প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি দুঃসাহসিক এবং দুর্দান্ত অভিযানের জন্য তাইওয়ান উপযুক্ত একটি স্থান। বড় বড় পাহাড়-পর্বত ও ঝর্ণায় ঘেরা অঞ্চলটিতে প্রাকৃতিক বিস্ময়ের কোনো অভাব নেই। এরকমই ১০টি প্রাকৃতিক বিস্ময় নিয়ে আজকের এই লেখাটি।
তারোকো গর্জ
তারোকো গর্জ তাইওয়ানের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত ১৯ কিলোমিটারের একটি গভীর খাদ। তারোকো গর্জের আশেপাশের এলাকাকে বলা হয় তারোকো গর্জ ন্যাশনাল পার্ক। জায়গাটি যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা তেমনি বিপজ্জনকও বটে। তাইওয়ানের ২৭টি পর্বতশৃঙ্গ রয়েছে এই পার্কে। পঞ্চম পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট নানহুর অবস্থানও তারোকো গর্জে।
নানহুর উচ্চতা ৩,৭৪২ মিটার। পুরো পর্বত জুড়ে রয়েছে বাঁশের গাছ। শুধু যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও দুর্দান্ত অভিযানের জন্য তারোকো গর্জের নাম রয়েছে, ব্যাপারটা কিন্তু সেরকমও নয়। এখানে রয়েছে চাংচুন মঠ। মানুষের নির্মিত অপূর্ব সুন্দর ও ঐশ্বর্যশালী মঠটি ২২৬ জন শ্রমিকের স্মৃতিচারণের নিদর্শন, যারা সেন্ট্রাল ক্রস-আইল্যান্ড হাইওয়ে নির্মাণের সময় মারা যান। তাছাড়া একটি বেল টাওয়ার, বৌদ্ধদের দয়ার দেবী গুয়ানইনের পবিত্র গুহার দেখা মিলবে এই মঠের পিছে। তাইওয়ানের শতকরা ৮০ ভাগ পশুপাখির দেখা মিলে তারোকো গর্জে। হাইকিং, সাইক্লিংয়ের জন্য জায়গাটা বেশ ভালো। তবে সতর্কতা মেনে চলা আবশ্যক।
শিফেন জলপ্রপাত
শিফেন জলপ্রপাত বা ঝর্ণা তাইওয়ানের সবচেয়ে প্রশস্ত ঝর্ণা, যার প্রস্থ ৪০ মিটার এবং উচ্চতা ২০ মিটার। ঝর্ণার পানির সাথেই কুয়াশা, আর তার সাথে হালকা রংধনু দেখা যায় এখানে। নিউ তাইপের পিংজি জেলার কিলুং নদীতে অবস্থিত ঝর্ণাটি তার প্রশস্ততা ও বৈশিষ্ট্যের জন্য ‘তাইওয়ানের নায়াগ্রা ফল’ হিসেবে খেতাব অর্জন করেছে। ঝর্ণার লাগাতার বয়ে যাওয়া জলধারার বল সূর্যের আলোর সাথে মিশে চারপাশের পরিবেশে একটি বিচিত্র বর্ণের সৃষ্টি করে। শিফেন ঝর্ণার অবস্থান শিফেন পুরোনো রাস্তার কাছেই। আর এখানে আসলে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো রং-বেরঙের ফানুস, যাতে আপনি আপনার ইচ্ছে লিখে উড়িয়ে দিতে পারেন আকাশে।
তাতাকা এবং দংপু
উত্তর-পশ্চিমের ইউশান ন্যাশনাল পার্কের হাইওয়ে ১৮ এবং হাইওয়ে ২১-এর মাঝে অবস্থিত তাতাকা। নিউ সেন্ট্রাল ক্রস-আইল্যান্ড হাইওয়ের সর্বোচ্চ চূড়া হলো এই তাতাকা। পাহাড়-পর্বতের উঁচু উঁচু চূড়া এবং এর সাথে মেঘ ও কুয়াশার সংমিশ্রণটা বেশ আকর্ষণীয় বটে। আর হাইওয়ে ২১-এর পথ ধরে এগিয়ে গেলে দেখা মিলবে পার্বত্য গ্রাম দংপুর। এটি উষ্ণ প্রস্রবণের জন্য পরিচিত। দংপুও হাইক করার জন্য উপযুক্ত একটি স্থান। হাইক করার পর উষ্ণ গরম পানিতে আরাম করে গোসল এবং এর সাথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য রয়েছে হোটেল তিলুন দংপু স্পা।
মাউন্ট কিজিং
