‘গেরিলা’ শব্দটির সাথে আমরা সবাই কম-বেশি পরিচিত। এটি মূলত একধরনের সামরিক যুদ্ধকৌশল, যে কৌশলে প্রতিপক্ষকে চমকে দিয়ে আঘাত হানা হয়। সাধারণত যেখানে যুদ্ধরত একটি পক্ষের চেয়ে আরেকটি পক্ষ সামরিক দিক থেকে বেশ পিছিয়ে থাকে, তখন গেরিলা যুদ্ধকৌশলের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়।
বিশ্বের অনেক যুদ্ধে এই যুদ্ধকৌশলের প্রয়োগ দেখা গিয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হতে পারে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি দখলদারেরা উন্নত অস্ত্র থাকার পরও আমাদের দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পেরে না ওঠার অন্যমত কারণ হচ্ছে ‘গেরিলা কৌশল’। এখন প্রশ্ন তাহলে, গেরিলা মার্কেটিংয়ের সাথে গেরিলা যুদ্ধকৌশলের সম্পর্ক কোথায়? উত্তর হচ্ছে– গেরিলা আক্রমণে যেমন একপক্ষ আরেকপক্ষের আক্রমণে চমকে যায়, কোনো পূর্বানুমান করতে পারে না, তেমনই গেরিলা মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রেও ভোক্তাদের চমকে দিয়ে কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপন দেয়া হয়।
গেরিলা মার্কেটিং গতানুগতিক বিজ্ঞাপন কৌশলগুলোর চেয়ে ভিন্ন। প্রিন্ট মিডিয়া, টেলিভিশন কমার্শিয়াল কিংবা বিলবোর্ড– এগুলো হচ্ছে কোনো পণ্যের তথ্য ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানোর চিরাচরিত উপায়গুলো অন্যতম। কিন্তু গেরিলা মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে সর্বসাধারণের চলাচলের স্থানের পাশে কিংবা কোনো অনুষ্ঠানকে লক্ষ্য করে এমন কোনো কাজ করা হয় বা এমন কোনো ছবি আঁকা হয়, যেটা যারা দেখছে, তাদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। তারা যেন এটা নিয়ে ভাবে কিংবা পরবর্তীতে আবারও এই ঘটনা তাদের মনে পড়ে– সেটি নিশ্চিত করা হয়। শহরাঞ্চলে সর্বসাধারণের চলাচলের স্থানগুলোতে অনেক বেশি মানুষের যাতায়াত থাকে গ্রামের তুলনায়। এজন্য যেসব প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের পেছনে অর্থ ব্যয় করার খুব বেশি সামর্থ্য নেই, সেসব প্রতিষ্ঠান এই কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। তাদের লক্ষ্য থাকে তাদের বিজ্ঞাপন কিংবা পণ্য নিয়ে যাতে মানুষের মধ্যে কথা হয়, একজনের মুখ থেকে আরেকজনের কাছে তথ্য ছড়িয়ে যায়। ১৯৮৪ সালে জে কনরাড লেভিনসনের হাত ধরে এই মার্কেটিং কৌশল জন্ম লাভ করে।
বর্তমানে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার জন্য মানুষ দিনের একটি বড় সময় ব্যয় করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হচ্ছে সম্ভাব্য ভোক্তাদের একটি ঘাঁটি, যেটি কেন্দ্র করে বর্তমানে গেরিলা মার্কেটিং কৌশল চালানো হয়। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে অভিনব কনটেন্টগুলো মুহুর্তের মধ্যেই এখানে অতি দ্রুত ছড়িয়ে যায় (ভাইরাল হয়ে যাওয়া)। এখানে অভিনব ছবি কিংবা নজরকাড়া ভিডিওর মাধ্যমে যদি ভোক্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়, তাহলে সেটি পণ্যের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর হতে পারে।
বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান ‘গিভঅ্যাওয়ে’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। যেমন ধরা যাক, একটি জার্সি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান বার্সা-রিয়ালের এল ক্লাসিকো ম্যাচের আগে তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দিল যে তাদের পেজে লাইক দেয়া যে ব্যক্তি পোস্টের কমেন্টবক্সে আজকের ম্যাচের সঠিক স্কোর অগ্রিম বলতে পারবে, তাকে জার্সি পুরস্কার দেয়া হবে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্টটি ফুটবলপ্রেমীদের প্রচুর ভার্চুয়াল মিথস্ক্রিয়ার বিষয়বস্তুতে পরিণত হবে, যেটা পরোক্ষভাবে জার্সি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন হিসেবে কাজ করবে।
গেরিলা মার্কেটিং কৌশলের সুবিধা ও অসুবিধাগুলো দেখা যাক। গতানুগতিক বিজ্ঞাপন কৌশলের চেয়ে এতে অনেক কম অর্থ ব্যয় হয়। এই কৌশল সৃজনশীল এবং ভোক্তদের নতুন কিছু উপহার দেয়। পণ্যের বিপণন নির্ণয় করা সহজ এই কৌশলের ক্ষেত্রে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে অল্প সময়েই পণ্যের তথ্য বিশাল সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়। তবে বেশ কিছু অসুবিধাও রয়েছে। যেমন- জনসাধারণের চলাচলের কোনো স্থানে দেয়া বিজ্ঞাপন যদি বিরক্তের কারণ হয় বা অনুভূতিকে আঘাত করে, তাহলে তুমুল জনআক্রোশের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি কিংবা খারাপ আবহাওয়ায় এই ধরনের বিজ্ঞাপন কৌশল অবলম্বন করা যায় না। অনেকক্ষেত্রে কৌশল খুব বেশি নতুন হয়ে গেলে সফলতা নিয়ে সন্দিহান দেখা দেয়। সব দিক ঠিক না থাকলে এই কৌশল ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এবার তাহলে গেরিলা মার্কেটিংয়ের প্রকারভেদ নিয়েও একটি ধারণা পাওয়া যাক।
গেরিলা মার্কেটিং কৌশলের একটি বহুল প্রচলিত ধরন হচ্ছে ‘আউটডোর গেরিলা মার্কেটিং’। সাধারণত বাইরের কোনো স্থান, যেখানে সর্বসাধারণের যাতায়াত খুবই বেশি, সেখানে এই কৌশল অবলম্বন করা হয়। সাধারণত রাস্তার পাশে কোনো পণ্যের বিশাল রেপ্লিকা স্থাপন করা এই ধরনের বিজ্ঞাপনের আওতাভুক্ত। উদাহরণ হিসেবে আমেরিকার মোজা ও অন্তর্বাস তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান গোল্ডটোর কথা বলা যায়। ২০১০ সালে যখন তারা অন্তর্বাসের নতুন এক সিরিজ বের করে, তখন নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের বিখ্যাত ষাঁড়কে তাদের তৈরি করা অন্তর্বাস পরিয়ে দিয়ে ‘আউটডোর গেরিলা মার্কেটিং’ কৌশল অবলম্বন করেছিল।
‘ইনডোর গেরিলা মার্কেটিং’ হচ্ছে এই বিজ্ঞাপন কৌশলের আরেকটি প্রচলিত ধরন। এই কৌশলের ক্ষেত্রে কোনো সীমানাকৃত জায়গা তথা অডিটোরিয়াম বা ভবনের ভেতরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। এর পরিসরের ভেতরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসও পড়তে পারে। ২০০৯ সালে ‘টি-মোবাইল’ লিভারপুলের স্ট্রিট স্টেশনে একটি কনসার্টের স্পন্সর করে। সেই কনসার্ট ইউটিউবে ত্রিশ লাখেরও বেশিবার দেখা হয়। টি-মোবাইলের এই বিজ্ঞাপন ‘টিভি কমার্শিয়াল অব দ্য ইয়ার’ জিতে নেয় এবং তাদের বিপণন বাড়িয়ে দেয় ৫২ শতাংশ!
‘ইভেন্ট-অ্যাম্বুশ মার্কেটিং’ কোনো বিশেষ দিনে নির্ধারিত অনুষ্ঠানকে লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া দর্শক কিংবা শ্রোতাদের মাঝে ‘ব্র্যান্ড সচেতনতা’ তৈরি করে এই কৌশল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ২০১৯ সালে গোল্ডেন গ্লোবস অ্যাওয়ার্ড শো-তে লাল কার্পেটের উপর দাঁড়িয়ে যখন সেলিব্রিটিরা ছবি তুলছিলেন, তখন কালো ও নীল পোষাক পরিহিত একজন মডেল প্রায় সব সেলিব্রিটির ছবির পেছনে এক ট্রে ফিজি পানির বোতল নিয়ে পোজ দিয়েছিলেন। ইন্টারনেটে এই ছবিগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
গেরিলা মার্কেটিংয়ের সর্বশেষ ধরন হচ্ছে ‘এক্সপেরিমেন্টাল গেরিলা মার্কেটিং’। এটি যেকোনো স্থানে হতে পারে। যেমন- অনেক সময় সিড়ির ধাপগুলোর এমনভাবে রং করা হয়, যেগুলো কোনো পণ্যকে নির্দেশ করতে থাকে। গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান ভক্সওয়াগনের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যখন সিড়ির ধাপগুলো বর্ণিল করে তোলা হয়, তখন পূর্বের চেয়ে ৬৬ শতাংশ বেশি মানুষ সেগুলো ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সুতরাং এই উপায়েও একটি পণ্যের বিপণন করা যেতে পারে।
একটি ব্র্যান্ডের জন্য গেরিলা মার্কেটিং উপযুক্ত বিজ্ঞাপন কৌশল কিনা তা নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের উপর। একদিকে যেমন মানানসই জনসাধারণের চলাচলের স্থানের সহজলভ্যতা থাকতে হয়, অপরদিকে এমনভাবে বিজ্ঞাপনের কৌশল নিতে হয় যাতে কোনো আইনি ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না, যাদেরকে লক্ষ্য করে এই বিজ্ঞাপন কৌশল নেয়া হবে, তারা যেন কোনোভাবেই বিরক্তবোধ না করে। এছাড়া এই বিজ্ঞাপন কৌশলে সৃজনশীলতা খুবই দরকারি একটি দক্ষতা। বাজারের অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় যদি আপনার বিজ্ঞাপন সৃজনশীল হিসেবে সম্ভাব্য ভোক্তাদের দৃষ্টি কাড়তে সমর্থ না হয়, তবে আপনার কৌশল ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যাবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিজ্ঞাপনের জগতে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এই মাধ্যমকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে গেরিলা মার্কেটিং কৌশল প্রয়োগ করলে শূন্য থেকে শিখরে ওঠা সম্ভব।