আগস্ট ২১, ২০২৩। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার ক্রাউন কোর্ট।
তিল ধারণের জায়গা নেই আদালতে। ভুক্তভোগী বাবা-মায়েদের অধিকাংশই উপস্থিত, কেউ কেউ ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। আসামীর দোষ প্রমাণ হয়েছে আগেই, কিন্তু এখনো শাস্তি ঘোষণা করেননি বিচারক।
গম্ভীর মুখে এজলাসে নিজের আসন গ্রহণ করলেন অভিজ্ঞ বিচারক জেমস গস (James Goss)। আসামী লুসি লেটবির কুকীর্তি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলেন তিনি। এরপর জানিয়ে দিলেন তার রায়। মৃত্যু পর্যন্ত জেলে পচতে হবে লেটবিকে, প্যারোলের কোনো সুযোগ পাবেন না তিনি। ইংল্যান্ডের আইনে এর থেকে কঠিন শাস্তি আর নেই, এবং তার আগে এই দণ্ড পেয়েছেন কেবল তিনজন মহিলা।
কে এই লুসি লেটবি?
বর্তমানে ৩৩ বছর বয়স্ক লুসি লেটবি পেশায় রেজিস্টার্ড নার্স, কাজ করেন ইংল্যান্ডের উত্তরে চেস্টার শহরে। তার বাবা জন লেটবি আর মা সুসান। ১৯৯০ সালের ৪ জানুয়ারি হারফোর্ডে তার জন্ম। স্কুল শেষ করে ২০১১ সালে চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নার্সিং ডিগ্রি নেন লেটবি। এক বছর পরে যোগ দেন কাউন্টেস অব চেস্টার হাসপাতালের নবজাতক বিভাগে। পরবর্তী চার বছর একটানা এই বিভাগেই ছিলেন তিনি।
ইউনিটে পরিশ্রমী বলে বেশ সুনাম ছিল লেটবির। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বেশ সক্রিয় তিনি, প্রায়ই বন্ধুবান্ধব আর সহকর্মীদের নিতে বাইরে ঘুরতে যান, ছবি তোলেন। একাকী থাকেন, তাই ছুটিছাটায় নিজে থেকেই সহকর্মীদের ডিউটি নিয়ে নেন। স্থানীয় এক পত্রিকা নবজাতক ইউনিট নিয়ে ফিচার করলে সেখানে ছবির জন্য তাকেই নির্বাচন করে হাসপাতাল। ইউনিটের জন্য ৫ মিলিয়ন ডলারের চাঁদা তোলার যে ক্যাম্পেইন হয়, সেখানেও ছিল লেটবির সরব উপস্থিতি।
ভয়াবহ এক সন্দেহ
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে সব রোগী হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফেরেন না, নবজাতক বিভাগও ব্যতিক্রম নয়। মাত্র কয়েকদিন আগে পৃথিবীর আলো দেখেছে এমন শিশুদের মৃত্যুর থেকে কষ্টকর কিছু কমই আছে। কিন্তু এই এই ইউনিটে কাজ করা ৩০ জন নার্স আর ৭ জন শিশু বিশেষজ্ঞের এটা জীবনের অংশ। ২৪ ঘণ্টা ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের সেবা দিয়ে যান তারা, যাদের অনেকেই পৃথিবীতে এসেছে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে। তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সিংহভাগ বাবা-মা হাসিমুখে বাড়ি ফিরে যান, বছরে গড়ে ১-৩টি শিশুর ক্ষেত্রে সফল হতে পারেন না তার।
২০১৫ পর্যন্ত এই ছিল শিশুমৃত্যুর হার, যা পরিসংখ্যান অনুযায়ী স্বাভাবিকের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু সেই বছর থেকে পরবর্তী ১৮ মাস আকাশচুম্বী হয়ে যায় মৃত্যুর সংখ্যা। ২০১৫ সালের জুনে ছয় দিনের এক নবজাতক মারা যায়। ২৮ ঘণ্টা পর একই পরিণতি হয় তার যমজ বোনের। পরের কয়েকদিনে কোল খালি হয় আরো দুই দম্পতির। অথচ চিকিৎসকেরা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন এরা সকলেই সুস্থ হয়ে উঠবে। এমন ঘটনা প্রায় নিয়মিতই ঘটতে থাকে এরপর।
প্রাথমিক তদন্ত
ইউনিটের শিশু বিশেষজ্ঞ স্টিফেন ব্রিয়ারি উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। কী ব্যাপার? হঠাৎ করেই এরকম হচ্ছে কেন? জুনের মারা যাওয়া শিশুদের ফাইল নিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন তিনি, কিন্তু এমন কিছু পাওয়া গেলনা যা থেকে মৃত্যুর কারণ অনুমান করা যায়। তাহলে কি সেবাদানে কোনো ঘাটতি ছিল?
ব্রিয়ারি কাগজপত্র থেকে দেখতে পেলেন সবার ক্ষেত্রেই দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্স ছিলেন লুসি লেটবি। তবে তিনি বাচ্চাদের খুন করেছেন বলে সন্দেহ করার কারণ ছিল না বিশেষজ্ঞের। তার ধারণা ছিল কাজে হয়তো কোনো গাফিলতি হয়েছে তার। তবে অধিকাংশ সহকর্মীর ধারণা ছিল এটা নিছকই কাকতাল। নার্সিং বিভাগের প্রধান অ্যালিসন কেলির সাথে ব্রিয়ারি কথা বললে তিনিও একই মনোভাব ব্যক্ত করেন।
কিন্তু মৃত্যু তো বেড়েই চলেছে। আরেকজন বিশেষজ্ঞ রবি জয়রাম অক্টোবরে আবারো নার্সিং প্রধানকে বিষয়টা খতিয়ে দেখতে অনুরোধ করেন। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাতের দাবী জানান বিশেষজ্ঞরা। সেই সাক্ষাত হয় তিন মাস পরে। ২৭ জুন লেটবিকে ইউনিট থেকে সরিয়ে প্রশাসনিক কাজে দেয়া হয়।
লেটবি হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালেন, তাকে অন্যায়ভাবে বলির পাঠা বানানো হচ্ছে। পরের বছর জানুয়ারিতে ব্রিয়ারি আর জয়রামসহ বেশ কয়েকজন চিকিৎসককে নির্দেশ দেয়া হয় লেটবির কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে।
পুলিশের আগমন
২০১৭ সালে কর্তৃপক্ষ দেরিতে হলেও আনুষ্ঠানিক তদন্ত আরম্ভ করে। ২০১৫ থেকে ২০১৬ এই এক বছরে নবজাতক বিভাগে ১৫টি শিশুমৃত্যু শনাক্ত করেন তারা। হাসপাতালের বাইরের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সব ফাইল পরীক্ষা করা হয়, তারাও বলে দেন মৃত্যুর স্বাভাবিক কোনো কারণ খুঁজে পাননি তারা।
অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে সন্দেহ করে মে-তে খবর দেয়া হলো চেস্টার পুলিশকে। তদন্তকারি অফিসার পল হিউজেস এসে কী করল বলুন তো? সব চিকিৎসক আর নার্সকে ধরে জেলে পুরে দিলেন? না, কারণ তিনি এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন! আগে তো তাকে নিশ্চিত হতে হবে যা ঘটছে সেটা সত্যিকারেই অস্বাভাবিক। আর সেটা করতে গেলে আমজনতার সাথে কথা বললে তো হবে না, পরামর্শ নিতে হবে বিশেষজ্ঞদের।
পল প্রথমে ব্রিয়ারি আর জয়রামের সাথে বসলেন। জানতে পারলেন লেটবিকে প্রশাসনিক কাজে দেয়ার পর মৃত্যুহার কমে এসেছে। তবে তার দোষ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হতে পারলেন না পল। যদি এমন হয় যে কোনো সহকর্মী তাকে ফাঁসাতে চেষ্টা করছে!
