১৯৯৮ সালের শুরুর দিকের কথা। ব্রিটিশ আইনজীবী স্যালি ক্লার্ক তখন দ্বিতীয়বারের মতো মা হয়েছেন। তার প্রথম সন্তান ক্রিস্টোফারের মৃত্যু হয়েছিল আরো বছর দুয়েক আগে। বয়স তিন মাস না পেরোতেই মারা গিয়েছিল ছেলেটি। তখন তার মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছিল সবাই। মনে করা হয়েছিল ‘সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ সিনড্রোম’ (SIDS)-এর ফলে মৃত্যু হয়েছে তার। সেই শোক কাটিয়ে সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তান হ্যারিকে নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন স্যালি।
কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! মাত্র দুই মাস বয়সে মৃত্যুবরণ করে হ্যারিও। ময়নাতদন্ত করা চিকিৎসক হ্যারির মৃত্যুকে সন্দেহজনক বলে রায় দেন। এরপর তিনি ক্রিস্টোফারের মৃত্যু নিয়ে পুনরায় তদন্ত করেন। এবারে সেটিকেও সন্দেহজনক বলে মনে হয় তার। সন্দেহের তীরটা আসে স্যালির দিকেই, যেহেতু দুটি মৃত্যুর সময়েই তিনি একা ছিলেন বাচ্চাদের সাথে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই গ্রেফতার হন তিনি। দুই সন্তানকে হত্যার অভিযোগে শুরু হয় তার বিচারকাজ।
স্যালির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছিল না। তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হয় আদালত। বাদী পক্ষের বিশেষজ্ঞরা ময়নাতদন্তসহ অন্যান্য মেডিকেল রিপোর্ট দেখে জানান, দুটি শিশুকেই খুন করা হয়েছে। ক্রিস্টোফারকে শ্বাসরোধ করে ও হ্যারিকে তীব্রভাবে ঝাঁকিয়ে হত্যা করা হয়েছে। স্যালির পক্ষের আইনজীবিদের বক্তব্য ছিল, এসব প্রমাণ থেকে নিশ্চিতভাবে বাচ্চাদের মৃত্যুর কারণ বোঝা সম্ভব হচ্ছে না। স্যালি যে হত্যাকারী তার সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণও নেই।
বাদীপক্ষের একজন স্বাক্ষী ছিলেন এমেরিটাস অধ্যাপক প্রফেসর রয় মেডো। তিনি তখন ‘শিশু নির্যাতন’ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিখ্যাত। ‘দ্য এ বি সি অভ চাইল্ড এবিউজ’ নামে তার লেখা একটি বই শ্রেষ্ঠ পাঠ্যবইগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত হতো। স্যালি ক্লার্কের মামলায় তার স্বাক্ষ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। দুজন শিশুর মৃত্যু নিয়ে পর্যালোচনা করে তিনি জানিয়েছিলেন যে, তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা খুবই নগণ্য।
হঠাৎ করে বাচ্চাদের মৃত্যুবরণ করার আসল কারণ কী সেটি তখনো জানা ছিল না চিকিৎসকদের। এ মামলায় সাক্ষ্যে প্রফেসর রয় একটি জরিপের তথ্য ব্যবহার করেছিলেন। সে জরিপটি করা হয়েছিলে তিন বছরের ব্যবধানে হঠাৎ করে মৃত্যুবরণ করা ৪০০ শিশুর তথ্য নিয়ে। এ জরিপে তিনটি ঝুঁকিপূর্ণ নিয়ামক বিবেচনা করা হয়েছিল। পরিবারে কেউ ধূমপায়ী আছে কি না, আর্থিক স্বচ্ছলতা ও মায়ের বয়স নেওয়া হয়েছিল বিবেচনায়।
