অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি বিশ্বের প্রথম সারির বুদ্ধিজীবীদের একজন। তিনি একশটিরও বেশি বই লিখেছেন। বর্তমানে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের লরিয়েট অধ্যাপক এবং এমআইটির ভাষাতত্ত্ব ও দর্শন বিভাগের এমিরেটাস অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন। সম্প্রতি তিনি কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ প্রসঙ্গে। সেখানে তিনি কথা বলেছেন পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়ে, আমেরিকান সংস্কৃতি কীভাবে অন্য দেশগুলোর সংকট নিয়ে উদাসীনতা দেখাতে সাহায্য করে, এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কীভাবে এই সংকট সৃষ্টি করেছে, সেগুলো নিয়ে। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়া হলো।
আপনি প্রায়ই বলেন, জলবায়ু বিপর্যয় এবং পারমাণবিক অস্ত্র ও যুদ্ধ- এই দুটি বিষয় মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় হুমকি। আমরা আপনার কাছ থেকে পারমাণবিক অস্ত্র ও যুদ্ধের ব্যাপারে জানতে চাই। আমি শুরুটা করতে চাই একটু ভিন্নভাবে। আমি ১৯৪৫ সালের সময়টায় ফিরে যেতে চাই। সম্প্রতি ডেনিয়েল এলসবার্গের দ্য ডুমসডে মেশিন বইটা পড়ছিলাম। সেখানে তিনি বলেন, তিনি যখন স্কুলে মাধ্যমিক পর্যায়ে ছিলেন, তাকে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছিল- পুরো শহর ধ্বংস করে দিতে পারে, এমন একটা নতুন বোমা তৈরি করার সম্ভাব্যতা নিয়ে। তিনি লিখেন, তার ক্লাসের সবাই সেই বোমা নিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট লিখেছিলেন। যেখানে তারা সবাই একমত হন, এই বোমা যদি আবিষ্কার হয়, তাহলে তা মানব সভ্যতার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে; তাই একে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিতে হবে। এর কয়েক বছর পরেই বোমাটি ব্যবহৃত হয়। আপনার সাথে আলোচনার শুরুটা করতে চাই ওই সময়টা নিয়ে। আপনি পারমাণবিক হুমকির যুগের শুরুটা প্রত্যক্ষভাবেই দেখেছেন। হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে যে ভয়ংকর পরিণতির শুরু হয়, আপনি ওই সময়টার কথা মনে করতে পারেন? পুরো বিশ্বে কেমন প্রতিক্রিয়া ছিল?
চমস্কি: আমি খুব ভালো করেই ওই সময়ের কথা মনে করতে পারি। আমি একটা সামার ক্যাম্পের জুনিয়র কাউন্সেলর হিসাবে তখন কাজ করছিলাম। একদিন সকালবেলা ক্যাম্পের লাউড স্পিকারে ঘোষণা শুনতে পাই, হিরোশিমাতে একটা পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে, এবং তা শহরটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সবাই সকালবেলার কর্মসূচি অনুযায়ী বেসবল খেলা, সাঁতার কাটা এসবে চলে গেল। কিন্তু আমি খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না ঘটনাটা। প্রথমত, কেউ ঘটনার বিস্তারিত না জানলেও পুরো ছবিটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। তাই এটা যে এক বিরাট উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দ্বিতীয়ত, ঘটনাটা নিয়ে ওই সময় সবার প্রতিক্রিয়া দেখে আমি হতাশ হয়ে পড়ি। এটা ছিল আরো ভয়াবহ।
