আচ্ছা বলুন তো, কোনো দেশে সর্বোচ্চ কতগুলো ভাষার প্রচলন থাকা সম্ভব? একটি? দুটি? সর্বোচ্চ ১০টা? আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেই রয়েছে ২২টি ভাষার প্রচলন। অবশ্য প্রায় দেড়শো কোটি মানুষের বাস রয়েছে যে দেশে, সেখানে বৈচিত্র্যের পরিমাণও যে বেশি হবে- সেটাই স্বাভাবিক। তবে মাত্র কয়েক লক্ষ মানুষ যেখানে বাস করে, সেখানে কয়েকশো ভাষার ব্যবহার নিঃসন্দেহে অবাক করার মতো একটি বিষয়।
বলছি, ওশেনিয়ার ছোট একটি দেশ পাপুয়া নিউগিনির কথা। জনসংখ্যা কিংবা আয়তন, কোনোদিক থেকেই দেশটি ভারতের সমান বা কাছাকাছি নয়। মাত্র ৭.৬ মিলিয়ন বাসিন্দা নিয়েও এখানে ব্যবহৃত হয় ৮৫০টি ভাষা। পুরো বিশ্বে ভাষার ক্ষেত্রে এরকম বৈচিত্র্যের দেখা মেলে শুধুমাত্র এই দেশটিতেই। পাপুয়া নিউগিনিতে কীভাবে আসলো এত ভাষার সমাহার? সেই দেশের বাসিন্দারাই বা কীভাবে এত বিচিত্র ভাষা আয়ত্ত করলো?
পাপুয়া নিউগিনির পুরনো ভাষাগুলোকে বলা হয় ‘পাপুয়ান’, যা আজ থেকে প্রায় ৪০,০০০ বছর আগে সেখানে প্রথম বসতি স্থাপনকারীদের মাধ্যমে সেখানকার জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এসব ভাষা ‘পাপুয়ান’-এর অন্তর্ভুক্ত হলেও এদের উৎপত্তির ভিত্তি কিন্তু এক নয়। আসলে এই ভাষাগুলো আলাদা আলাদা কয়েক ডজন অসম্পর্কিত পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এরকমও কিছু ভাষার সন্ধান এখানে পাওয়া যায়, যা কোনো পরিবারেরই অংশ না। এর শিকড় কোথায়, তা-ও জানা যায়নি।
পরবর্তীতে, তথা আজ থেকে প্রায় ৩,৫০০ বছর আগে, পাপুয়া নিউগিনিতে কয়েকটি অস্ট্রোনেশীয় ভাষার আগমন ঘটে। এগুলো দেশটিতে এর পূর্বে প্রচলিত ভাষার তুলনায় ভিন্ন ছিল এবং হয়তো সেগুলো একটি মাত্র উৎস থেকেই এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, উৎসটি তাইওয়ানীয় ছিল। এত বৈচিত্র্যময় ভাষার সমাহারের ধকল সামলাতে না সামলাতেই দেশটিতে নতুন করে আরও ভাষার আগমন ঘটলো উনিশ শতকের দিকে। এই সময় সেখানে ইংরেজ এবং জার্মানভাষীদের আগমন ঘটে এবং দেশটি শাসন করা শুরু করে। স্বাধীনতার পর এত ভাষার মধ্যে পাপুয়া নিউগিনি শুধুমাত্র তিনটি ভাষাকেই সরকারি ভাষার মর্যাদা দেয়।
এর মধ্যে প্রথম স্থানেই রয়েছে টোক পিসিন। এটি একটি ইংরেজি-ভিত্তিক ক্রেওল ভাষা। পাপুয়া নিউগিনিতে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ভাষা এবং সেই দেশে এটি সার্বজনীন ভাষা হিসেবে পরিচিত। উল্লেখ্য যে, ক্রেওল হলো ইউরোপীয় এবং কৃষ্ণাঙ্গদের সংমিশ্রিত জাতিবিশেষ। এরপরেই বেশ গুরুত্ব সহকারে অবস্থান করছে হিরি মোতু এবং ইংরেজি। হিরি মোতু একটি অস্ট্রোনেশীয় ভাষা। অস্ট্রোনেশীয় ভাষাগুলো মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মাদাগাস্কার এবং প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এই ভাষা পরিবারে হিরি মোতুসহ মোট ১,২৫৭টি ভাষা রয়েছে। ব্যবহারকারীদের সংখ্যার ভিত্তিতে এটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ ভাষা পরিবার। আর ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ভাষার সংখ্যার ভিত্তিতে এটি বিশ্বে দ্বিতীয়।
