১৯৯০ সালেও কোডাক ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান পাঁচটি ব্রান্ডের একটি হিসেবে। সেসময়ে আমেরিকার ৯০ ভাগ ফিল্মের বাজার আর ৮৫ ভাগ ক্যামেরার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতো কোডাক। সারা দুনিয়ায় কোডাকের ছিল প্রায় দেড় লাখ কর্মী! বলতে গেলে, ফটোগ্রাফিক বাজারে তখনকার কোডাক ছিল আজকের গুগলের মতোই অপরিহার্য।
সেই কোডাকই ২০১২ সালের জানুয়ারিতে আমেরিকার একটি আদালতে ধারা ১১ অনুযায়ী নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন জানায়। একসময় সাফল্যের শীর্ষে থাকা প্রতিষ্ঠানটি, যারা ছিল ১৩০ বছর ধরে সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষের হাসি-আনন্দকে ফ্রেমবন্দী করার স্মৃতির সাথে জড়িত, সেই কোডাক নিজেই কার্যত ফ্রেমবন্দী হয়ে যায় সেদিন।
কিন্তু কেন দুনিয়াজুড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা বিশালাকারের কোডাক সেদিন নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করার আবেদন জানাতে বাধ্য হয়েছিল? কী ছিল তাদের বিপর্যয়ের কারণ? উত্তরটা বিস্ময়ের! এর পেছনে ছিল তাদের নিজেদেরই একটি উদ্ভাবন, ডিজিটাল ক্যামেরা! তো এবার চোখ বুলানো যাক পুরো ঘটনায়।
জর্জ ইস্টম্যান ও কোডাকের শুরু
জর্জ ইস্টম্যানের হাত ধরে ১৮৮৮ জন্ম কোডাকের। কোডাক প্রতিষ্ঠার আগে ইস্টম্যান প্রায় এক দশক ড্রাই প্লেট উৎপাদন ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। ১৮৮৫ সাল থেকে তিনি ডেভিড হস্টনের কাছ থেকে রোল ফিল্মের প্যাটেন্ট কিনে তা আরো উন্নত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন।
জর্জ ইস্টম্যান কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার বা উচ্চ শিক্ষিত কেউ ছিলেন না। হাই স্কুলেই ইতি টেনেছিলেন তার শিক্ষা জীবনের। এরপর ব্যাংকের করণিক হিসেবে কিছুকাল কাজ করে অবশেষে ড্রাই প্লেট ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছিলেন। যা-ই হোক, ১৮৮৮ সালেই কোম্পানি হিসেবে ইস্টম্যান তাদের প্রথম বক্স টাইপের ক্যামেরা বাজারে আনে। ক্যামেরার স্লোগান ছিল, “আপনি শুধু শাটার চাপুন, বাকিটা করবো আমরা”! ক্যামেরাটিতে পূর্বেই পেপার ফিল্ম লাগানো থাকতো, যাতে প্রায় ১০০টি ছবি তোলা যেত। ছবি তোলা শেষে আবার কোডাকের কাছে নিয়ে আসলে কোডাক সেগুলো ডেভেলপ করে গ্রাহককে দিত। কোডাকের ঐতিহাসিক শুরুটা এভাবেই।
কোডাকের দীর্ঘ পথচলায় ছিল শুধুই সাফল্য
বক্সটাইপ ক্যামেরার দুই বছর পর ১৮৯০ সালে কোডাক নিয়ে আসে প্রথম ফোল্ডিং ক্যামেরা। এর বছর পাঁচেক পর ১৮৯৫ সালে বাজারে আনে কোডাক পকেট ক্যামেরা, যার মূল্য ছিল পাঁচ ডলার। দুই বছর পর ১৮৯৭ সালে কোডাক নিয়ে আসে ফোল্ডিং পকেট ক্যামেরা। তাদের প্রত্যেকটি নতুন মডেলের ক্যামেরাই বাজারে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়।
ক্যামেরা থেকে কোডাকের লাভের চিন্তা কমই ছিল। লভ্যাংশের সিংহভাগই আসতো ফিল্ম বিক্রি থেকে। ১৮৯৮ সালে ইস্টম্যান প্রায় দশ লাখ ডলারে লিও ব্যাকল্যান্ডের কাছ থেকে কিনে নেয় ভেলক্স ফটোগ্রাফিক পেপারের প্যাটেন্ট।
তবে কোডাকের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটে, যখন ১৯০০ সালে কোডাক ব্রাউনি নামে খুবই সস্তা কার্ডবোর্ড বক্সের ক্যামেরা বাজারে আনে। ব্রাউনি খুবই জনপ্রিয় হয়, কারণ এটি মাত্র এক ডলারে পাওয়া যেত আর ব্যবহারও করা যেত সহজে। কোডাক ব্রাউনির একেকটি ফিল্ম রোলের দাম ছিল ১৫ সেন্ট। ১৯২০ সালে কোডাক নিজেদের ফটোগ্রাফিক ক্যামিকেল উৎপাদনের জন্য প্রতিষ্ঠা করে নিজস্ব ক্যামিকেল কোম্পানি, যা কোডাকের ব্যবসায় নতুন হাওয়া যোগ করে।
১৯৩২ সালে ৭৭ বছর বয়সে স্পাইন ডিজঅর্ডারের কারণে নিজ পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করেন জর্জ ইস্টম্যান। তার সুইসাইড নোটে লেখা ছিল, “বন্ধুরা, আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে, তবে আর দেরি কেন?” সফল ব্যবসায়ী এবং উদ্ভাবক ছাড়াও ইস্টম্যানকে একজন মহৎ মানুষ হিসেবেই দেখা হত। জানা যায়, তিনি প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ বিভিন্ন দাতব্য কাজে দান করেছিলেন।
যা-ই হোক, ইস্টম্যানের মৃত্যুর পর কোডাক থেমে থাকেনি। এর তিন বছর পর ১৯৩৫ সালে কোডাক উদ্ভাবন করে কোডাক্রম কালার ফিল্ম। কোডাক্রমের উদ্ভাবন কোডাককে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। ২০০৯ সালে উৎপাদন বন্ধ হওয়ার আগে প্রায় ৭৪ বছর প্রবল প্রতাপে কোডাক্রোম কালার ফিল্ম তার অধিপত্য বজায় রেখেছিল।
শুধু ফটোগ্রাফি নিয়েই পড়ে ছিল না কোডাক। সিনে কোডাক নামে মুভি ক্যামেরাও বাজারে আনে তারা ১৯২৩ সালের দিকে। পরবর্তীতে ১৯৫০ সালে কোডাকের ব্রাউনি আট মিলিমিটারের ভিডিও ক্যামেরা বাজারে আলোড়ন তুলতে সমর্থ হয়।
কোডাক তার সাফল্যের মুকুটে আরেকটি পালক যোগ করে ১৯৫৯ সালে ব্রাউনি স্টারমেটিক ক্যামেরা উদ্ভাবনের মাধ্যমে। যা সেসময় বিক্রি হয়েছিল দশ মিলিয়নের বেশি। এর কয়েক বছর পর ১৯৬৩ সালে কোডাকের চমক ছিল ইনস্টামেটিক ক্যামেরা, যা ছিল খুব সহজে ব্যবহারযোগ্য পয়েন্ট অ্যান্ড শ্যুট ক্যামেরা। ১৯৭০ সালের মধ্যে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ইনস্টামেটিক ক্যামেরা বিক্রি হয় পৃথিবীজুড়ে। এমনকি ২০১৪ সালেও কোডাক ইনস্টামেটিক ক্যামেরা উৎপাদন করেছে নতুন করে!
ফিল্ম ও ফিল্ম ভিত্তিক ক্যামেরা ব্যবসায় কোডাকের প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে ছিল শুধু জাপানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফুজিফিল্ম। কোডাক যেমন আমেরিকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করত, ফুজিফিল্ম তেমনই নিয়ন্ত্রণ করতো জাপানের বাজার, আর সারা দুনিয়ায় তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা তো ছিলই।
ডিজিটাল ক্যামেরা, কোডাকের আত্মঘাতী উদ্ভাবন!
১৯৭৫ সালে স্টিভেন স্যাসন উদ্ভাবন করেন ফিল্মবিহীন ডিজিটাল ক্যামেরা। স্যাসন ছিলেন কোডাকের একজন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু ফিল্মই যখন কোডাকের মূল ব্যবসা, তখন ফিল্মবিহীন ক্যামেরাকে স্বভাবতই কোডাকের কর্মকর্তারা স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ছিলেন না।
স্টিভেন স্যাসন নিউইয়র্ক টাইমসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ডিজিটাল ক্যামেরার বিষয়ে কোডাক কর্মকর্তাদের প্রতিক্রিয়া বলেছিলেন। যেহেতু সেটা ছিল ফিল্মবিহীন ফটোগ্রাফি, কোডাক কর্মকর্তাদের মন্তব্য ছিল, “এটা চমৎকার, কিন্তু কাউকে এর বিষয়ে কিছু বলো না!”
কোডাক কি বুঝতে পারেনি সামনের পৃথিবী হবে ডিজিটাল ফটোগ্রাফির? তারা আসলে তখন ফিল্মের বাইরে কিছু বুঝতেই চায়নি। কারণ কোডাক তখন ফটোগ্রাফির প্রত্যেকটি খাতে ব্যবসা করতো। ক্যামেরা, ফিল্ম, ফিল্ম ডেভেলপের ক্যামিকেল এবং ফটোগ্রাফিক পেপার- প্রত্যেকটি খাতে কোডাকের পণ্যই বাজার দখলে রেখেছিল।
স্টিভেন স্যাসন যখন তার উদ্ভাবিত ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়ে কোডাকের কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছিলেন, তখন তাদের উত্তর ছিল, “আমরা ১০০ বছর ধরে প্রিন্টের সাথে আছি, কেউই কখনো অভিযোগ করেনি যে এটি ব্যবয়বহুল। তো হঠাৎ সবাই তাদের ছবি টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে আগ্রহী হবে কেন?”
কোডাক চেয়েছিল অন্ধ হয়ে থেকে তাদের ফটোগ্রাফিক ফিল্মের ব্যবসা আরো কিছুকাল ধরে রাখতে। সেটাই কাল হয় তাদের জন্য। অন্ধ হলেও প্রলয় তো আর বন্ধ থাকে না। আর সেই প্রলয়ই ঘটে কোডাকের বেলায়।
কোডাকের বোধোদয় ও ডিজিটাল যাত্রা
ডিজিটাল ক্যামেরার উদ্ভাবন কোডাককে তেমন চিন্তিত করতে পারেনি, যা ছিল কোডাকের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। কোডাক এর পরবর্তী সময়টাতে বিভিন্নভাবে ব্যবসাকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, যেমন- ১৯৮০ সালের দিকে কোডাক দাঁড় করায় একটাচেম ক্লিনিক্যাল কেমিস্ট্রি টেস্টিং সিস্টেম, যা অতি অল্প সময়েই অধিকাংশ দেশের হাসপাতালগুলোতে জায়গা করে নেয়। ১৯৮২ সালে কোডাক আনে কোডাক ডিস্ক, যা ফিল্মের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেত। কিন্তু সেটা বাজারে সাড়া ফেলতে পারেনি। ১৯৮৮ সালে কোডাক ৫.১ বিলিয়ন ডলারে স্টার্লিং ড্রাগ কোম্পানি কিনে নিয়ে ঔষধ ব্যবসায়ও হাত বাড়ায়।
কিন্তু ডিজিটালকে শেষমেষ আর উপেক্ষা করতে পারেনি কোডাক। কারণ ১৯৮১ সালের দিকেই সনির মতো প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ক্যামেরা বাজারজাত শুরু করে। ডিজিটাল ক্যামেরার সাথে কোডাক প্রিন্টার, ফটোকপিয়ার ও কালি উৎপাদনের দিকে বিশালাকারের বিনিয়োগ করে। কোডাকের প্রিন্টারের দাম বেশি হলেও কালির দাম ছিল সস্তা। প্রচলিত অন্যান্য উৎপাদকরা যেখানে কম দামে প্রিন্টার ও বেশি দামে কালি বিক্রয় করে দীর্ঘমেয়াদী লাভের মডেল দাঁড় করেছিল, সেখানে কোডাকের বেশি মূল্যের প্রিন্টার ও কম দামের কালি বিক্রির ব্যবসায়িক মডেল সফলভাবে কার্যকর ছিল কষ্টসাধ্য। তাছাড়া এইচপি, এপসনের চেয়ে কোডাকের প্রিন্টারের মানও ছিল পিছিয়ে। অবশেষে এখানে আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়ে শতবর্ষী প্রতিষ্ঠানটি।
অবশেষে ১৯৯১ সালে কোডাক নিকনের সাথে মিলে নিয়ে আসে প্রথম প্রফেশনাল ক্যামেরা কোডাক ডিসিএস-১০০। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ এই তিন বছরে এই মডেলের ৯৬৭টি ক্যামেরা বিক্রি করতে পেরেছিল তারা।