জরিপের ফলাফল অনুসারে, কোনো পরিবারে এ তিনদিকের কোনো দিক থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ না হলে, সেখানে শিশুর হঠাৎ মৃত্যুর সম্ভাবনা ৮৫৪৩ ভাগের এক ভাগ। বলে রাখা ভালো, এটিও সম্পূর্ণ নিশ্চিত কোনো উপাত্ত নয়। এটি স্রেফ তিনটি সম্ভাব্য নিয়ামক বিবেচনায় নিয়ে করা একটি জরিপ। আরো অনেক কারণ কাজ করতে পারে এ ধরনের মৃত্যুর পেছনে, চিকিৎসকরা তা জানতেন না।
সে জরিপ অনুসারে তাই স্যালি ক্লার্কের পরিবারে একজন শিশুর আকস্মিক মৃত্যুর সম্ভাবনা ১/৮৫৪৩। এখান থেকে প্রফেসর রয় দেখান, তাদের পরিবারে দুটি শিশুর মৃত্যুর সম্ভাবনা (১/৮৫৪৩) কে (১/৮৫৪৩) দিয়ে গুন করে পাওয়া যায়। এটি প্রায় তিয়াত্তর মিলিয়নে এক ভাগের সমান। অর্থাৎ এর সম্ভাবনা খুবই কম। ইংল্যান্ডে শিশু জন্মহার বিবেচনা করলে প্রতি এক শতাব্দীতে একবার এমনটি ঘটা সম্ভব।
এ পরিসংখ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের মৃত্যুকে অস্বাভাবিক বলেই বোধ হয়। এত কম সম্ভাবনার কোনো ঘটনার চেয়ে স্যালিকে দোষী বলেই বোধ হয়। কিন্তু কোনো মায়ের দ্বারা নিজের দুই সন্তানকে হত্যার সম্ভাবনাও ভীষণ নগণ্য। তাই এ তথ্যও কোনোভাবেই তাকে দোষী প্রমাণ করে না। তবে আদালতকে এসব তথ্য অনেকটা প্রভাবিত করেছিল। স্যালি ক্লার্কের বিপক্ষেই গিয়েছিল রায়। আপন দুই সন্তানকে হত্যার অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি। তিনি এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন। ২০০০ সালের ২রা অক্টোবর খারিজ হয়ে গিয়েছিল সেটি।
কিন্তু একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই প্রফেসর রয়ের নির্বোধ একটি ভুল চোখে পড়ে এখানে। তিনি একই পরিবারে দুই সন্তানের হঠাৎ মৃত্যুর ঘটনাকে ‘স্বাধীন ঘটনা’ হিসেবে ধরে নিয়েছেন। সম্ভাব্যতার নিয়ম অনুসারে দুটি ঘটনা স্বাধীন হলে, তাদের সম্ভাব্যতা গুন করে তাদের একসাথে ঘটার সম্ভাব্যতা পাওয়া যায়। যেমন ধরুন, একটি কয়েন দিয়ে টস করলে হেড পড়ার সম্ভাব্যতা ১/২। এর পরেরবার টসে হেড পাওয়ার সম্ভাব্যতাও ১/২। এ ঘটনা দুটির একটির ওপর অন্যটির কোনো যোগসূত্র নেই, অর্থাৎ তারা ‘স্বাধীন ঘটনা’। তাই পরপর দুটি টসে হেড ওঠার সম্ভাব্যতা (১/২) × (১/২) = ১/৪।
কিন্তু স্যালি ক্লার্কের দুই সন্তানের মৃত্যুর বিষয়টি তেমন নয়। শিশু সন্তানের হঠাৎ মৃত্যুর পেছনে বংশগত বা পরিবেশগত কারণ জড়িত থাকাটিই স্বাভাবিক। এ কারনে যদি কোনো দম্পতির একটি সন্তানের হঠাৎ মৃত্যু ঘটে, তবে বলা চলে তাদের ক্ষেত্রে আবারো এরকম হওয়ার সম্ভাবনা বেশিই। তাই স্যালির প্রথম সন্তানের মৃত্যুর সম্ভাবনা ৮৫৪৩ ভাগের এক ভাগ হলেও, পরপর দুজন সন্তানের মৃত্যুর সম্ভাবনা তিয়াত্তর মিলিয়নে একবার হবে না। কারণ প্রথম সন্তানের মৃত্যুতেই বোঝা যাচ্ছে তাদের সন্তান বংশগতভাবে কিংবা পরিবেশগতভাবে শৈশবে মৃত্যুর ঝুঁকিতে আছে। তাই তার মৃত্যুর সম্ভাব্যতাও বেড়ে যাবে।
আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যায়। ধরুন, আপনি যুক্তরাষ্ট্রে ছয় ফুট তিন ইঞ্চির চেয়ে দীর্ঘ মানুষ খুঁজছেন। গোটা দেশের কথা হিসেব করলে হয়তো একশজনে একজন পাবেন। কিন্তু যদি ঐ দেশের পেশাদার বাস্কেটবল খেলোয়াড়দের মধ্যে এতটা দীর্ঘ মানুষ খোঁজেন, তবে সম্ভাব্যতা কিন্তু একই থাকবে না। সেক্ষেত্রে হয়তো দুই-তৃতীয়াংশ খেলোয়াড়ই পাবন যারা এর চেয়ে দীর্ঘ। তাই এক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা আর গোটা দেশের হিসেবের সম্ভাব্যতার সমান হবে না।
একইভাবে সাধারণ কোনো পরিবারে হঠাৎ শিশু মৃত্যুর সম্ভাব্যতা ও একবার এ ধরনের ঘটনা ঘটে যাওয়া কোনো পরিবারে সে সম্ভাব্যতা সমান হবে না। যেহেতু একটি ঘটনার ওপর নির্ভর করে অন্য ঘটনার সম্ভাব্যতার পরিবর্তন হয়, সেহেতু ‘স্বাধীন ঘটনা’র মতো একে হিসেব করলে চলবে না। কিছুদিন পর ‘রয়্যাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল সোসাইটি’ জানিয়েছিল কোনো রকম পরিসংখ্যানগত ভিত্তি নেই প্রফেসর রয়ের দেওয়া এসব উপাত্তের। কিন্তু তাতেও মুক্তি মেলেনি স্যালির।
২০০২ সালে এসে মামলাটি আবার নতুন করে আপিল বিভাগে যায়। এ সময় জানা গিয়েছিল স্যালির দ্বিতীয় সন্তান হ্যারির শরীরে থাকা এক প্রাণঘাতী সংক্রমণের তথ্য। এ তথ্যটি বাদীপক্ষের প্যাথোলজিস্ট অ্যালান উইলিয়ামসের জানা ছিল, কিন্তু তিনি প্রকাশ করেননি সেটি। প্রফেসর রয়ের মতো তিনিও সন্তান হত্যার দায় মাথায় চাপিয়ে স্যালি ক্লার্ককে ঠেলে দিতে চেয়েছিলেন জেলখানার অন্ধকারে। রয়ের কাজটি ভুল হিসেবে মেন নেওয়া গেলেও উইলিয়ামসের এ ঘৃণ্য কাজটিকে বৈধতা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
এসব তথ্য উন্মোচিত হওয়ার পরে ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে এসে স্যালির দণ্ড প্রত্যাহার করে নেয় আদালত। মুক্তি পাওয়ার পর স্যালি বলেছিলেন,
আজ কোনো বিজয়ের দিন নয়। আমরা জয়ী হইনি, বরং হারিয়েছি সবই।
পরপর দুই শিশু সন্তানকে হারানো একজন মায়ের জন্য কতটা কষ্টের হতে পারে ভাবা যায়? তার ওপর সে সন্তানদের হত্যার দায় মাথায় নিয়ে কয়েক বছর জেল খাটা! এদিকে পত্র-পত্রিকাগুলোও তাকে সন্তান-হন্তারক হিসেবে ফলাও করে প্রচার করে চলছিল। সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তিদের একজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এতসবের পর জীবনে কি আর কোনো জয়ের স্বাদ আসে?
আদালতে বিশেষজ্ঞদের ইচ্ছা ও অনিচ্ছাকৃত সেসব ‘ভুল’ স্যালি ক্লার্কের জীবনকে যে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল, তা থেকে আর বেরোতে পারেননি তিনি। মুক্তি ফেলেও স্যালি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনে ফেরা হয়নি আর। রাষ্ট্রও তার এ ক্ষতিপূরণের কোনোরকম চেষ্টা করেনি। অবশেষে ২০০৭ সালে এসে অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
শিশুর যত্ন নিয়ে জানতে পড়ে নিন এই বইগুলো:
১) সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর যত্ন
২) আপনার শিশুর যত্ন সমস্যা ও সমাধান