প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ সুগন্ধির ব্যবহার করে আসছে। পুরাণ ও বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে নানা প্রকারের সুগন্ধির উল্লেখ পাওয়া যায়। অনেক ধর্মে উপাসনার অন্যতম উপসর্গ হিসেবে সুগন্ধির ব্যবহার হয়ে থাকে। ইসলাম ধর্মে সুগন্ধি ব্যবহারকে সুন্নতের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। খ্রিস্টানদের গির্জায় বিভিন্ন অণুস্থান ও প্রার্থনায় সুগন্ধি ধূপ জ্বালানো হয়। হিন্দুদের পূজাতেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে নানা সুগন্ধি।
আধুনিককালে রাসায়নিক দ্রব্যের মাধ্যমে নানা ধরনের অভিজাত সুগন্ধি উৎপাদিত হলেও প্রাচীনকালে এর একমাত্র উৎস ছিল প্রকৃতি। অর্থাৎ প্রাকৃতিকভাবে কোনো বৃক্ষ বা লতাপাতা থেকে তারা সুগন্ধি তৈরি করতো। যেমন- আমরা সবাই চন্দন কাঠের সাথে পরিচিত। কিন্তু চন্দনের চেয়েও দামী কাঠ রয়েছে, যার নাম আগর কাঠ। আমাদের দেশে ব্যবহৃত ‘আগরবাতি’ শব্দটিও এই আগর কাঠ থেকে এসেছে; যদিও আগরবাতি উৎপাদনে এখন আর আগর কাঠ ব্যবহার করা হয় না।
এই আগর কাঠকে স্বর্ণের চেয়েও দামী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। হংকংয়ের ইয়াউ মা তি অঞ্চলে এখনও টিকে আছে এই কাঠের অত্যাধুনিক শিল্প। বংশ পরম্পরায় এখানকার একদল ব্যবসায়ী এখনো ধরে রেখেছেন এই ব্যবসা, যা এখন একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে রূপ লাভ করেছে।
তেমনই একটি বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানের নাম ‘উইং লি জোস স্টিকস অ্যান্ড স্যান্ডালউড কোম্পানি’। হংকংয়ে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটির ভেতরে ঢুকলেই আপনার নাকে ভেসে আসবে মন মাতানো ঘ্রাণ; দেয়ালে সাজানো সারি সারি স্বর্ণালী রঙয়ের কাঠ। কাঁচের ফ্রেমে বাঁধানো তাকগুলোতে রাখা নানা রঙয়ের অভিজাত সব সুগন্ধি। প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম দামী তেলের বোতল। আর এ সকল দ্রব্যের প্রধান উপাদান সেই স্বর্ণের চেয়েও দামী আগর কাঠ।
এই অভিজাত কাঠটি হংকংয়ের ইয়াউ মা তি অঞ্চলের নামই বদলে দিয়েছে। এই অঞ্চলকে সবাই ‘ক্যান্টোনিজ’ (Cantonese) নামে ডাকে, যার অর্থ ‘সুগন্ধির বন্দর’। এই নামটি এখানকার ঐতিহাসিক ঔপনিবেশিক বাণিজ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, কেননা অতীতে এই বন্দরটি ছিল বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু, যেখান থেকে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই আগর কাঠ ও এর সুগন্ধি রপ্তানি করা হতো।
উইং ওয়াহ নামের এক বৃদ্ধ গত ৭০ বছর যাবত আগর কাঠ ও তা থেকে উৎপন্ন সুগন্ধি বিক্রয় বাণিজ্যের সাথে যুক্ত। বর্তমানে তার বয়স ৮৪ বছর। লেখার শুরুর দিকে যে ‘উইং লি জোস স্টিকস অ্যান্ড স্যান্ডালউড কোম্পানির’ কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেটির প্রতিষ্ঠাতা মালিক তিনি। অনেক বয়স হওয়ায় তিনি এর মূল পরিচালক পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। বর্তমানে তার ছেলে কেনি এই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক পদে বহাল রয়েছেন।
পরিচালক পদ থেকে অবসর নিলেও সাংহাই স্ট্রিটে নিজ হাতে সাজানো দোকানটি তিনি প্রতিদিন পরিদর্শন করেন। যদিও এখন তাদের আরও অনেক দোকান হয়েছে। হংকংয়ের মূল ভূখণ্ড ছাড়িয়ে চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়েছে। এর মধ্যে বেইজিং, সাংহাই এবং হারবিনের মতো অঞ্চলে তাদের সুগন্ধির দোকান রয়েছে।
উইং ওয়াহ মাত্র ১৩ বছর বয়সে এই ব্যবসার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন-
আগর কাঠ সবসময়ই খুব দামী কাঠ হিসেবে পরিচিত ছিল। অতীতে এটি খুব ভালো ব্যথানাশক ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখন আর এটি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার হয় না; এখন এটি চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজের চেয়ে সুগন্ধি উৎপাদনের কাজে বেশি ব্যবহৃত হয়।
তবে ‘আগর’ কোনো গাছের নাম নয়। এটি একটি বিশেষায়িত কাঠ। ‘আকুইলারিয়া’ (Aquilaria) গাছ থেকে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে এই কাঠ উৎপন্ন করা হয়। আকুইলারিয়া গাছ বড় হলে দেহ ছিদ্র করে বিশেষ একপ্রকারের অণুজীব প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। অণুজীব গাছের ঐ অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং একপর্যায়ে শুকিয়ে ফেলে। তারপর শুকিয়ে যাওয়া অংশ গাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। আর এই শুকিয়ে যাওয়া অংশই হলো ‘আগর কাঠ’।
আগর কাঠকে বলা হয় ‘সুগন্ধির রাজা’। যুগ যুগ ধরে এই কাঠ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি করা হতো। চীনের তাং এবং সং সাম্রাজ্যের নথি থেকে জানা যায়, এটি ছিল তাদের শাসনামলের সবচেয়ে দামী রপ্তানি পণ্য। আর এ থেকে উৎপাদিত সুগন্ধির সাথে ইসলাম, তাওবাদ ও খ্রিস্টান ধর্মের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে।
আগর কাঠের নির্যাসের সামান্য অংশ থেকে তৈরি হয় অভিজাত নানা সুগন্ধি। ২০১৪ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, প্রতি কেজি আগর কাঠের দাম ছিল ৫৮ হাজার হংকং ডলার। এছাড়া ভাস্কর্য আকৃতির কয়েক মিটার দৈর্ঘ্যের একেকটি আগর কাঠের গুঁড়ার প্যাকেট বিক্রি হতো ১২ লাখ হংকং ডলারে। উইং ওয়াহ বলেন-
আগর কাঠের প্রতিটি খণ্ডই যেন একেকটি শিল্পের মতো।
আগর কাঠ থেকে আরও দুটি অভিজাত পণ্য উৎপাদন করা হয়- আতর ও ধূপ। আতর মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। ধূপও সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আগর কাঠের নির্যাস থেকে একধরনের সুগন্ধি তৈলও উৎপন্ন হয়, যা বিশ্বের নামীদামী ব্র্যান্ডের পারফিউমের অপরিহার্য উপাদান, যেমন- বিশ্বখ্যাত আরমানি প্রাইভ’স ওউড রয়্যাল (Armani Privé’s Oud Royal) এবং ইভিস সেন্ট লরেন্ট এম৭ ওউড আবসোল (Yves Saint Laurent’s M7 Oud Absolu)। এই তেলের প্রতি কেজির মূল্য ৩ লাখ হংকং ডলার, যা যেকোনো বিবেচনায় উচ্চমূল্যের। এ কারণেই এই তেলকে বলা হয় ‘তরল স্বর্ণ’।
কিন্তু গত কয়েক দশক যাবত হংকংয়ের বাজারে আগর কাঠের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায় আকুইলারিয়া গাছ দুর্লভ হয়ে পড়ে। গবেষকরা এই গাছকে দুর্লভ প্রজাতির গাছ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তবে ইতিবাচক দিক হচ্ছে, এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অ্যাকুইলারিয়া গাছ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘এশিয়া প্লান্টেশন ক্যাপিটাল (এপিসি)’ এই গাছকে রক্ষা করার জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর অংশ হিসেবে হংকং ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে তারা টেকসই পদ্ধতিতে অ্যাকুইলারিয়া গাছ রোপণ করছে। পাশাপাশি অত্র অঞ্চলের সাধারণ মানুষকেও এই গাছ রোপণে উৎসাহিত করছে।