পাপুয়া নিউগিনির ৮৫০টি ভাষা নিয়ে আলোচনা করা বেশ সময়সাপেক্ষ বিষয় বটে। আজকে আমরা শুধুমাত্র এর তিনটি সরকারি ভাষা নিয়েই আলোচনা করব।
ইংরেজি
পাপুয়া নিউগিনি বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের মতো ইংরেজি ভাষার সংস্পর্শে আসে, যখন ইংরেজ ব্যবসায়ী এবং ধর্মপ্রচারকদের আগমন সেখানে ঘটে। সময়টা ছিল উনিশ শতকের দিকে। ঔপনিবেশিক যুগে সবসময়ই ইংরেজি দেশটির সরকারি ভাষা ছিল এবং ব্যবসায়িক কাজেও মূলত এই ইংরেজি ব্যবহৃত হত। তবে ১৮৮৪-১৯১৪ সালে যখন জার্মানিরাই পাপুয়া নিউগিনিকে মূলত শাসন করা শুরু করে, তখন ইংরেজিকে সরকারি ভাষার তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য স্বাধীনতার পর ইংরেজি ভাষাকে আবার দেশটির তিনটি সরকারি ভাষার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
রাষ্ট্রের সকল ধরনের নির্দেশ ইংরেজি ভাষাতেই লেখা হয়, যাতে করে একটি নির্দিষ্ট ভাষায় সব সরকারি তথ্য জমা থাকে। পাপুয়া নিউগিনির বেশিরভাগ রেডিও এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ইংরেজিতে করা হয়। এমনকি এখানে অনেক খবরের কাগজও খবর প্রকাশ করে ইংরেজিতে। পাপুয়া নিউগিনিতে মোটামুটি সবাই সাধারণ ইংরেজি বলতে পারে। তবে শুধুমাত্র ১-২% জনগণ ইংরেজিতে পুরোপুরি পারদর্শী। আর প্রায় ১০% জনগণ এই ভাষায় মোটামুটি দক্ষ।
টোক পিসিন
পাপুয়া নিউগিনির জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই টোক পিসিন ভাষায় কথা বলে। এই ভাষা আরো কয়েকটি নামে পরিচিত। যেমন- নিউ গিনি পিজিন, পিজিন ইংরেজি বা নিও-মেলানেশিয়ান। এটি একটি পিজিন ভাষা। অর্থাৎ, ব্যাকরণের দিক থেকে কোনো ভাষার (সাধারণত ইংরেজি, ওলন্দাজ কিংবা পর্তুগিজ ভাষা) সরলতম রূপ। অভিধানের শতকরা ৮০ ভাগ শব্দই এসেছে ইংরেজি থেকে। আর বাকি শব্দের উৎপত্তি জার্মান, মালয় ও পলিনেশিয়ান ভাষা থেকে। তাছাড়া কিছু কিছু শব্দ পূর্বের চীনের উপকূলীয় পিজিন ভাষা থেকে আসে।
অনেক ভাষাবিদের মতে, এই ভাষার কাঠামো নিউ আয়ারল্যান্ডের একটি অস্ট্রোনেশীয় ভাষা থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। এর ব্যবহার প্রথম শুরু হয় উনিশ শতকের দিকে, যখন ইউরোপ থেকে ব্যবসায়ী এবং তিমি শিকারীরা আসা শুরু করে। তারা তখন আঞ্চলিক লোকজনের সাথে যোগাযোগের জন্য সাধারণ কোনো মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। আর সেখান থেকেই ভাষার একটি সহজ রূপ ঠিক করা হয়। ইউরোপের ব্যবসায়ীরা যখন বাসিন্দাদের কুইনসল্যান্ড এবং স্যামোয়ার আখের জমিতে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগানো শুরু করে, তখন মূলত এর ব্যবহার বিস্তার লাভ করে।