পুলিশ একজন প্রখ্যাত নবজাতক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়। সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখে তিনি তার সন্দেহ ব্যক্ত করলেন- প্রাকৃতিক কারণে মারা যায়নি এই শিশুরা। আরো কয়েকজনের মতামত নেয়া হলো, সবাই তার কথাই সমর্থন করলেন।
অপারেশন হামিংবার্ড
পুলিশ যখন নিশ্চিত হলো নৃশংস এক খুনি অসহায় নবজাতকদের খুন করে চলেছে, তখন আদাজল খেয়ে মাঠে নামল তারা, সূচনা হলো অপারেশন হামিংবার্ডের। খুব দ্রুতই পুলিশ বের করল মারা যাওয়া প্রতিটি শিশুর দায়িত্বে থাকা নার্সের নাম লুসি লেটবি।
২০১৮ সালের জুনে লেটবিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। জুলাইতে গ্রেফতার করা হলেও পরে ছেড়ে দেয়া হয় তাকে। এক বছর পর দ্বিতীয়বার আটক হন তিনি, কিন্তু এবারও লেটবিকে মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। অবশেষে ২০২০ সালের নভেম্বরে ৭ নবজাতককে খুন আর ১০ জনকে হত্যাচেষ্টার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করার পর তাকে নেয়া হয় রিমান্ডে ।
পুলিশ লেটবির বাড়ি তল্লাশি করে। হাসপাতালের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি পাওয়া যায়, যা বাসায় নিয়ে যাওয়া ছিল নিয়মবহির্ভূত। এসব নথির অনেকগুলোই মৃত নবজাতকদের ফাইল। কম্পিউটার ঘেঁটে জানা যায় লেটবি এদের বাবা-মায়ের ব্যাপারেও সোশ্যাল মিডিয়াতে খোঁজাখুঁজি করেছেন।
তার স্বহস্তে লেখা কাগজও উদ্ধার করে পুলিশ। সেখানে লেখা ছিল, বাচ্চাদের হত্যা করেছি কারণ আমি তাদের যত্ন নিতে সক্ষম ছিলাম না। আমার বাঁচার কোনো অধিকার নেই! দ্রুত তাকে আদালতে চালান করে দেয়া হয়।
বিচার ও দণ্ড
২০২২ সালের অক্টোবরে জুরি সিস্টেমে আরম্ভ হয় লেটবির বিচার। ২২টি অভিযোগ দায়ের করা ছিল তার বিরুদ্ধে। ১২টি হত্যা এবং ১০টি হত্যাচেষ্টা। লেটবি প্রত্যেকটি অভিযোগ অস্বীকার করেন। দশ মাস ধরে চলে সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন, আনা হয় ৩০০ সাক্ষী। লেটবির বাবা-মা পুরো সময়ই আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
সরকারি উকিল নিকোলাস জনসন, আর আসামীর পক্ষে দাঁড়ান বেন মায়ার্স। লেটবি নিজেও সাক্ষ্য দেন। তিনি জানান যেসব শিশু মারা গেছে তারা প্রত্যেকেই খুন অসুস্থ ছিল। স্বল্প সংখ্যক যেসব নার্স তাদের যত্ন নিতে পারতেন লেটবি তাদেরই একজন, সুতরাং প্রতিটি ঘটনায় তার দায়িত্বে থাকার যুক্তসঙ্গত ব্যাখ্যা রয়েছে।
পুলিশের খুঁজে পাওয়া কাগজের ব্যাপারে লেটবি জানান মানসিক পীড়া থেকে এই লেখা লিখেছিলেন তিনি, যখন সন্দেহের বশে তাকে ইউনিট থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। মৃত্যুর কারণ হিসেবে দক্ষ জনবল এবং সঠিক নীতিমালার অভাবকে দায়ী করেন তিনি। তার অভিযোগ অনেকাংশে সত্যি, নবজাতক ইউনিটে যথেষ্ট প্রশিক্ষিত লোকবল ছিল না, যে কারণে বারবার লেটবিকেই দায়িত্ব দিতে হচ্ছিল। তার উকিল বেন মায়ার্সও জোর দেন হাসপাতালের দায়ের ওপর, দাবী করেন তার মক্কেল যে খুন করেছেন সেটা শক্তভাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ।