আমি এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি যে, আমি ক্যাম্প ত্যাগ করে জঙ্গলে একা হাঁটতে থাকি; সেখানে বসে ঘণ্টাখানেক ধরে এটা নিয়ে চিন্তা করতে থাকি। খুব ভালো করেই উপলব্ধি করছিলাম- মানবসভ্যতা এমন উন্নতির শিখরে পৌঁছে গেছে যে, এখন সমগ্র পৃথিবীর প্রাণীদের ধ্বংস করে দিতে পারে। আসলে তখনও যায়নি; আমি বোঝাতে চাচ্ছি পারমাণবিক বোমার সামর্থ্যেও সীমাবদ্ধতা ছিল। হিরোশিমার বোমা হামলার চেয়ে এর দুই মাস আগে, টোকিওর অগ্নিবোমা বিস্ফোরণগুলো কোনো অংশে কম ছিল না। তীব্রতার ক্ষেত্রে সম্ভবত টোকিওর হামলাকে অতিক্রম করে যেতে পারেনি। তবে এটা নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল যে, বোতলে বন্দি থাকা দৈত্য বেরিয়ে এসেছে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নতির এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, এখন সবকিছু ধ্বংস করে দেওয়ার ধারণ ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে। ১৯৫৩ সালে এমন পর্যায়েই চলে গিয়েছিল। তখন থার্মোনিউক্লিয়ার বোমার ব্যবহার হয়। ওই সময় আমার অনুভূতি হচ্ছিল, আমরা হেরে গেছি। আমি বোঝাতে চাচ্ছি, আমাদের বুদ্ধিমত্তা যদি নৈতিকতার চেয়ে অনেক দূরে এগিয়ে যায়, তখন দুই ক্ষেত্রের পার্থক্য কমিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা এসব ঘটনার পরবর্তী প্রতিক্রিয়াগুলো দেখলেই তা উপলব্ধি করতে পারি। আসলে কেউই পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের ভয়াবহতাকে পাত্তা দেয়নি।
আমেরিকানদের নিয়ে একটা গভীর উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, যুদ্ধক্ষেত্রের প্রকৃত বাস্তবতার সাথে তাদের কথাবার্তার কোনো সামঞ্জস্য না থাকা। খবরে যখন বলা হয়, “একটা শহর ধ্বংস হয়ে গেছে”, এতে আসলে প্রকৃত ঘটনাটা ফুটে ওঠে না। যখন যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি আর প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ আসা শুরু হয়, তখন আমরা বুঝতে পারি আসলে কী ঘটছে। কিন্তু যারা যুদ্ধের ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন, তারা মনে হয় আলোচনার বাইরেই থাকেন। উদাহরণস্বরূপ বর্তমান সময়ের কথা বলা যায়। আমরা কিছু অনর্থক কথাবার্তা দেখতে পাই যেখানে লোকজন বলে, “হ্যাঁ, রাশিয়ার সাথে সামরিকভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াটা ভালো উদ্যোগ হবে; কিন্তু এতে পারমাণবিক হামলার ঝুঁকিও থাকবে।” প্রকৃতপক্ষে এরকম পরিস্থিতির কারণে সাধারণ মানুষের কী পরিণতি হবে, তা নিয়ে এদের জ্ঞানের অনেক অভাব দেখা যাচ্ছে।
চমস্কি: আমি আপনাকে আমার জীবনের একটা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শোনাতে চাই। সম্ভবত ১৯৫১-৫২ সালের দিকে, আমি আর আমার প্রথম স্ত্রী তখন স্নাতক শিক্ষার্থী ছিলাম। এক সন্ধ্যায় আমরা ঠিক করি সিনেমা দেখতে যাব। আমরা যখন হলে সিনেমার বিজ্ঞাপন দেখছিলাম, অবাক হয়ে দেখি ‘হিরোশিমা’ নামের একটা সিনেমার বিজ্ঞাপন। এটা একটু অবাক হওয়ার মতো ঘটনা ছিল। আমরা থাকতাম বোস্টনে, আর সিনেমাটি প্রদর্শন করা হচ্ছিল স্কলে স্কোয়ার নামের এক এলাকায়। এটা ছিল পর্ন ছবি নির্মাণের জায়গা। আমরা কখনো সেখানে যাইনি। কিন্তু তারপরও সিনেমাটা দেখার সিদ্ধান্ত নেই। ওই সিনেমাটা পর্ন ছবি হিসাবে দেখানো হয়। দর্শকরা উন্মাদের মতো হাসছিল। এটা একটা গ্রাফিক ফিল্ম ছিল। তারা কোথা থেকে এই ফিল্ম যোগাড় করেছিল আমি জানি না। তবে সেটা হিরোশিমার একটা সরাসরি দৃশ্যের ভিডিও ছিল; শরীর থেকে চামড়ার খোসা উঠে যাওয়া মানুষজন ছুটে বেড়াচ্ছে, খুবই ভয়ংকর দৃশ্য ছিল সেটা। কিন্তু তা পর্ন ছবি হিসাবে প্রদর্শন করা হচ্ছিল, আর লোকে হাসছিল। আপনি কল্পনা করতে পারেন ঘটনাটা?
