সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের দেশ ব্রিটেনে তৃতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে এসেছিলেন লিজ ট্রাস। বামপন্থী পারিবারিক পরিচয় থেকে উঠে এসেছিলেন ট্রাস, সংখ্যাগরিষ্ঠ কনজারভেটিভ সদস্যের ভোটে পেয়েছিলেন দলীয় নেতৃত্বের পাশাপাশি সরকারপ্রধানের দায়িত্বও। মার্গারেট থ্যাচারের স্মৃতি বার বার ফিরিয়ে আনা প্রধানমন্ত্রী ট্রাস একইসাথে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীও, মাত্র ছয় সপ্তাহের মাথায় দায়িত্ব ছাড়ছেন তিনি।
যুক্তরাজ্যের ৫৬ তম প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন গত কয়েক মাস ধরেই, বর্তমানেও আলোচনায় আছেন সরকার পতনের বিষয়টি নিয়ে। ৮১ হাজার কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যের ভোটে দায়িত্বে আসা লিজ ট্রাসকে কেন পদত্যাগ করতে হলো এত অল্প সময়ের ব্যবধানে?
অর্থনৈতিক বিপর্যয়
দেশে দেশে অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে। সফল অর্থনীতি কর্তৃত্ববাদী শাসনেরও বৈধতা তৈরি করে, অর্থনৈতিক বিপর্যয় পটপরিবর্তন ঘটাতে পারে যেকোনো শাসনব্যবস্থায়, পতন ঘটাতে পারে শাসকগোষ্ঠীর। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসকে যে ছয় সপ্তাহের মাথায় বিদায় নিতে হচ্ছে, তার প্রধান কারণ অর্থনীতি।
লিজ ট্রাস নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় থেকেই সরকারের আকার ছোট করার কথা বলছিলেন, বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ছাড় দিয়েছেন কর্পোরেট ট্যাক্সে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের অস্থিরতায় যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতেও ছিল টালমাটাল অবস্থা। ট্রাস প্রধানমন্ত্রী হয়েই ঘোষণা দিয়েছিলে বার্ষিক জ্বালানি খরচ কমিয়ে আনার।
ট্রাস সরকারের ঘোষণা ছিল ট্যাক্সমুক্ত শপিং সুবিধার, ছিল সমাজের উপরতলার মানুষের করহার কমানোর ঘোষণা। তার সরকারের ঘোষণা ছিল দেড় লাখ ইউরোর বেশি আয় করা ব্যক্তিদের ৪৫ শতাংশ করের বিধান প্রত্যাহারের, যুক্তি ছিল জীবনযাত্রায় ব্যয় বৃদ্ধি। সব মিলিয়ে ট্রাসের অর্থমন্ত্রী কোয়াজি কোয়ার্টেংক যে বাজেট ঘোষণা করেন, সেটি পরিচিতি পায় ক্ষুদ্র বাজেট নামে। বাজেটে ব্যাপক কর ছাঁটাইয়ের ফলে সরকার পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে সরকারকে ঋণ নিতে হতো, ট্রাস যেটি পরিশোধের পরিকল্পনা করছিলেন প্রত্যাশিত অর্থনৈতিক বুমের মাধ্যমে।
কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থকদের মধ্যে এই বাজেট ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় শুরুতে, রক্ষণশীল এস্টাবলিশমেন্ট এই বাজেটকে আখ্যা দেয় ‘সত্যিকারের টোরি বাজেট’ হিসেবে। ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রথম পাতায় একে শ্রেষ্ঠ বাজেট হিসেবে ফিচার লেখা হয়, ডেইলি মেইলেও প্রথম পাতায় একে বলা হয় বলিষ্ঠ আর সেরা বাজেট।
তাত্ত্বিকভাবে, এই বাজেট সমাজের উপরতলার মানুষের পক্ষে কাজ করার কথা ছিল, সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল ভূস্বামীদেরও। এই অংশই কনজারভেটিভ পার্টির সবচেয়ে কট্টর সমর্থক শ্রেণি।