একটু দেরি ও বিপর্যয়
কোডাক যখন যাত্রা করে ডিজিটালের পথে, ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ক্যামেরার বাজারে তখন সনি তো ছিলই, আরো ছিল ক্যানন, নিকন কিংবা অলিম্পাস; বাজার ভাগ হয়ে যাচ্ছিল সবার মধ্যেই। ডিজিটালকে উপেক্ষা করার মাধ্যমে কোডাক যে ভুলটি করে এ ধরনের ভুল কোডাকের প্রতিষ্ঠাতা ইস্টম্যান কখনোই করেননি। তিনি ফিল্মে যাওয়ার জন্য লাভজনক ড্রাই প্লেট ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছিলেন, এবং এমন সময় রঙিন ফিল্মে বিনিয়োগ করেছেন যখন তার গুণমান তখন কালো এবং সাদা চলচ্চিত্রের চেয়েও খারাপ ছিল।
যা-ই হোক, ২০০১ সালের দিকে ফিল্ম ব্যবসায় মন্দা দেখা দিলে কোডাক চেষ্টা করেছিল ডিজিটাল ক্যামেরায় আগ্রাসী মার্কেটিং করে সফল হওয়ার। কোডাক সে লক্ষ্যে প্রতিটি ক্যামেরায় প্রায় ষাট ডলার করে ভর্তুকিও দিচ্ছিল। ২০০৩ সালে তারা বাজারে নিয়ে আসে কোডাক ইজি শেয়ার ডিজিটাল ক্যামেরা ও ইজি শেয়ার প্রিন্টার, যা ছিল পৃথিবীর প্রথম ক্যামেরা ও প্রিন্টারের কম্বিনেশন। ওফটো নামে ফটো প্রিন্টিং সেবা দেওয়ার জন্য তারা একটি ফটো শেয়ারিং ওয়েবসাইটও তৈরি করেছিল, যা পরে কোডাক গ্যালারিতে রুপান্তরিত হয়। কিন্তু তা ব্যবসায়িক সফলতার মুখ দেখেনি।
২০০৪ সালের দিকেই কোডাকের ঐতিহ্যবাহী ফিল্ম ক্যামেরার দিন শেষ হয়ে আসে। তাদের সবচেয়ে লাভজনক খাতটি মুখ থুবড়ে পড়তে থাকলেও ২০০৫ সালের দিকে কোডাক ডিজিটাল ক্যামেরার মার্কেটেও আধিপত্য আনতে সমর্থ হয়। কিন্তু সবকিছুর পরে ২০১০ সালের দিকে ব্যবসায় মোটামুটি টিকে থাকলেও ক্যানন, সনি, নিকন সবারই পেছনে পড়ে যায় কোডাক।
২০১১ সালে কোডাকের শেয়ার মূল্য ৮০ ভাগ পড়ে যায়। বিশাল সংখ্যক কর্মী ছাটাই করতে হয় তাদের। ২০১২ সালে এসে ব্যবসায়িক মন্দা, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাওয়া, শেয়ার বাজারে ধস, নগট টাকার সংকট ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যায় ধুঁকতে থাকে কোডাক। অতঃপর ২০১২ সালের দিকে এসে ডিজিটাল ক্যামেরার উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। অবশেষে ২০১২ সালেই কোডাক বাধ্য হয় নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করতে।
কোডাক না পারলেও পেরেছিল ফুজিফিল্ম
আগেই বলা হয়েছে, সারা দুনিয়ায় কোডাকের একমাত্র যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ফুজিফিল্ম। দুটি কোম্পানিরই মূল ব্যবসা ছিল ফিল্মভিত্তিক। যখন কোডাকের এই দুরবস্থা, তখন কিন্তু কোডাকের একমাত্র ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী ফুজিফিল্ম বেশ সাফল্যের সাথেই তাদের ধকল কাটিয়ে ওঠে। কোডাক না পারলেও ফুজিফিল্ম কিভাবে ব্যবসায়িক ধকল কাটালো?
