নতুন করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে ২০২০ সালের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৫৬ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। তারপর থেকেই গোটা চীনে ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসটি। এমনকি চীনের বাইরে দশটিরও বেশি দেশে এই ভাইরাসে সংক্রমিত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। বেশিরভাগই এশীয় রাষ্ট্র। তারা হচ্ছে- জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, নেপাল, ভিয়েতনাম, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডা। আক্রান্তদের সিংহভাগ ব্যক্তিরই চীনে, বিশেষ করে উহান শহরে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিল।
চীনে এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত করা হয়েছে এখন পর্যন্ত প্রায় ২,০০০ জন। তবে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি। তাই শুধু চীন নয়, সমগ্র বিশ্বই এ ভাইরাস নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইতোমধ্যে চীনসহ অন্যান্য রাষ্ট্র ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিহত করতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত।
করোনা ভাইরাস কী?
করোনা ভাইরাস নির্দিষ্ট কোনো ভাইরাস নয়। বরং এটি একটা ভাইরাস পরিবারকে বোঝানো হয়, যাতে অসংখ্য ভাইরাস আছে। তবে এ পরিবারের মাত্র ছয়টি ভাইরাসই মানুষকে সংক্রমণ করতে পারত। নতুন ভাইরাস নিয়ে এ সংখ্যা দাঁড়ালো সাতে। নতুন ভাইরাসের নাম দেয়া হয়েছে ‘২০১৯ নভেল করোনা ভাইরাস বা এনসিওভি (2019-nCoV)‘।
করোনা ভাইরাসের আক্রমণ এবারই প্রথম নয়। চীনেই ২০০২ সালে আরেকটি করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছিল। এর নাম সিভিয়ার একিউট রেস্পিরেটরী সিনড্রোম বা সার্স করোনা ভাইরাস। এতে ৮,০৯৮ জন আক্রান্ত হয় এবং ৭৭৪ জন মারা যায়। ২০০৪ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি আর পাওয়া যায়নি। এছাড়া, ২০১২ সালে সৌদি আরবে আরেকটি করোনা ভাইরাস ছড়ায়, যার নাম ছিল মিডল ইস্ট রেস্পিরেটরী সিন্ড্রম বা মার্স করোনা ভাইরাস। এতে এখন পর্যন্ত প্রায় ২,৫০০ জন আক্রান্ত হয়ে ৮২৪ জনের মৃত্যু হয়। এরা প্রত্যেকেই ফুসফুসজনিত রোগের লক্ষণ প্রকাশ করে।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগের লক্ষণ
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগ শুরু হয় জ্বর দিয়ে, এরপর শুরু হয় শুকনো কাশি। এক সপ্তাহ পর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তখন অনেক রোগীরই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন পড়ে। প্রতি চারজন আক্রান্ত ব্যক্তির একজনের রোগের তীব্রতা বেশি। সার্স ভাইরাসের লক্ষণের সাথে এর কিছুটা মিল থাকলেও বেশ কিছু পার্থক্য আছে। সার্স ভাইরাসে আক্রান্তদের শতকরা ২০ ভাগ রোগীর সর্দি, হাঁচি, গলা ব্যথা, ডায়রিয়া থাকলেও নতুন করোনা ভাইরাসে এসব লক্ষণ নেই। বৃদ্ধ ও নবজাতক শিশু, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তাদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস রোগ হতে পারে নতুন করোনা ভাইরাস থেকে।
করোনা ভাইরাসের উৎস
করোনা ভাইরাস আক্রান্ত প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায়। সার্স ভাইরাস ছড়িয়েছিল বাদুড় ও গন্ধগোকুল বিড়াল থেকে। মার্স ভাইরাস ছড়িয়েছিল উট থেকে। নতুন করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে উহান শহরে অবস্থিত দক্ষিণ চীন সাগরের সামুদ্রিক খাবারের পাইকারি বাজার থেকে। সেখানে সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাংস ছাড়াও জীবন্ত মুরগী, সাপ, খরগোশ, বাদুড়- এসব প্রাণীও উৎস হতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।
যেভাবে ছড়ায় এ ভাইরাস
করোনা ভাইরাস সংক্রমিত প্রাণীর সাথে মানুষের সংস্পর্শে এই ভাইরাস ছড়ায়। এরপর একজন মানুষ থেকে বিভিন্ন উপায়ে অন্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। একে বলা হয় তৃতীয় প্রজন্ম সংক্রমণ। শুরুতে চীনা প্রশাসন জানিয়েছিল, এ ভাইরাস প্রাণী থেকে মানুষে আসলেও মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, প্রতি একজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দুই থেকে তিনজন ব্যক্তির কাছে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া এই ভাইরাস বিবর্তিত হচ্ছে, যার কারণে আরো দ্রুত ও সহজে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে।
মানুষ থেকে মানুষে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে–
- হাঁচি-কাশির মাধ্যমে বাতাস থেকে।
- আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা, যেমন- শারীরিক স্পর্শ বা করমর্দন করলে।