কিন্তু, ব্রিটেনের এই বাজেট অর্থনীতিতে বিপর্যয় ডেকে আনে। ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ডের অবমূল্যায়ন শুরু হয়, কয়েকদিনের মধ্যেই পাউন্ডের দরপতন তৈরি করে নতুন রেকর্ড। সরকার বন্ড বিক্রির মাধ্যমে পরিস্থিতি সামালের চেষ্টা করলেও পরবর্তীতে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে ট্রাসের সরকার। বৈশ্বিক জ্বালানীর বাজারের অস্থিরতার দরুণ তৈরি হওয়া মূল্যস্ফীতির নতুন ঢেউ পড়ে যুক্তরাজ্যে, বাড়তে থাকে জীবনযাত্রার ব্যয়। ট্রাসের প্রচারণা টিম এই সংকটকে অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করে স্বাভাবিকরণের চেষ্টা করলেও জি৭ দেশগুলোর অর্থনীতির সূচক বলছিল- সবচেয়ে বেশি অব্যবস্থাপনা আর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাজ্যই।
পরিস্থিতি সামাল দিতে কোয়াজি কোয়ার্টেংকে বিদায় করতে হয় অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে, নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে আসেন জেরেমি হান্ট। হান্ট এসে কোয়ার্টেংকের পরিবর্তনগুলোকে বাতিল করেন, সরে আসেন ক্ষুদ্র বাজেটের ধারণা থেকেও। তিনি প্রমাণ করেন, ট্রাসের পরিকল্পনা ছিল ভুল। লিজ ট্রাসকেও জনসম্মুখে ক্ষমা চাইতে হয় ভুল নীতি গ্রহণের দায়ে।
রাজনৈতিক সংকট
ক্ষুদ্র বাজেট থেকে ইউ-টার্ন নিয়ে লিজ ট্রাস ক্ষমা চাইলেও যুক্তরাজ্যে শুরু হয় প্রথাগত রাজনৈতিক অস্থিরতা। একদিকে ট্রাস নিজের ম্যান্ডেট থেকে সরে গিয়ে ক্ষমতার বৈধতা হারাচ্ছিলেন, অন্যদিকে কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থক শ্রেণিও আর ভরসা পাচ্ছিল না সংকট সামাল দেওয়ার ব্যাপারে ট্রাসের নেতৃত্বের উপর, বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও বৈধতার প্রশ্ন ওঠে। অবস্থা সামাল দিতে ট্রাসকে পার্লামেন্ট দাঁড়িয়ে ঘোষণা করতে হয়, “I am a fighter, not a quitter.”
এই রাজনৈতিক সংকটের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেন কনজারভেটিভ পার্টির এমপিরাই, ট্রাসের মন্ত্রীসভার সদস্যরাই। যুক্তরাজ্যে যা পরিচিত ‘ব্যাকস্ট্যাবিং’ হিসেবে। কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বের অনাস্থার মুখে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে হয় লিজ ট্রাসকে।
ট্রাসের উত্তরসূরি কে?
লিজ ট্রাসের পদত্যাগের মধ্যে দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রের চিরন্তন দুর্বলতাগুলো আবার সামনে এসেছে। ট্রাস কনজারভেটিভ পার্টির ম্যান্ডেট নিয়ে আসলেও তার পাবলিক ম্যান্ডেট ছিল না। ট্রাসের যিনি উত্তরসূরি হচ্ছেন, তারও পাবলিক ম্যান্ডেট থাকবে না।
ট্রাসের সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছিল ঋষি সুনাকের নাম। আলোচনায় ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আর সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী পেনি মরডান্ট। আলোচনায় ছিলেন বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেশও। তিনজন এমপি তাদের একশো সহকর্মীর সমর্থন নিশ্চিত করতে পারলে এমপিরা ভোট দিয়ে তা দুজনে নামিয়ে আনবেন এবং পরবর্তীতে কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যরা তাদের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করতো। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত ঋষি সুনাক ছাড়া কেউই প্রার্থিতা ঘোষণা না করায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঋষি সুনাকই টোরিদের নেতা নির্বাচিত হয়েছেন, তিনিই দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে।