মনে আছে ক্যাথলীন ফলবিগের কথা?
রোর বাংলায় পূর্বে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে তুলে ধরা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান এই নারীর করুণ কাহিনী। পর পর চার সন্তান মারা যায় তার। ছেলে ক্যালেব ১৯৮৯ সালে, প্যাট্রিক ১৯৯১-এ। মেয়ে সারা ও লরার মৃত্যু যথাক্রমে ১৯৯৩ এবং ১৯৯৯ সালে। লরা ছাড়া বাকি সবার মৃত্যুই হয় এক বছর পূর্ণ হবার আগেই। ক্যাথলীনের স্বামী ক্রেগ ফলবিগ স্ত্রীর লেখা একটি ডায়রি নিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০০৩ সালে আদালতে সন্তানহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন ক্যাথলীন, ৩০ বছরের সাজা জোটে কপালে। সিরিয়াল কিলার হিসেবে কুখ্যাতি পেয়ে যান তিনি, অস্ট্রেলিয়ার জঘন্যতম নারীর খেতাব দেয় সংবাদপত্রগুলো। অবশ্য ক্যাথলীন কখনোই দোষ স্বীকার করেননি।
এই বছরের ৫ জুন নিউ সাউথ ওয়েলসের গভর্নর মার্গারেট বেইজলি (Margaret Beazley) ক্যাথলীন ফলবিগকে ক্ষমা করে দেন। কারাগারের দরজা থেকে তাকে নিয়ে আসেন উকিল ও বন্ধুরা। মার্গারেট বেইজলি কিন্তু মহানুভবতার কারণে ক্যাথলীনকে ক্ষমা করেননি। তিনি ক্ষমা করেছেন কারণ শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে যে দোষের ভার তিনি দুই দশক বয়ে নিয়ে চলেছেন, তা আদতে তার নয়।
প্রথম থেকেই ক্যাথলীনের বিচারে ত্রুটি ছিল। সরকারি উকিলের দাবী- সন্তানদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছেন তিনি, কিন্তু ময়নাতদন্তে তার কোনো আলামত মেলেনি। আসামীর বিরুদ্ধে দুটো প্রধান অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। তার হাতে লেখা ডায়েরি, যেটা হত্যার স্বীকারোক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়। দ্বিতীয় অস্ত্র ছিল মিডৌজ ল’ বলে পরবর্তীতে আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত এক নীতি, যার দ্বারা একই পরিবারে তিন বা ততোধিক শিশুর মৃত্যুকে খুন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
রায় ঘোষণার পর থেকেই ক্যাথলীনের বন্ধু ট্রেসি চ্যাপম্যান ও উকিলেরা তাকে মুক্ত করতে সবরকম চেষ্টা শুরু করেন। তার উকিল রেনে রেগো (Rhanee Rego) বিনা পয়সায় বছরের পর বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন, বার বার ছুটে গেছেন আদালতে। তাদের সবাই ক্যাথলীনের নির্দোষিতার বিষয়ে নিঃসন্দেহ ছিলেন। কিন্তু আদালতের রায় ওল্টানো তো সহজ কথা নয়।
আপিলের প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে ক্যাথলীনের কেস পর্যালোচনা করে বিচার বিভাগ, কিন্ত রায় ঠিক আছে বলে সাজা বহাল রাখে তারা। কিন্তু ততদিনে জেনেটিক বিশ্লেষণ করে গুরুত্বপূর্ন তথ্য পাওয়া গেছে। এর ভিত্তিতে প্রথিতযশা ৯০ জন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী দ্বিতীয়বার বিষয়টি বিবেচনা করার পিটিশন দেন। ২০২২ সালে অবসরপ্রাপ্ত বিচারক টম বাথহার্স্ট (Tom Bathurst) এই কাজ শুরু করেন।
বাথহার্স্টের সামনে জেনেটিক বিশ্লেষণের খুঁটিনাটি তুলে ধরেন অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ইউনিভার্সিটির ইমিউনলজির অধ্যাপক ক্যারল ভিনুসা। তিনি দেখান যে ক্যাথলীনে জিনগত কিছু বিচ্যুতি সংক্রমিত হয়েছিল সন্তানদের মাঝে। মেয়েদের মৃত্যুর পেছনে এই জেনেটিক ইস্যুর সুস্পষ্ট ভূমিকা রয়েছে। ছেলেদের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব উড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়। প্রাকৃতিক কারণে তাদের কেউ মারা যায়নি, এ কথা তাই আর খাটে না।
ক্যাথলীনের প্রাক্তন স্বামী ক্রেগ ফলবিগের উকিল অবশ্য এই যুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন। ডায়েরি থেকে ক্যাথলীনের দোষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত- এই যুক্তিতে অটল থাকেন তারা। তবে ভিন্নমত পোষণ করেন মনোবিজ্ঞানীরা। তারা ডায়েরির লেখাকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া এক মায়ের হাহাকার হিসেবে চিহ্নিত করেন, স্বীকারোক্তি হিসেবে নয়।
নিউ সাউথ ওয়েলসের অ্যাটর্নি জেনারেল মাইকেল ড্যালির (Michael Daley) মতে, বিকল্প ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতে ক্যাথলীন ফলবিগের দোষ নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। আইনের পরিভাষায় যাকে বলে রিজনেবল ডাউট, বা সন্দেহের অবকাশ, তা এক্ষেত্রে যথেষ্ট। ফলে বিজ্ঞ বিচারক প্রাথমিক রিপোর্টে ক্যাথলীনের মুক্তির সুপারিশ করেন। গভর্নর তা অনুমোদন দিলে তিনি ছাড়া পান।
ক্যাথলীনের উকিলেরা দাবী করেছেন, তাদের মক্কেল যেভাবে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে তা আগে কখনো ঘটেনি। তাদের কথায় যুক্তি আছে। দুই দশক অস্ট্রেলিয়ার জনগণের কাছে ঘৃণিত এক নারী ছিলেন তিনি, তাকে রাখা হয়েছিল ম্যাক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজনে। রেনে রিগোর মতে- যে দুঃসহ যন্ত্রণা তিনি এত বছর সহ্য করেছেন তা আমাদের পক্ষে বোঝা অসম্ভব।
বলে রাখা ভাল, মুক্তি পেলেও ক্যাথলীনকে নিরপরাধ ঘোষণা করা হয়নি। এই ধাপের সূচনা হবে বিচারক তার চূড়ান্ত রিপোর্টে যখন সেই সুপারিশ করবেন। বিষয়টি তখন আদালতের মাধ্যমে সমাধান হবে, যার জন্য বছরখানেক লাগতে পারে। এরপর ক্যাথলীন সরকারের কাছে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারবেন। এবং সেই অঙ্ক যে আকাশছোঁয়া হবে বলাই বাহুল্য।
ক্যাথলীন ফলবিগের ঘটনার পর বিভিন্ন মহল থেকে অস্ট্রেলিয়ার বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের দাবী উঠেছে। অস্ট্রেলিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেসের মতে, বিচার প্রক্রিয়া যথেষ্ট বিজ্ঞানবান্ধব নয়। বিজ্ঞান ও আদালত পরস্পরের প্রতিপক্ষ হওয়া উচিত নয়; এই দুইয়ের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটালে এই ধরনের বিচারিক ত্রুটির ঝুঁকি অনেক কমিয়ে আনা যেতে পারে।