ে গিয়েছিল। তবে যেদিন তার যাওয়ার কথা ছিলো সেদিন তাকে এয়ারপোর্ট থেকে আটক করা হয়। চীন থেকে তার বাইরে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়।

২০১৩ সাল অবধি তোহতির প্রচার তুঙ্গে পৌঁছে গিয়েছিল। তার প্রতিটি অভিযোগ ও তথ্যকে গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখা শুরু করেছিল বিশ্বের গণযোগাযোগ মাধ্যমগুলো। দেশ থেকে বের হওয়ার সুযোগ পেলে তোহতি তা উইঘুরদের পক্ষে এবং চীন সরকারের বিপক্ষে ব্যবহার করবে তা খুব ভালো করেই জানতেন চীন সরকার। তাই সময় থাকতে তোহতিকে নিজ দেশেই বন্দি করে ফেলা হয়।

২০১৪ সালে তোহতিকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে আখ্যায়িত করে চীনা সরকার। তার নামে জাতিগত উত্তেজনা সৃষ্টিরও অপবাদ দেওয়া হয়। তখন থেকেই তিনি কারাবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। তাকে এসব অপবাদ দিয়ে শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। শুধুমাত্র বাকস্বাধীনতা ব্যবহার করার ফলে ইলহাম তোহতিকে গ্রেফতার করা হলে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, যেমন- জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনের সমালোচনা করেন। একজন ব্যক্তিবিশেষের স্বাধীনতাই বা কেন ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে সেটাও জানতে চায় সংগঠনগুলো। তার গ্রেফতারের পর চীন শত সমালোচনার শিকার হয় ঠিকই, তবে তা-ও সরকার তোহতিকে মুক্তি দেয়নি। ২০১৭ সালের পর থেকে তোহতির সাথে তার পরিবারের সদস্যরাও দেখা করার সুযোগ পান না। তিনি ঠিক কোথায় আছেন, কেমন আছেন সেসব তথ্যও রয়ে গেছে সকলের অগোচরে।

তোহতির শাখারভ পুরস্কার প্রাপ্তি

প্রতি বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্বাধীন চিন্তার জন্য শাখারভ পুরস্কার প্রদান করে থাকে। ২০১৯ সালে ইলহাম তোহতিও এই পুরস্কার পান। তার অনুপস্থিতিতে তার মেয়ে স্ট্রাসবার্গে গিয়ে তার পুরস্কার গ্রহণ করেন। এসময় তোহতির মেয়ে জেওহার ইলহাম তার পিতা ও উইঘুর সম্প্রদায়ের উপর যে অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে সেই সম্পর্কে বলেন।

তোহতির মেয়ে জেওহার ইলহাম; Image source: scmp.com

মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ (এইচআরডব্লিউ)-এর মতে, তোহতির বিরুদ্ধে যেসকল অপবাদ আনা হয়েছে সেগুলো প্রমাণ করার মতো কোনো কিছু উপস্থাপন করতে পারেনি চীন সরকার। তোহতির ক্ষেত্রে বেআইনি কোনো কাজেরও নজির পাওয়া যায়নি। তোহতি নিজ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য যেসব ত্যাগ স্বীকার করেছে তা সকলেই উপলব্ধি করেছে। আর এজন্যই কারাবন্দী থাকা সত্ত্বেও তার স্বাধীন চিন্তার জন্য বিভিন্ন সংগঠন থেকে পুরস্কারও পেয়েছেন।

This article is in Bangla language. It's about Ilham Tohti who fought for Uyghur. Sources have been hyperlinked in this article.
Featured image: time.com

Related Articles

Exit mobile version