জনসন ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেন জুরিদের সামনে। তিনি পরিসংখ্যান দিয়ে প্রমাণ করেন ২০১৫ সালের আগপর্যন্ত চেস্টারের নবজাতক ইউনিটের মৃত্যুহার অন্যান্য হাসপাতালের মতোই ছিল, কিন্তু এরপর সেটা হঠাৎ বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞ প্যানেল যে এই বৃদ্ধিকে অস্বাভাবিক বলে মত দিয়েছেন সেটাও উল্লেখ করেন তিনি। সবার যুক্তি পেশের পর ২২ দিন সময় নেন জুরি। এই বছর ১৮ আগস্ট লুসি লেটবিকে ২২টি অভিযোগের মধ্যে ১৪টির জন্য দোষী সাব্যস্ত করেন তারা। এর পাঁচ দিন পর দণ্ড পড়ে শোনান জাজ গস। লেটবিকে ঠাণ্ডা মাথার খুনি বলে উল্লেখ করেন তিনি। তার জন্য বরাদ্দ করেন আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি।
বলে রাখা ভাল, শেষ পর্যন্ত নিজেকে নির্দোষ দাবী করে গেছেন লেটবি, এবং রায় ঘোষণার সময় অনুপস্থিত ছিলেন তিনি ও তার বাবা-মা। ইংল্যান্ডের আইনে এটা আসামী করতে পারেন। তবে এই অনুপস্থিতি নিয়ে সৃষ্টি হয় তুমুল বিতর্কের। ভুক্তভোগী বাবা-মায়েরা চেয়েছিলেন লেটবি সশরীরে আদালতে থেকে দণ্ড শুনবেন। প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক জানিয়েছেন দোষী ব্যক্তি যাতে রায় ঘোষণার সময় আদালতে থাকতে বাধ্য হন সেজন্য আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে।
কেন?
এই প্রশ্নই সবাইকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ঠিক কী কারণে জঘন্য এই কাজ করলেন লেটবি? তার মানসিক সমস্যার কোনো লক্ষণ নেই। ছেলেবেলা, দৈনন্দিন জীবন কোনোখানেই এমন কিছু পাওয়া যায়নি যা তাকে ঠেলে দিতে পারে ধ্বংসাত্মক এই পথে। বিচার চলাকালে তাই কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হয়েছে সরকারি উকিলকে। বেশ কিছু ব্যাখ্যা হাজির করলেও নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি তিনি।
বিবাহিত এক চিকিৎসকের প্রতি লেটবির দুর্বলতাকে একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন উকিল। শুনতে যত অদ্ভুত লাগুক না কেন, তার কথা অনুযায়ী সেই চিকিৎসকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে একের পর এক খুন করেছেন তিনি। তাকেও সাক্ষী দিতে ডাকা হয়েছিল। পর্দার আড়ালে থাকলেও ভদ্রলোকের কণ্ঠ শুনে চিনে ফেলেন লেটবি, এরপরেই ভেঙে পড়েন কান্নায় । তবে লেটবির ব্যাখ্যা অনুযায়ী এই কান্নার কারণ ভালবাসার মানুষের থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার জন্য নয়, বরং বিশ্বস্ত বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা।
লেটবির কুকর্মের অন্যান্য যে কারণ তুলে ধরা হয় সেসবের মধ্যে ছিল এখান থেকে অদম্য উত্তেজনা অনুভব করতেন তিনি, অথবা কারো জীবন-মৃত্যু নিয়ে খেলার ক্ষমতা দেখিয়ে মনে মনে নিজেকে তুলতেন ঈশ্বরের উচ্চতায়।
হাসপাতালের দায়
লেটবি নাহয় কারাগারে, কিন্তু হাসপাতাল কি দায় এড়াতে পারে? ভুক্তভোগী অনেক বাবা-মা অভিযোগ করেছেন নার্সের ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশের পরেও ব্যবস্থা নেয়নি তারা। ব্রিয়ারি আর জয়রাম সন্দেহ প্রকাশ করার পরেও কিন্তু যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সঠিক সময়ে বিষয়টি তদন্ত করেনি হাসপাতাল। কে জানে, সেটা করলে হয়তো ঠেকানো যেত পরবর্তী ঘটনাগুলো!