উত্তর হচ্ছে কোডাকের মতো ফুজিফিল্ম অন্ধ হয়ে থাকেনি, তারা যতটা পেরেছে ফিল্ম ব্যবসায়ের বাইরে টাকা ঢেলেছে সময় থাকতেই। ল্যান্ড ব্যবসা থেকে শুরু করে কসমেটিকস– সব জায়গায়ই ফুজিফিল্ম বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা ঢেলেছে। সেই সাথে ডিজিটালকেও ধারণ করেছে যতটা সম্ভব। আর সে কারণেই ফুজিফিল্ম এই যাত্রা সাফল্যের সাথে উতরে যায়।
কোডাকের বিপর্যয় যা শেখায়
যে প্রযুক্তির সাথে তাল মেলাতে না পারার অভিযোগ করা হয় কোডাকের বিরুদ্ধে, সেই কোডাকের সাথে কিন্তু এই অভিযোগ মোটেও যায় না, কারণ বছরের পর বছর ফটোগ্রাফিক প্রযুক্তিতে পথ দেখিয়ে এসেছে তারা। সবসময় গ্রাহকের চাহিদামতো পণ্য আর গ্রাহকবান্ধব ব্যবসায়িক পরিকল্পনা সাজিয়ে কোটি কোটি গ্রাহকের মন জয় করে এসেছে প্রায় শতাব্দীকাল। এতকিছুর পরেও কোডাকের বিপর্যয় থেকে সবচেয়ে যে বড় বিষয়টি আমরা শিখতে পারি তা হচ্ছে, ব্যবসায়িক ঝুঁকির যেকোনো সংকেতকে উপেক্ষা না করা। এমন উপেক্ষার মূল্য যে দেউলিয়া হয়েও দিতে হতে পারে তার ক্ষেত্রে কোডাকের চেয়ে আর মনে হয় কোনো ভালো উদাহরণ নেই।
তবে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই তার সাফল্যের জৌলুস একটি সময় পরে ফিকে হয়ে যায়, সেটাই বাস্তবতা। গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানই হয়তো টিকে থাকে বেশ কিছু সময় ধরে। পৃথিবীতে অসংখ্য পুরাতন প্রতিষ্ঠান হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, আবার তার জায়গা দখল করে নিচ্ছে হাজারো নতুন প্রতিষ্ঠান। তবে ব্যবসায় প্রতিনিয়ত সাফল্যকে ধরে রাখাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভোক্তার চাহিদা পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে নয়, বরং আগে থেকেই তাদের পরিবর্তনের সংকেত ধরে ফেলতে হয় এবং আগে থেকেই সেই মোতাবেক বদলাতে হয় নিজেদেরও। কোডাকের সিইও ড্যানিয়েল কার্প এ প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, “যদি আপনি দেখেন আপনি পরিবর্তন হওয়ার চাপ আপনার উপর রয়েছে তবে আপনি দেরি করে ফেলেছেন।”
আসলে উদ্ভাবনই বড় কাজ নয়, কাজ হচ্ছে তা নিয়ে ব্যবসা করাটা। মটোরোলা যেমন মোবাইল ফোন উদ্ভাবন করেও বাজার ধরতে পারেনি, কোডাকও ডিজিটাল ক্যামেরাকে তাদের পরিবর্তনের হাতিয়ার বানাতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাছাড়া কোডাকের ব্যবসায়িক মডেলে স্বল্পমূল্যে ক্যামেরা বিক্রয় করে ফিল্ম, ক্যামিকেল ও ফিল্ম ডেভেলপের মতো আনুষাঙ্গিক বিষয়গুলো থেকে বেশিরভাগ লভ্যাংশ তুলে আনতো তারা। কিন্তু এই মডেল অবশ্যই ডিজিটাল ক্যামেরার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। কোডাকের সাফল্যের ব্যবসায়িক মডেলও এই জায়গায় মার খেয়ে যায়।
কোডাকের বর্তমান অবস্থা
কোডাকের দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন ছিল তাদের ব্যবসায়িকভাবে স্বল্প পরিসরে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা। শেষমেষ তারা নিজেদের প্যাটেন্ট বিক্রি করে নগদ টাকার ব্যবস্থা করার প্রচেষ্টা চালায়। এখন প্রায় ছয় হাজারের মতো কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে কোডাক মূলত গ্রাফিক আর্টস, বাণিজ্যিক মুদ্রণ, প্রকাশনা, প্যাকেজিং, ইলেকট্রিক ডিসপ্লে, বিনোদন কিংবা বাণিজ্যিক ফিল্ম, মাইক্রো থ্রি-ডি প্রিন্টিংয়ের মতো ব্যবসা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বাজারে এনেছে স্মার্টফোনও। ফটোগ্রাফারদের জন্য ‘কোডাককয়েন’ নামে ক্রিপ্টোকারেন্সি চালুর ঘোষণাও করেছে কিছুদিন আগে।
ফিচার ইমেজ – লেখক