কেননা, এসব শ্রমিক নিজেদের গ্রামে বা বাড়ি ফিরে এই ভাষার প্রয়োগ করতো। অথবা তারা যখন অন্য কোথাও কাজ করতে যেত, তখন তাদের আয়ত্ত করা নতুন ভাষা আশেপাশের মানুষজনের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ফলে ধীরে ধীরে টোক পিসিন পাপুয়া নিউগিনির গ্রাম এবং শহুরে এলাকায় জনপ্রিয়তা লাভ করে। দেশটির কিছু কিছু শহরের জন্য এটাই যোগাযোগ করার প্রধান মাধ্যম। ‘টোক পিসিন’-এর প্রয়োগ রেডিও এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে ও খবরের কাগজে দেখা যায়। জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদ এবং গণ বিতর্কেও ব্যবহারের জন্য এটা সেখানকার সবচাইতে উপযুক্ত ভাষা হিসেবেই বিবেচিত হয়। বাইবেলের একটি ভাগ, ‘দ্য নিউ টেস্টামেন্ট’-কে ‘দ্য ইভানজেলিক্যাল লুথারানস’ টোক পিসিন ভাষায় প্রকাশ করে ১৯৬৯ সালে। আর ১৯৮৯ সালে পুরো বাইবেলকে টোক পিসিন ভাষায় প্রকাশ করে ‘দ্য পিএনজি বাইবেল সোসাইটি’।
হিরি মোতু
এই ভাষাটি পুলিশ মোতু, পিজিন মোতু কিংবা হিরি নামেও পরিচিত। এটি একটি অস্ট্রোনেশীয় ভাষা, ভার্নাকুলার মোতুর পিজিন রূপ, যা মূলত পাপুয়া নিউগিনির রাজধানী পোর্ট মোরসবিতে ব্যবহৃত হয়।
বিশ শতকের শুরুর দিকে হিরি মোতু বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। এর পেছনে দায়ী ছিল ঐ অঞ্চলে আসা ঔপনিবেশিক এবং বিদেশি পুলিশ সদস্যরা। পাপুয়া নিউগিনির অন্যান্য ভাষার মতো এই ভাষার প্রচলনও শুরু হয় একটি নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ সহজ করার উদ্দেশ্যে। বিদেশি পুলিশদের জন্যই মূলত এর উদ্ভব বলে একে পুলিশ মোতুও বলা হয়। ধীরে ধীরে এই ভাষা দেশটির রাজধানী বাদেও বাকি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এর মূল মাধ্যম হিসেবে কাজ করে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। পাপুয়া নিউগিনিতে টোক পিসিন এবং ইংরেজির পর এই ভাষার ব্যবহারই সবচাইতে বেশি। ২০০৮ সালের একটি তথ্য মোতাবেক, প্রায় ৩৯,০০০ বাসিন্দা শুদ্ধ হিরি মোতু ভাষায় কথা বলতে পারেন। আর এর ব্যাকরণ এবং নিয়ম-কানুন অনেকটা টোক পিসিনের মতোই।
কেন এত ভাষা?
যুগে যুগে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর মানুষজন এই দেশে এসে বসবাস করে এবং দেশটি শাসন করে। ফলস্বরূপ, তাদের ভাষার প্রভাবও এই দেশে প্রতিফলিত হয়। এসকল বৈচিত্র্য এত ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর কারণেই দেখা যায়। এত ভাষার মূল লক্ষ্যই হলো সবার মধ্যে সাধারণ এবং সহজ একটা যোগাযোগ মাধ্যম তৈরি করা।
ভৌগোলিক কারণবশত পাপুয়া নিউগিনির এলাকাগুলো প্রতিবেশী দেশগুলো কিংবা সেই দেশগুলোর বিভিন্ন শহরের সংস্পর্শে আসতে পারেনি। ফলে তাদের মধ্যে সংস্কৃতির কোনো আদান-প্রদানও সম্ভব হয়নি। ফলে নিজেদের মধ্যেই নতুন নতুন বৈচিত্র্য নিয়ে তারা প্রভাব বিস্তার করে। এতে করে পাপুয়া নিউগিনির এমন অনেক ভাষা ছিল এবং আছে, যা শুধু একটি গোষ্ঠী কিংবা কয়েকজন মানুষ জানত বা জানে। এর মধ্যেই প্রায় ১১টি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই ধারাবাহিকতা দিন দিন আরও বাড়তে থাকবে। কেননা, এসব ভাষা সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় কোনো উদ্যোগ বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। এই ভিন্ন ভিন্ন ভাষার কারণেই পাপুয়া নিউগিনিতে এত ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির সমাহার দেখা যায়। এই অনন্য বৈচিত্র্য রক্ষার জন্যে এসকল ভাষা রক্ষা করা দরকার। এজন্য সেই দেশের সরকার এবং আমজনতার সোচ্চার হওয়া উচিত।