মাউন্ট কিজিং হলো তাইপের সবচেয়ে উঁচু পর্বত যা তাতুন আগ্নেয়গিরি গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। তাইপে বেসিনের পরিধির মধ্যে অবস্থিত আগ্নেয়গিরিটি তাইওয়ানের সর্বোচ্চ আগ্নেয়গিরি। ইয়াংমিংশান জাতীয় পার্কের কেন্দ্রে রয়েছে এই মাউন্ট কিজিং। আর এর সর্বোচ্চ চূড়া সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,১২০ মিটার (৩,৬৭৫ ফুট) উঁচুতে। উত্তর তাইপে থেকে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বা গণযানবাহনে মাউন্ট কিজিং যেতে সময় লাগে এক ঘণ্টা। উচ্চতা ও প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে মাউন্ট কিজিংয়ে ওঠার রাস্তা দুর্গম হওয়ার কথা থাকলেও তা হয় না। কারণ হাইকিং করার কষ্ট কমিয়েছে মানুষের নির্মিত রাস্তা ও সিঁড়ি। হাইক করে গেলে বিভিন্ন ভূ-তাপীয় বৈশিষ্ট্য, যেমন- বাষ্পের নির্গমন ও উষ্ণ প্রস্রবণ দেখা যায়।
শি-পা ন্যাশনাল পার্ক
বন্য এবং অনুন্নত হওয়ার কারণে তাইওয়ানের পর্বতে ঘেরা শি-পা ন্যাশনাল পার্ক কিছুটা রহস্যজনক রয়ে গেছে সবার কাছে। বন্য প্রজাতিদের রক্ষা এবং মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যটকদের জন্য রয়েছে অনেক বিধিনিষেধ। তাছাড়া পর্যটক কতজন আসতে পারবে তা নিয়েও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই পার্কে ৫১টি পর্বত রয়েছে যেগুলো প্রায় ৯,৮০০ ফুট পর্যন্ত লম্বা। শি-পা পার্ক একদিনে ঘুরে শেষ করা সম্ভব নয়। তাই এখানে আসলে কিছুদিন থাকার প্রস্তুতি নিয়েই আসতে হবে। সেক্ষেত্রে পার্কের ওলিং ফরেস্ট রিক্রিয়েশন এরিয়ায় ক্যাম্পিং করা যেতে পারে। ওলিং কোয়াড্রাপল ট্রেইলের মাধ্যমে পার্কের চারটি পর্বত, যেমন- পিনতিয়ান, চিহু, তাও এবং কালাহে ঘুরে আসা যায়। হাইকারদের আরাম করার জন্য ঐতিহাসিক ‘ওলিং ফার্ম’ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার ও ছবি তোলার জন্য উপযুক্ত স্থান। বসন্তে চেরি গাছের বিকশিত হওয়া আর শরতে প্রকৃতির নানা রং দেখার সৌভাগ্য হয় শি-পা ন্যাশনাল পার্কের দরুণ।
আলিশান ফরেস্ট রেলওয়ে
তাইওয়ানের পার্বত্য এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আলিশান ঘুরে দেখার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো আলিশান ফরেস্ট রেলওয়ে। প্রায় ১০০ বছরেরও আগে নির্মিত রেলওয়েটি পূর্বে আলিশান থেকে সাইপ্রাস গাছ বা কাঠ আনতে ব্যবহৃত হত। এই সাইপ্রাস এখন আলিশান থেকে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। সেখানে গাছ কাটা নিষিদ্ধ করে দেয়ায় এই রেলওয়ে শুধুমাত্র সাধারণ জনগণ এবং পর্যটকের যাতায়াতের কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে ঐতিহাসিক এবং সুন্দর ফরেস্ট রেলওয়েগুলোর একটি। চিয়াই এবং চুশ্যান শহরের মাঝে অবস্থিত আলিশান ফরেস্ট রেলওয়ে তাইওয়ানের সবচেয়ে উঁচু রেলওয়ে যা ভিন্ন ধাঁচের, ভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার সুযোগ করে দেয়। এটি এশিয়ার সবচেয়ে সরু রেলওয়েও বটে। ৩০ মিটার উঁচু থেকে ২,৪৫১ মিটার উঁচু এলাকা পর্যন্ত এটি বিস্তৃত, যা দার্জিলিং হিমালয় রেলওয়ে থেকেও উঁচু।