১৯৩০ এর দশকে আমি যখন বাচ্চা ছিলাম, আমি আর বন্ধুরা মিলে জঙ্গলে কাউবয় আর ইন্ডিয়ান সেজে খেলতাম। আমরা ছিলাম কাউবয়, ইন্ডিয়ানদের হত্যা করতাম। আমি জানি না আপনার শৈশবেও এমন খেলার প্রচলন ছিল কিনা, তবে এটাই যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা বাদ দিলে যুক্তরাষ্ট্রে কখনোই আক্রমণ হয়নি। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে আক্রমণ হয়েছিল, ১৮১২ সালের যুদ্ধের সময়। আমরাই অন্যদের আক্রমণ করি।
হ্যাঁ; একইসাথে এটাও শুনতে পাই, অন্যান্য দেশে আমরা যখন যুদ্ধ শুরু করি, কিংবা নৃশংসতা চালাই, সেক্ষেত্রে আমাদের যেন কোনো সহানুভূতি কাজ করে না।
চমস্কি: এটা বর্তমান সময়ের সাথেও যায়। এই মুহূর্তেই কংগ্রেসের আইনপ্রণেতাদের কিংবা পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞদের মুখে বীরত্বপূর্ণ বাণী শুনতে পাবেন, আমাদের উচিত ইউক্রেনকে রক্ষার জন্য নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করা। সৌভাগ্যবশত, সরকারের একটা অংশ এখানে শান্তিরক্ষায় কাজ করছে। এটা হচ্ছে পেন্টাগন। তারা এখন পর্যন্ত কংগ্রেসের সদস্যদের বীরত্বপূর্ণ বিবৃতিগুলোর বিরোধিতা করে আসছে। তারা সংবিধান দেখিয়ে জানাচ্ছে, নো-ফ্লাই জোন মানে কেবল রাশিয়ার বিমানে আক্রমণ করে ধ্বংস করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর ফলে রাশিয়ার অভ্যন্তরে যে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে, সেগুলোও ধ্বংস করে দিতে হবে। তারপর কী হবে? সর্বশেষ জরিপে দেখাচ্ছে, ৩৫ শতাংশ আমেরিকান কংগ্রেসের বীরত্বপূর্ণ বক্তৃতায় ভালোই প্রভাবিত হয়েছেন। এই ৩৫ শতাংশ জনগণ চাচ্ছেন, আমরা ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি, এমনকি সেখানে পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা থাকলেও। এতে সব শেষ হয়ে যাবে। যে দেশ আগে আক্রমণ করবে, ওই দেশই ধ্বংস হয়ে যাবে।
মানুষজন যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধির জন্য উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রদের মধ্যে যেকোনো দ্বন্দ্ব থাকলে তা বড় আকারে রূপ নেওয়ার ঝুঁকি থাকে; সেটা দুই পক্ষই সচেতনভাবে না চাইলেও হতে পারে। যেকোনো ভুল সিদ্ধান্ত পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ ডেকে আনতে পারে, যা একটা দুর্যোগে রূপ নিতে পারে।
চমস্কি: আমাদের একটা জিনিস বোঝা উচিত, অন্তত পেন্টাগন পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুযায়ী পরিপক্ব আচরণ করছে। রুশদের কাছে প্রচুর পারমাণবিক অস্ত্র আছে। কিন্তু তাদের সতর্কতা ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধতা আছে। তারা সেকেলে অচল রাডার নির্ভর সতর্কতা ব্যবস্থা ব্যবহার করে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র স্যাটেলাইট নির্ভর সতর্কতা ব্যবস্থায় কাজ করে। তাই যেকোনো জায়গায়, এমনকি রাশিয়ার ভূখণ্ডে কিছু ঘটলেও আমরা তাৎক্ষনিকভাবে তা জানতে পারব। কিন্তু রুশরা আক্রমণের শিকার হওয়ার অল্প সময়ের আগে তা জানতে পারবে না। তারা এতে ভুল সতর্কতার অ্যালার্মকেও আসল মিসাইল উৎক্ষেপণ মনে করতে পারে। তাদের কাছে তখন সময়ও খুব বেশি থাকবে না।
অতীতে প্রায় এমন ঘটনাই ঘটতে চলছিল। প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের সময়ের একটা ঘটনা বিখ্যাত হয়ে আছে। আমেরিকানরা তখন রাশিয়ায় আক্রমণ করলে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেমন কাজ করবে, তার একটা সিমুলেশন নিয়ে কাজ করছিল। তারা মনে করেছিল, রুশরা বুঝতে পারবে এটা কেবলই অনুশীলনের জন্য করা। কিন্তু পরিস্থিতি সেভাবে কাজ করেনি। রুশরা মনে করে এটা হয়তো সত্যিকারের আক্রমণই হতে যাচ্ছে। ওই সময়ে পশ্চিম ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের পার্শিং মিসাইল স্থাপনা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সেখান থেকে মস্কোতে মিসাইল পৌঁছানোর দূরত্ব মাত্র পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মধ্যে ছিল। তাই তারা এটা নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল। আমরা তখন একটা পারমাণবিক যুদ্ধের খুব কাছাকাছি চলে আসি। এটা থেমে যায় এক রুশ ব্যক্তির কল্যাণে (তার নাম স্ট্যানিস্লাভ পেত্রভ); তিনি সতর্কতা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। তার কাছে একটা মিসাইল আক্রমণের স্বয়ংক্রিয় সতর্কবার্তা চলে আসে। প্রটোকল অনুযায়ী তার দায়িত্ব ছিল উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টা জানানো, এবং তারা ওই দুই মিনিটের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবেন পাল্টা আক্রমণ করবেন কিনা। কিন্তু পেত্রভ তাদের না জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি শুধু তাকিয়ে ছিলেন এর দিকে। তাকে পরবর্তীতে এর কারণে তিরস্কার করা হয়, এবং শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি বিশ্বকে এক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন।
এটাই একমাত্র ঘটনা ছিল না। আমরা সবাই জানি, পারমাণবিক অস্ত্রকে আমরা খেলনার মতো বিবেচনা করছি। এক-তৃতীয়াংশ আমেরিকান, ১৯৪৫ সালের সেই সামার ক্যাম্পের বাচ্চাদের মতো আচরণ করছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? সবাই বীর-পালোয়ান হতে চায়। আমার কাছে মনে হয় না, পারমাণবিক অস্ত্রের যুগে আমরা বর্তমান সময়ের মতো এরকম বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে আর পড়েছি।
(পরবর্তী অংশ পর্ব ২ এ)