প্রত্যেকটি দেশই চায় অন্যান্য দেশ থেকে শক্তির বিচারে এগিয়ে থাকতে। অনেকাংশেই এই এগিয়ে থাকা নির্ভর করে সেই দেশটি বিজ্ঞানের দিক দিয়ে কতটুকু উন্নত এবং অর্থনৈতিকভাবে কতটা শক্তিশালী ও স্বাবলম্বী তার উপর। বিংশ শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝি সময় থেকে নিউক্লিয়ার শক্তি হয়ে ওঠে উন্নত দেশগুলোর শক্তি প্রদর্শনের অন্যতম হাতিয়ার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সারাবিশ্ব নিউক্লিয়ার শক্তির ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারে। ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে, যেটা ছিল নিউক্লিয়ার শক্তির প্রথম ব্যবহারিক প্রয়োগ। সেই থেকে প্রায় প্রতিটি দেশ এই শক্তির ভালো দিকগুলো খুঁজে নিতে তৎপর হয়। প্রতিটি জিনিসের ভালো এবং খারাপ দুই দিক-ই আছে। নিউক্লিয়ার শক্তিও এই সত্যের বহির্ভূত নয়। তাই অনেকগুলো ভালো দিকের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই শক্তি ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। গবেষণা করে দেখে গেছে, নিউক্লিয়ার শক্তি হচ্ছে অফুরন্ত শক্তির উৎস। সেই থেকে দেশে দেশে বিদ্যুৎ বিভ্রাট কমিয়ে আনার জন্য পারমাণবিক চুল্লী নির্মাণ করা হচ্ছে, যেখানে নিউক্লিয়ার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশও এই অফুরন্ত শক্তি লাভের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশে নিউক্লিয়ার শক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে বলে আশা করা যায়।
যেকোনো বিষয়ের ভালো দিককে সবাই সাদরে গ্রহণ করবে। কিন্তু খারাপ দিকটি যতটা পারা যায় এড়িয়ে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ। এখনও বিভিন্ন দেশ নিজেদেরকে নিউক্লিয়ার শক্তিতে পরিণত করতে দ্রুতগতিতে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে নবগঠিত নিউক্লিয়ার শক্তিধর দেশগুলো পশ্চিমা বিশ্বের তুলনায় শক্তির বিচারে যেকোনো অংশে কম নয়- সেটা দেখানোই তাদের মূল উদ্দেশ্য। এসব দেশে নিউক্লিয়ার শক্তিকে মূলত নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরিতে কাজে লাগানো হচ্ছে। যেমন- নিউক্লিয়ার বোমা, অস্ত্র, মিসাইল ইত্যাদি। বর্তমানে সারা বিশ্বে যে কয়টি নিউক্লিয়ার অস্ত্র রয়েছে তাতে নিমিষেই পুরো বিশ্বকে ধ্বংস করে দেয়া যায়। তাই এসব অস্ত্রের ভয়বহতার কথা চিন্তা করে জাতিসংঘ এবং সাথে অনেক বেসরকারি ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে, যারা দিন-রাত শুধু কাজ করছে কীভাবে সারা বিশ্বের নিউক্লিয়ার অস্ত্রগুলোকে সমঝোতার মাধ্যমে নির্মূল করা যায়। এরকম একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে নিউক্লিয়ার ট্রিটি ইনিশিয়েটিভ, সংক্ষেপে এন.টি.আই।
যেসব দেশ নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরি এবং মজুদ করে তাদের গত ছয় বছরের (২০১২-২০১৮) নিউক্লিয়ার কার্যকলাপ প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করেছে এন.টি.আই। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০১ সালে। তখন থেকে তারা পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশের নিউক্লিয়ার কার্যকলাপের উপর দৃষ্টি রাখা শুরু করে। ২০১২ সালে তারা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে ১৯৯০-২০১২ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের নিউক্লিয়ার শক্তি, অস্ত্র এবং অন্যান্য কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করা হয় এবং সেখানে দেখা যায় ১৯৯০ সালে প্রায় ৫০টি দেশে কমপক্ষে এক কিলোগ্রাম বা তার থেকে বেশি পরিমাণ নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরির কাঁচামাল বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ২০১২ সালে সেই সংখ্যা কমে ৩২টি দেশে নেমে গেছে। অর্থাৎ ১৮টি দেশ নিউক্লিয়ার অস্ত্র এবং এর আনুষঙ্গিক কাঁচামাল তৈরি করা বন্ধ করে দিয়েছে। ২০১৮ সালেও আরেকটি রিপোর্ট এসেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে এই সংখ্যা বাইশে নেমে এসেছে। যদিও এই ২২টি দেশের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, ব্রিটেন এবং উত্তর কোরিয়াতে নিউক্লিয়ার শক্তির সংখ্যা ২০১৬ সাল থেকে কিছুটা বেড়েছে।
এছাড়া আন্তর্জাতিক নিউক্লিয়ার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এন.টি.আই এবং ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট সম্মিলিতভাবে একটি সূচক তৈরি করেছে। এই সূচক তৈরির উদ্দেশ্য ছিল নিউক্লিয়ার অস্ত্র আছে এমন দেশের বর্তমান অবস্থা তাদের পূর্বের অবস্থার সাথে তুলনা করা এবং যে দেশগুলোর মধ্যে অন্তর্ঘাত বা দ্বন্দ্ব আছে তারা এই শক্তি নিয়ে কী কী কাজ করেছে বা করছে সেগুলো খতিয়ে দেখা। এই সূচক প্রকাশ পাওয়ার পর দেখা গেছে, তালিকায় সবার উপরে আছে অস্ট্রেলিয়া, এরপর যথাক্রমে আছে সুইজারল্যান্ড এবং কানাডা। এই দেশ তিনটি নিউক্লিয়ার নিরাপত্তা জোরদার করেছে এবং নিউক্লিয়ার অস্ত্র মজুদ কমিয়ে এনেছে। ২০১২ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি উন্নতি হয়েছে জাপান এবং চীনের। তারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের নিউক্লিয়ার অস্ত্র এবং কাঁচামাল মজুদকরণ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে এনেছে। উন্নতির তালিকায় সবচেয়ে কম উন্নতি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।
তবে উত্তর কোরিয়া তাদের নিউক্লিয়ার কার্যকলাপ এবং শক্তি প্রদর্শন ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়ে দেয়। যে কারণে উত্তর কোরিয়াতে নিরাপত্তার উন্নতি নয়, বরং অবনতি হয়েছে। এর প্রমাণ গত কয়েকমাসে উত্তর কোরিয়ার একের পর এক পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষাকরণ থেকেই আমরা পেয়েছি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উত্তর কোরিয়ার দ্বন্দ্বের কারণেও এই সূচকে তাদের স্কোর সবচেয়ে কম। তবে উত্তর কোরিয়া যদি নিউক্লিয়ার অস্ত্র বিষয়ক দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী চলে এবং আন্তর্জাতিক কিছু চুক্তির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় তাহলে তাদের অবস্থান উন্নতির দিকে ধাবিত হতে পারে। শেষের দিক থেকে উত্তর কোরিয়ার পরেই আছে ইরান। ইরানের ক্ষেত্রে নিউক্লিয়ার নিরাপত্তার কিছুটা উন্নতি হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিভিন্ন সময়ে দ্বন্দ্বের কারণে তারা এই তালিকায় শেষের দিকে পড়ে গিয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, পুরো তালিকা বিশ্লেষণ করার পর বোঝা গেছে, ২২টি দেশের মধ্যে ২১টি দেশে নিউক্লিয়ার নিরাপত্তা তুলনামূলক বেড়েছে, এবং যেসব দেশের মধ্যে পরস্পর দ্বন্দ্ব ছিল, ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে তাদের সম্পর্ক আগের তুলনায় ভালো হয়েছে। পুরো প্রতিবেদনের সারমর্মে এটাই প্রমাণিত হয় যে, বৈশ্বিক নিউক্লিয়ার নিরাপত্তা সামগ্রিকভাবে বেড়েছে।
কিন্তু একদিক দিয়ে উন্নতির ধারা বজায় থাকলেও কিছু নতুন আশঙ্কা এখানে যোগ হয়েছে। যেমন- মজুদকৃত নিউক্লিয়ার কাঁচামালের চুরি এবং নিউক্লিয়ার শক্তি তৈরির কেন্দ্রগুলোতে সাইবার হামলা। এই দুটি ব্যাপার বিশেষজ্ঞদের মারাত্মকভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরির কাঁচামালগুলো কোনোভাবে সন্ত্রাসী সংগঠনের কাছে পৌঁছে গেলে তারা এটাকে কতটা মারাত্মক এবং ধ্বংসাত্মকভাবে ব্যবহার করতে পারে সেটা একটা ভাবনার বিষয়।
এছাড়া নিউক্লিয়ার শক্তি তৈরি করার জন্য যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় সেগুলো জানতে এবং সেসব প্রযুক্তির যাবতীয় পরিকল্পনা, নকশা ইত্যাদি পেতে বিভিন্ন দেশ থেকে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টগুলোতে সাইবার হামলা চালানো হয়। এটাও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। গত কিছুদিন যাবত উন্নত দেশের কয়েকটি নিউক্লিয়ার ফ্যাসিলিটি প্ল্যান্টে কয়েকবার করে সাইবার হামলা চালানো হয়েছে। যেমন- জাপানের টয়োমা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইড্রোজেন আইসোটোপ রিসার্চ সেন্টার, জার্মানির গুণড্রেমিনজেন নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট, যুক্তরাষ্ট্রের নিউক্লিয়ার রেগুলেটরি কমিশন মারাত্মক সাইবার হামলার শিকার হয়। ২০১৭ সালে কানসাসের ওলফ ক্রিক নিউক্লিয়ার স্টেশনে ভয়ংকর সাইবার হামলা হয়, যার কারণে অনেক গোপন তথ্য হাত ছাড়া হয়ে যায়। বিশেষ করে নিউক্লিয়ার শক্তি ব্যবহার করে কীভাবে বিদ্যুতের অসীম উৎপাদন সম্ভব- সেই সূত্র এবং প্রযুক্তি হাতিয়ে নেয়া এসব হামলার মূল কারণ।
এসব হামলার কথা জনসাধারণের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় গোপন রাখা হয়। তবে এই সমস্যাগুলো নিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকার, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিজ্ঞানী এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করে আসছে। আশা করা যাচ্ছে খুব শীঘ্রই এই ধরনের সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে। নিউক্লিয়ার শক্তিকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিভিন্ন দেশের উপস্থিতিতে সম্মিলিতভাবে যদি একটি দিক-নির্দেশনা দেয়া যায় তাহলে এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। এছাড়া কোনো একটি দেশে যদি সাইবার হামলা হয় বা দেশটি যদি হামলার আশঙ্কা করে তাহলে অন্যদেশগুলোর সাথে এই হামলা সংক্রান্ত তথ্য আলোচনা করা যেতে পারে। এরকম করলে বিরাট ক্ষতির সম্ভাবনা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ফিচার ইমেজ সোর্স: NTI Neuclear Security Index