শিয়াও ওলাই ঝর্ণা
ঝর্ণা দেখতে দেখতে আকাশপথে হাঁটার ব্যাপারটা মন্দ নয়। তবে সত্যিকারে তা সম্ভব না এটাই স্বাভাবিক, এবং অনেকেরই কল্পনার বাইরে। মানুষের কল্পনার বাস্তব রূপ দেখা যায় শিয়াও ওলাই ঝর্ণার কাছে। এই ঝর্ণার প্রায় ২৩০ ফুট উপরে অবস্থিত শিয়াও ওলাই স্কাইওয়াক। ২০০ মিটার দীর্ঘ ব্রিজটি ঝর্ণার উপরে মেঘের উপর হাঁটতে কেমন লাগবে সেই অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা করবে। এই ব্রিজে ঘুরে আসার পরিকল্পনা থাকলে এর পাশের সানদিওলিং ওয়াটারফল ওয়াকও ঘুরে আসা যায় আরো তিনটি আকর্ষণীয় ঝর্ণা দেখার জন্য। উল্লেখ্য, একসাথে বেশি মানুষকে শিয়াও ওলাই স্কাইওয়াক বা ব্রিজে উঠতে দেওয়া হয় না। কারণ বেশি মানুষের ভারে ব্রিজে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে। সর্বোচ্চ ২৫ জনকে একসাথে যেতে দেওয়া হয় এবং এজন্য অবশ্যই আগে থেকে বুকিং দেওয়া লাগে।
শিবা লুওহানশান
তাইওয়ানের দক্ষিণকেন্দ্রিক লিউগুই জেলার লাওনং নদীর তীরে অবস্থিত শিবা লুওহানশান। ‘শিবা লুওহানশান’ মানে ১৮ আরহাত (বৌদ্ধ শিষ্য) পর্বত। তবে এই পর্বতমালা গঠিত প্রায় ৪০টিরও বেশি পর্বত নিয়ে। আঞ্চলিক লোকজনের বিশ্বাস, ১৮ আরহাত তাদের জানমাল রক্ষা করবে। তবে তারা তাদের সম্পদ শিবার বাইরে কোথাও খরচ করলে ক্ষতির শিকার হবে, শাস্তি পাবে। এই অসমতল ভূতাত্ত্বিক বিস্ময়ে পর্যটকেরা ম্যাকাক (একপ্রকার ছোট লেজওয়ালা বানর) এবং লাল ঠোঁটের কাঠবিড়াল দেখতে পান। পর্বত এবং নদীর মাঝে হাইক করে যেতে যেতে বন্যপ্রাণীদের দেখার সুযোগ সাধারণত একসাথে পাওয়া যায় না। কিন্তু শিবা লুওহানশান সেই সুযোগটিই পর্যটকদের করে দেয়।
লিশান এবং হেহুয়ান পর্বতমালা
শি-পা এবং তারোকো ন্যাশনাল পার্কের মাঝে অবস্থান করছে লিশান। এটি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মনোরম দৃশ্য এবং ঝর্ণার জন্য বিখ্যাত। এখানে আপেল, নাশপাতি, পিচ ফলের গাছও দেখা যায়। হেহুয়ান পর্বতমালা যাওয়ার পথে একটু বিরতি নেওয়ার জন্য একটি উপযুক্ত স্থান হলো এই লিশান। হেহুয়ান পর্বতমালার উচ্চতা প্রায় ১১,২০৩ ফুট এবং এর ২৪০টি চূড়া আছে। এখানে হাইকারের জন্য একটি ট্রেইলও আছে। এই ট্রেইল যারা আস্তে-ধীরে হেঁটে চারপাশের পরিবেশ দেখতে দেখতে যেতে চান তাদের জন্য ভালো, আবার যারা অভিজ্ঞ পর্বতারোহী তাদের জন্যও ভালো। হেহুয়ান হলো তাইওয়ানের সর্বোচ্চ ট্রেইলহেড, যেখানে পাবলিক রোড দিয়ে যাওয়া সম্ভব।
শিয়াও চুই লু ও শাকাদং ট্রেইল
শিয়াও চুই লু ট্রেইলের অবস্থান লিউ রিভার গর্জের সাথেই। তারোকো ন্যাশনাল পার্কে হাইকের ক্ষেত্রে একটি উপযুক্ত পথ হলো শিয়াও চুই লু ট্রেইল। নদীপথের পশ্চিমে রয়েছে শাকাদং ট্রেইল। শাকাদং নদীর পাশে পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয় এই ট্রেইলটি। শাকাদং ট্রেইল পাহাড়ে হলেও তা সমতলের রাস্তার ধাঁচে নির্মিত হয়েছে। সাধারণত পাহাড়ি রাস্তার পথ উঁচু-নিচু বা খাজকাঁটা হলেও শাকাদং ট্রেইল একেবারে সমতল।
বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/