‘এশিয়া প্লান্টেশন ক্যাপিটাল (এপিসি)’ এর হিসেব মতে, বর্তমানে হংকংয়ে মাত্র কয়েকশ অ্যাকুইলারিয়া গাছ টিকে আছে। তবে হংকং সরকারের ভাষ্য মতে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত হংকংয়ের বিভিন্ন এলাকায় তারা ১০ হাজারের বেশি অ্যাকুইলারিয়া গাছ রোপণ করেছেন।
কিন্তু অ্যাকুইলারিয়া গাছ লাগালেই যে তা টিকে যাবে এমনটি নয়। এই প্রজাতির গাছ বড় হতে বেশ কয়েক বছর সময় নেয়। এর মধ্যেই চোরাকারবারীদের হাত ধরে বিদেশে পাচার হয়ে যায় এই গাছের চারা। এ বিষয়ে ‘এশিয়া প্লান্টেশন ক্যাপিটাল (এপিসি)’ এর সেলস ডিরেক্টর জেরার্ড ম্যাকগুইক বলেন-
পাচারকারীরা সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে বড় হওয়া অ্যাকুইলারিয়াগুলোকে খোঁজে। কারণ এতে লাভের অংক বড় থাকে। ফলে বড় গাছগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে হংকংয়ে ৩০ বছরের বেশি বয়সের কোনো অ্যাকুইলারিয়া গাছ খুঁজে পাওয়া পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।
যদিও বর্তমানে হংকংয়ের বনাঞ্চলে ঠিক কতগুলো অ্যাকুইলারিয়া গাছ আছে তা বলা মুশকিল। কিন্তু এই গাছটি যে বর্তমানে হুমকির মুখে রয়েছে তা খুবই স্পষ্ট।
এতকিছুর মধ্যেও আশার আলো জ্বেলে রেখেছেন হংকংয়ের শেনঝেনের সীমান্তবর্তী গ্রাম শাইং পিং এর তৃতীয় প্রজন্মের আগর কাঠ চাষী কুন উইং চ্যান। তিনি বর্তমানে হংকংয়ের একমাত্র আগর কাঠ চাষী। তার বাগানে প্রায় ৬ হাজার অ্যাকুইলারিয়া গাছ রয়েছে।
চীনের শেনঝেনের সীমান্তবর্তী হংকংয়ের শিং পিং গ্রামের তৃতীয় প্রজন্মের আগরচাষী কুন উইং চ্যানের বাগানে বর্তমানে ৬ হাজার আগরগাছ রয়েছে। তিনি এখন ‘এশিয়া প্লান্টেশন ক্যাপিটাল (এপিসি)’ এর সাথে যৌথভাবে কাজ করছেন। বর্তমানে তার বাগানকে কেন্দ্র করে একটি পার্ক গড়ে উঠেছে। এশিয়া প্লান্টেশন ক্যাপিটাল (এপিসি) সেখানে আগ্রহীদের ভ্রমণের সুযোগ করে দেয়। পাশাপাশি তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে এই গাছের চারা রোপণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হংকংয়ের সরকারি পার্ক প্যাট সিন লেনে ইতিমধ্যেই তারা অ্যাকুইলারিয়া গাছ রোপণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে এই গাছ বাড়লেই যে আগর কাঠ বা সুগন্ধি উৎপাদন বেড়ে যাবে এমন কোনো কথা নেই। যেমনটি বলছিলেন উইং লি জোস স্টিকস অ্যান্ড স্যান্ডালউড কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক উইং ওয়াহ-
প্রত্যেক গাছ থেকেই সুগন্ধি উৎপাদনের নির্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা নেই; এটা অনেকটা জুয়ার মতো। আমাদের হিসাব মতে, মাত্র ৭ শতাংশ কাঠে সুগন্ধি উৎপাদনের নির্যাস পাওয়া যায়।
সব মিলিয়ে এই গাছকে রক্ষা করার জন্য হংকংয়ের সর্বমহল তৎপর হয়ে উঠেছে। পাচারকারীদের শায়েস্তা করার জন্য ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাশ করা হয়েছে। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে গত দুই বছরে সেখানকার কৃষি, মৎস্য ও সংরক্ষণ বিভাগ (এএফসিডি) ও পুলিশ যৌথভাবে কমপক্ষে ৩৫টি অভিযান পরিচালনা করেছে।