- ভাইরাস আছে, এমন বস্তুতে হাত রেখে পরে সে হাত নিজের শরীরে স্পর্শ করলে। হাত না ধুয়ে মুখ, নাক বা চোখে স্পর্শ করলে।
ধারণা করা হচ্ছে, আক্রান্ত ব্যক্তি যতজন শনাক্ত করা হয়েছে, প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি। কারণ, লক্ষণ প্রকাশ পায়নি এমন রোগী আছে প্রচুর।
চিকিৎসা
করোনা ভাইরাসের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। বেশিরভাগ রোগী এমনিতেই সুস্থ হয়ে যাবেন। তাই এর চিকিৎসা মূলত বিশ্রাম নেয়া আর জ্বর ও ব্যথার ওষুধ খাওয়া। এছাড়া কাশির জন্য গরম পানি দিয়ে গোসল করা যেতে পারে। একইসাথে প্রচুর পরিমাণ তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। বেশি অসুস্থ অনুভূত হলে হাসপাতালে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
প্রতিরোধ
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য এখনো কোনো ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কার হয়নি। তাই এই ভাইরাস প্রতিহত করার জন্য একমাত্র উপায় হলো, সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে ভাইরাস ছড়ানো প্রতিরোধ করা। এজন্য কিছু সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন বা সিডিসি-এর তথ্যানুযায়ী সুস্থ ব্যক্তিদের-
- সাবান এবং পানি দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড সময় নিয়ে হাত ধুতে হবে।
- হাত না ধুয়ে নিজের মুখ, চোখ কিংবা নাকে স্পর্শ করা যাবে না।
- যারা এ ভাইরাসে আক্রান্ত, তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে।
এছাড়া নিজে ঠাণ্ডায় আক্রান্ত হলে যেভাবে সাহায্য করবেন-
- অসুস্থ অনুভূত হলে বাড়িতে অবস্থান করতে হবে।
- অন্যদের সাথে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে যাওয়া যাবে না।
- হাঁচি-কাশি যখন আসবে, তখন টিস্যু দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে হবে। তারপর টিস্যুটি ময়লা রাখার স্থানে ফেলে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে।
- প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে।
চীন কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে চীন তীব্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। উহান মিউনিসিপাল হেলথ কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সাতটি হাসপাতালে শুধুমাত্র জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেয়া হবে। এতে ৩,০০০ এরও বেশি শয্যার ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া ২৪ জানুয়ারি চীন কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে, তারা ছয়দিনের মধ্যে এক হাজার শয্যার একটি হাসপাতাল নির্মাণ করবে শুধুমাত্র করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেয়ার জন্য।
চীন সরকার উহান শহর থেকে যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছে। উহান ছাড়াও এর নিকটবর্তী ১২টি শহর থেকেও লোকজন অন্য কোনো শহরে যেতে পারবে না। এতে প্রায় ৩৬ মিলিয়ন মানুষ কার্যত শহরবন্দী। উহান শহরে সাময়িকভাবে বিমানবন্দর ও রেলওয়ে স্টেশন বন্ধ আছে। এক কোটিরও বেশি জনসংখ্যার শহরে গণপরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ রাখা হয়েছে। হোটেল, রেস্তোরাঁ, শপিং মল, পার্ক, ক্যাফে এসব জায়গায় মাস্ক পরে চলা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া চীনের যেকোনো জায়গায় বন্য প্রাণী সম্পর্কিত সব বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
চীনের চন্দ্রবর্ষ উদযাপনও সীমিত করা হয়েছে। বেইজিংয়ে বড় পরিসরে উৎসবের আয়োজন বাতিল করা হয়েছে। হংকংয়েও উৎসব বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া সাংহাইয়ে অবস্থিত ডিজনি থিম পার্কও পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে।
বিশ্ব যেভাবে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিচ্ছে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাসের জন্য চীনে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এখনো সেরকম পর্যায়ে যায়নি বলছে। তবে খুব দ্রুতই যে ছড়িয়ে যাবে, তার আশঙ্কাও আছে। তাই বিভিন্ন দেশ এখনই সতর্কতা অবলম্বন করছে।
সিঙ্গাপুর, হংকং, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ বিমানবন্দরে চীন থেকে আগত যাত্রীদের স্ক্রিনিং করছে। যদিও এটি কতটুক কার্যকর হচ্ছে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ আছে। কারণ, করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তির লক্ষণ প্রকাশ পেতে পেতে পাঁচদিন সময় লাগে। এ সময়ে যেকোনো সংক্রমিত ব্যক্তি অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারবেন।